বিজ্ঞাপন

মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

May 26, 2023 | 11:40 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লবণ গ্রহণের কারণে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপসহ নানারকম ঝুঁকি। এতে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকিও।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকে অনেকেরই ভাতের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। অনেকের উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ এটি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাত্রাতিরিক্ত লবণ খাওয়া কমানোর পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন জরুরি। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

এমন অবস্থায় গণসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নাগরিকদের প্রাথমিক পর্যায়ে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

প্রয়োজনের অতিরিক্ত লবণ কীভাবে ক্ষতি করছে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন একজন মানুষের ৫ গ্রাম অর্থাৎ, এক চা চামচ লবণ খাওয়া দরকার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে কয়েকগুণ বেশি খাওয়া হয়ে থাকে অনেকের। শুধু বাড়িতে খাওয়া ভাত তরকারিতে নয় বরং অনেকেই না জেনে বাইরের খাবারের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করছেন।

শুধুমাত্র অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বন্ধ করতে পারলে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ কমবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তনের উপরও জোর দিচ্ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের বর্তমান পরিস্থিতি কী

বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি চারজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। প্রতি বছর নতুনভাবে ১৫ লাখ ৩০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপের রোগী বাড়ছে। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১২ বছর সময়ে দেশে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে প্রায় সাত শতাংশের মতো।

মহিলাদের মাঝে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তেমন বেশি না বাড়লেও পুরুষ রোগীর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এক সময় দেশে ১৭ থেকে ১৯ শতাংশ পুরুষের মাঝে উচ্চ রক্তচাপ রোগ দেখা গেছে। কিন্তু সেটা এখন বেড়ে পৌঁছেছে ২৪.৫ শতাংশে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ রোগের পরিস্থিতি জানার জন্য এখন পর্যন্ত তিনটি সার্ভে বা জরিপ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডিসি) শাখার অর্থায়নে বাংলাদেশে সোসাইটি অব মেডিসিন প্রথম জরিপটি করে। ২০১০ সালে করা এই প্রথম জরিপে দেখা গেছে,  দেশে প্রতি ১০০ জনে ১৭.২ জনের মাঝে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত পাওয়া যায়। কিন্তু ২০১৮ সালে একই বিষয়ে করা দ্বিতীয় সার্ভেতে দেখা যায়, ১০০ জনের মাঝে ২১ জন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডিসি) প্রোগ্রামের ফান্ডের সহায়তায় এই সার্ভেটি করে নিপসম।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালে বিসিপিএস সার্ভে করে এনসিডিসি’র অর্থায়ন সহযোগিতায়। এই সার্ভেতে ১০০ জনে ২৪.২ জনের মাঝে উচ্চ রক্তচাপ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এই সার্ভেতে উচ্চ রক্তচাপের প্রিভিল্যান্স ছিল ২৪.২ শতাংশ। এর অর্থ হলো- দেশে প্রতি চারজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে।

দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় দেখা যায়, ২০১০ সালে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৭৯ লাখ। কিন্তু ২০১৯ সালে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হয় তিন কোটি ৫৭ লাখ। অর্থাৎ, আট বছরে দেশে রোগীর সংখ্যা বাড়ে ৭৮ লাখ। ২০২২ সালের জরিপে দেশে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হয় আনুমানিক চার কোটি ৮২ লাখ। অর্থাৎ, ২০১৮ সালের পরবর্তী বছরগুলোতে ১৫ লাখ ৩০ হাজার করে উচ্চ রক্তচাপের রোগী যুক্ত হয়েছে দেশে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বন্ধ করতে পারলে ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যেত। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন অর্থাৎ, এক চামচ। কিন্তু এর বেশি খাচ্ছেন অনেকে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দেশে অধিকাংশ মানুষ ১০ থেকে ১৫ গ্রামের বেশি লবণ খাচ্ছে।

তিনি বলেন, অনেকে জেনে লবণ খাচ্ছেন, আবার অনেকেই না জেনে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করছেন। ঘরে যিনি খাচ্ছেন তিনি হয়তবা জেনেই সেটা গ্রহণ করছেন। কিন্তু ঘরের বাইরে যে খাবার খাচ্ছেন, তাতে কী পরিমাণ লবণ আছে, তা অনেকে না জেনেই খাচ্ছেন। যেমন অনেকেই জানেন না যে চিপসে ১০ গ্রাম লবণ থাকে। ঘরের বাইরে সিঙ্গারা, সমুচা বা হোটেলের বিভিন্ন ধরণের খাবার মাঝে কী পরিমাণ লবণ আছে তা অনেকেই না জেনে খাচ্ছেন। ফলে তাদের শরীরে প্রবেশ করছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঁচ গ্রামের বেশি লবণ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের হাইপারটেনশন কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (জাতীয় কর্মসূচির) ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চের রিসার্চ ফেলো ডা. শামীম জুবায়ের। লবণ খাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকার কথাও বলেন ডা. শামীম জুবায়ের।

তিনি বলেন,মানবদেহের জন্য লবণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান। এককভাবে উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে লবণের পরিমিতি বোধ। একজন সুস্থ মানুষ কাঁচা লবণ বা রান্নায় ব্যবহৃত লবণসহ সারা দিনে ৫ গ্রাম খেতে পারবে। অথচ দেশের মানুষ দিনে প্রায় ৯-১০ গ্রাম লবণ খায়।

তিনি আরও বলেন, জাপান, ফিনল্যান্ডসহ যেসব দেশে লবণের সমস্যা ছিল, সেসব দেশে লবণ খাওয়াকে দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে স্ট্রোক ১০ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর যা বলছে

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে নানা ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।

তিনি বলেন, উচ্চ রক্তচাপের জন্য এনভায়রনমেন্টাল যেসব ফ্যাক্টর কাজ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো লবণ। অনেকেই দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে খাওয়ার সময় অতিরিক্ত লবণ খেয়ে থাকে। এ বিষয়ে আমাদের একটা স্টাডি আছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের গ্রামীণ বা শহর অঞ্চলে সারাদিনে মানুষ প্রায় ৯ গ্রামের মতো লবণ গ্রহণ করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি মান অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপের প্রভাব কমানোর জন্য লবণ গ্রহণের মাত্রা পাঁচ গ্রামের নিচে থাকতে হবে। লবণের ক্ষেত্রে প্রায় দ্বিগুণ অবস্থায় আছি আমরা। বাংলাদেশে লবণ গ্রহণ বিষয়ে কোনো নীতি এখন পর্যন্ত নেই। এই বিষয়ে নীতি করতে গেলে বিভিন্ন খাতকে সংযুক্ত করতে হবে। এর জন্য উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে।

নীতি বিষয়ে ডা. রোবেদ আমিন জানান, চলতি বছরেই প্রাথমিকভাবে সল্ট পলিসি করার করা যায় সেটার চেষ্টা করছেন তিনি।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত লবণ গ্রহণের মাত্রা কমানোর জন্য যেসব পদ্ধতি কাজ তার বেশিরভাগই উচ্চ পর্যায়ের বিষয়। অর্থাৎ, ফুড আইটেমের ক্ষেত্রে কোন মাত্রায় লবণ থাকবে, কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্টের টেবিলে অতিরিক্ত লবণ দেওয়া হবে কি না- ইত্যাদি নীতি তৈরি করে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ক্ষেত্রে ফল পেয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন খাদ্যপন্যে থাকে মাত্রাতিরিক্ত লবণ। যেমন রুটিতে প্রচুর পরিমাণে লবণ দেওয়া থাকে। এগুলোর ক্ষেত্রে তো স্ট্যান্ডার্ড একটা জায়গায় আসতে হবে। এতে বিএসটিআই, খাদ্য বিভাগসহ অনেক স্টেক হোল্ডার জড়িত। তারপরেও আমরা আশাবাদী যে একটা লবণ নীতি করতে পারব।

দেশের গ্রামাঞ্চলেও বর্তমানে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে উল্লেখ করে ডা. রোবেদ আমিন বলেন, একটা সময় গ্রামে ফাস্ট ফুড বা অন্যান্য জাঙ্ক ফুড পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন সেখানেও এগুলো পাওয়া যাচ্ছে। আগে গ্রামে শুধু ডাবের পানি পাওয়া যেত। আর এখন নানা ধরণের কোমল-পানীয়, চিপসজাতীয় খাদ্য এখন প্রায় সব গ্রামেই পাওয়া যাচ্ছে। এসব জাঙ্ক ফুডে কিন্তু প্রচুর মাত্রায় লবণ থাকে যা গ্রহণে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ছে।

সমাধান কী

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আমরা আসলে একটা সাইকেলেই ঘুরপাক খাচ্ছি। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আমরা কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তথ্য যোগাড় করে আমরা সবার মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়াও উপজেলা, জেলা পর্যায়েও কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এনসিডি কর্নারেও সেবা দেওয়া হচ্ছে। আরও কিভাবে এসব কাজকে ইনোভেটিভ করা যায় সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। সব মিলিয়ে মনিটরিংয়ের জন্য যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন তার সংকট থাকলেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন,গ্রামের উঠান বৈঠকে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা উপস্থিত হয়ে সচেতন করে তোলার কাজটা করে যাচ্ছে। স্কুলিং হেলথ নিয়ে আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে, যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার ইচ্ছে আছে। বিশেষ করে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ না করে স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়ার বিষয়ে সচেতন করার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও তাদের আমরা জানালে সেটার একটা ফল পাওয়া যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে তো ফিজিক্যাল একটিভিটিজের কোনো গাইডলাইন নেই। একটা ছয় বছর বয়সী শিশু বা ৬০ বছর বয়সী কতটুকু দৌড়াবে বা কতটুকু কী করতে হবে সুস্থ থাকার জন্য সে বিষয়েও কোনো গাইডলাইন নেই। হেলদি সিটির বিষয়ে আজকাল ভাবা হচ্ছে। এছাড়াও শারীরিক নানা একটিভিটিজ চালানোর বিষয়েও প্রচারণার পরিকল্পনা আছে।

সারাবাংলা/এসবি/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন