বিজ্ঞাপন

সম্প্রসারণমূলক বাজেট ও আইএমএফের শর্ত

June 13, 2023 | 2:50 pm

রজত রায়

১ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়। এটি বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট। দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাজেটের আকারও প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সামষ্ঠিক অর্থনীতির সূচকসহ রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া বিশ^ব্যাপী বিরাজমান কঠিন পরিস্থিতির কারণে অত্যন্ত চাপের মুখে পড়েছে। তাই এই বাজেট বাস্তবায়নে অর্থনীতিতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ, লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতি উন্নয়ন, বৈদেশিক মুুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, রিজার্ভ বাড়ানো, অপরিশোধিত তেল সংগ্রহ, জ¦ালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি অন্যতম। এছাড়া ডলার সংকট এবং বিশ^ পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগ, আমদানি রপ্তানি, রেমিটেন্স, রিজার্ভ সবকিছুর গতি নি¤œমুখী। অতচ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি উর্ধ্বমুখী।

বিজ্ঞাপন

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ অর্থবছরের জন্য আয় হিসাব করা হচ্ছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। সংশোধিত আকারকে ভিত্তি ধরলে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বেড়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর গড় মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ । বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে এনবিআর কে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। যার প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার আসে গত ফেব্রুয়ারিতে। বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ টি কিস্তিতে এই অর্থ দেয়া হবে। তবে এই ঋণের পেছনে আইএমএফের বেশ কিছু সংস্কারের শর্তও বেঁধে দিয়েছে।

আইএমএফ’র একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে দেশে কর জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হবে। অর্থাৎ সংস্থাটি চায় মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি তুলনায় রাজস্ব আয় সন্তোষজনক পর্যায়ে বাড়–ক এবং ঋণ খেলাপি কম হোক। এই অবস্থায় সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর সুবিধা বা ছাড় দেয়ার কারণে সরকার বড় ধরনের রাজস্ব হারায়। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য কর সুবিধা বা কর ছাড় দেয়া ব্যবস্থাটি বাজেটে প্রত্যাহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে কর আদায়ের পরিমাণ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। ঋণ অনুমোদনকালে এ শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে বাড়তি ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে এনবিআরকে আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে। আয় বৃদ্ধির প্রধান উৎস এনবিআর। এই বিশাল লক্ষ্য অর্জনে এনবিআরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুল্ক কর বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। আর তাই চলতি অর্থবছরে বাজেটে কারও আয় করমুক্ত সীমার নিচে হলেও সরকারি ৩৮ টি সেবা নিতে টিআইএনের বিপরীতে তার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা কর নেওয়ার বিধান করেছে। তাই ফাইভ স্টার হোটেল বা অন্যান্য বড় হোটেলের জন্য যেসব মালামাল আমদানি করা হয় তার উপর বড় ধরনের কর রেয়াত দেওয়া হতো। অন্যান্য আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে যেখানে ১০০ শতাংশ বা ১১০ শতাংশ ডিউটি চার্জ করা হয়, সেখানে হোটেলের মালিকরা ১০ শতাংশ কর প্রদান করতো। বাজেটে এখন এই সুযোগ প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

আইএমএফ এর শর্তগুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ভুর্তুকি কমানো। বাজেটে সরকার ভুর্তুকি খাতে ব্যয় করবে মোট ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই ভুতুর্কির বড় অংশ ব্যয় করা হবে বিদ্যুতে, যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কৃষিতে যাবে ১৭ হাজার কোটি, রপ্তানি ভুর্তুকিতে যাবে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা এবং প্রণোদনায় ব্যয় হবে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাতের ভুর্তুকিতে ব্যয় হবে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা। সরকার যদি এসব ক্ষেত্রে ভুর্তুকি প্রদান করে তাহলে আইএমএফের সঙ্গে কি সংঘাত সৃষ্টি হবে? কারণ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রদানের জন্য অনুমোদন দিয়েছে সেখানে ভুর্তুকি ব্যাপকভাবে প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। যদিও কোন কোন খাতে ভুর্তুকি কমাতে হবে তা সংস্থাটি নির্দিষ্ট করে বলেনি। আগামী আগষ্ট মাসে তারা একটি মূল্যায়ন করবে। তারা দেখবে বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের দেওয়া শর্ত কতটা পালন করছে। আর তৃতীয় শর্ত ছিল ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন যে, অনেক আগে থেকেই দেশে ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল কিন্তু সেটি না করার কারনে আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী হঠাৎ করে এটি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে একটা শক লাগার ব্যাপার কাজ করবে। ডলারের দাম বেড়ে গেলে সব আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সেই সাথে আমদানিকৃত পণ্য ব্যবহার করে যা উৎপাদন করা হয়ে থাকে সেগুলোরও দাম বাড়বে। অর্থাৎ চেইন ইফেক্টে মুদ্রাস্ফীতি হবে।

বিজ্ঞাপন

ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী অর্থ সংগ্রহের দুটি উৎস খাত চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে কোন উৎস থেকে কত টাকা ঋণ করা হবে তা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী জানা যায়, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা মোট ঘাটতি অর্থায়নের ৫৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি আর সঞ্চয়পত্র থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা। অবশিষ্ট ১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ। এখন দেখা যাক বাজেটে প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার ব্যয় কিভাবে উপস্থাপন হয়েছে। বাজেটে খরচের দুটি খাত নির্ধারণ করা হয়েছে। দেখা যায় যে, এর একটি হলো সরকারের আর্বতক ব্যয় বা পরিচালন ব্যয়। এর আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। যা মোট সরকারি ব্যয়ের ৬৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং জিডিপির ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যটি হলো উন্নয়ন ব্যয় যার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা । এদিকে মোট আয়ের লক্ষ্য যে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আয় সংগ্রহ কিভাবে হবে তা দেখা যাক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর -কে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটা জিডিপির ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের মূল লক্ষ্য মাত্রার তুলনায় ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। বাকি আয় সংগ্রহের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে নন এনবিআর কর খাত থেকে ২০ হাজার কোটি এবং কর বহির্ভূত খাত থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে পরিচালন ব্যয়ের যে আকার নির্ধারণ করা হয়েছে সেখান থেকে বিভিন্ন সরকারের সময় নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বাজেটের ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ বা ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকারের যে অভ্যন্তরীণ ঋণ রয়েছে তার সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ৮২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। এখন দেখা যাক অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের খাতগুলো কি। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাতে ব্যয় হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে বিল-বন্ডের সুদে যাবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি চাকরিজীবীদের জিপিএফ খাতের সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা পরিশোধ ব্যয় করা হবে ৮ হাজার কোটি টাকা।

অর্থনীতির জন্য আরো একটি জটিল চাপ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমে যাওয়া। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। এর মধ্যে আবার ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাই প্রকৃত রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মত হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যদি স্ফীত না হয় তাহলে আগামীতে পণ্য আমদানিতে সমস্যা হতে পারে। আমদানি কারকগণ যদি এলসি খুলতে না পারে তাহলে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানি কমে যাবে। এতে শিল্পায়ন ব্যাহত হবে। শিল্পায়ন ব্যাহত হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। ফলে সরকারের দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সার্বিক প্রবৃদ্ধি বিঘিœত হবে। প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশের টালমাটাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য বাজেট সহায়তার বিনিময়ে আইএমএফ যেমনটা চেয়েছে মনে হচ্ছে তেমনটাই হচ্ছে। এতে মধ্য ও নি¤œবিত্ত মানুষরা যেমন কষ্টের মুখে পড়বেন, তার সঙ্গে ভোক্তার ব্যয়ের ওপরও এটি অনিবার্য প্রভাব ফেলবে। কারণ বাংলাদেশের জিডিপির বেশিরভাগই প্রায় ৭৪ শতাংশ তৈরি হয় ভোগ থেকে । অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়ন হলে প্রবৃদ্ধির ওপর সরাসরি আঘাত আসবে। সেটা হলে অর্থের অভাবে ব্যয় কমাতে হবে। টাকাও বেশি মানুষের হাতে পৌছাবে না। ফলে তৈরি হবে একটা অখুশি ভোট ব্যাংক। আবার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে। ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়বে। পরিনামে ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়বে, ফলে সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে দেনার পরিমাণ আরও বেশি হবে। আর সেটা নিশ্চিতভাবে বিনিয়োগকে আঘাত করবে। বেসরকারি বিনিয়োগের ধারাও এখন খুব ভালো অবস্থায় নেই। আরও বেশি ব্যয় সংকোচন হলে ধাক্কা লাগবে নিয়োগও মজুরির ওপর।

এটা ঠিক চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে তা একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট। বাস্তবতার আলোকে সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। একইভাবে ঘাটতি অর্থায়নের জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার বড় অংশ নেওয়া হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি সবারই জানা। তারল্য সংকটে অনেক ব্যাংক এ অবস্থায় সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পেতে হলে টাকা ছাপানোর বিকল্প থাকবে না। সেটি করতে গেলে বাজারেও মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হবে এবং মূল্যস্ফীতি আরও উস্কে যাবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বিজ্ঞাপন

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন