বিজ্ঞাপন

গুজবে ‘আলু পোড়া’ খাওয়ার রাজনীতি

June 18, 2023 | 4:51 pm

তাপস হালদার

গুজবে ভাসছে দেশ। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে পরিকল্পিত ভাবে গুজবের ডালপালা আরো বিস্তৃত হচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউব সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো গুজবের কারখানায় পরিনত হয়েছে। নির্বাচনকে টার্গেট করে বিরোধীরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকারের মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা চালানোর জন্য প্রযুক্তিতে দক্ষ এক শ্রেণীর দুর্বৃত্তদের ভাড়া করেছে। প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবার ও সরকারকে বিভ্রান্ত করতে গুজব গুলো ছড়ানো হচ্ছে। গুজবকারী বা ষড়যন্ত্রাকারিদের একমাত্র টার্গেট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আপনি ইউটিউব, ফেসবুক খুললেই মনে হবে সরকারের পতন সময়ের মাত্র। দুর্বৃত্তরা এমন ভাবে কল্পকাহিনি তৈরি যাতে করে সমাজের একটি শ্রেণীর মানুষকে অন্ততপক্ষে বিভ্রান্ত করা যায়।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গুজব ষড়যন্ত্রের ডালপালা ছড়ানো হয়েছে। ধর্মীয় ভাবাবেগকে পুঁজি করে একশ্রেণীর অপশক্তি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তৎপর হয়ে উঠে। এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গুজব ছিল- আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশে ধর্ম থাকবেনা, মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। সস্তা, আজগুবি ধর্মীয় ভাবাবেগকে জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করা হয়েছিল। যার ফলও তারা পেয়েছিল।

বাংলাদেশের উপর মার্কিন ভিসানীতি আরোপের পর গুজব আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মার্কিন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যারা বাধা দিবে তারাই মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় পড়বে। ভোটে কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনসমাবেশের উপর বাধা সৃষ্টি, মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ এবং সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্থ করলে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। এক্ষেত্রে সরকার, বিরোধী রাজনৈতিক দল, সাবেক ও বর্তমান সরকারি আমলা, বিচারকগণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচন প্রকৃয়ায় যারা থাকবে তাদের প্রত্যেকই এই আওতায় থাকবে সেকথা বলা হয়েছে। কিন্তু গুজব সৃষ্টিকারীরা এটি সরকারের বিরুদ্ধে জারি হয়েছে বলে জাহির করে বেড়াচ্ছে। নিত্যনতুন উদ্ভট তথ্য দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মনোবল ভাঙ্গতে গুজব সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব অপপ্রচারের কারণ হলো প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে সরকারকে দুর্বল করা। অথচ এটি যে সমান ভাবে বিরোধী দলের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য সেটা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গুজব ছড়ানো হয়েছিল, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্রুতই শ্রীলঙ্কার মতো হবে। রিজার্ভ শূন্য হয়ে গেছে, ব্যাংকে টাকা নেই, দেশের সব টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এমন গুজবে কিছু লোক বিভ্রান্ত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তোলা শুরু করে দিলো এবং প্রবাসীরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে রেমিট্যান্সের প্রবাহও কমে যায়। সাময়িক হলেও অর্থনীতিতে একটা ধাক্কা লাগে।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই ষড়যন্ত্রকারীরা গুজবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তান্ডবের পর গুজব রটানো হয় হাজার হাজার আলেমদের হত্যা করা হয়েছে। একই বছরে একাত্তরের ঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে বিচারের সময় গুজব ছড়ানো হয় ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে।’ এমন গুজবে ছড়িয়ে রংপুর, বগুড়া সহ পুরো উত্তরবঙ্গে সহিংসতা চালিয়ে মানুষ হত্যাসহ ব্যাপক সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়। ২০১২ সালের কক্সবাজারের রামুতে গুজব ছড়িয়ে বৌদ্ধ মন্দির হামলা, ২০১৬ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা এবং ২০২১ সালে দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা, রংপুর, দিনাজপুর সহ বেশ কয়েকটি জেলায় পরিকল্পিত ভাবে গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা করা হয়।

বাংলাদেশের গর্বের পদ্মা সেতু নির্মান কালে এক সময় বলা হয়েছিল, পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে, এমন ভিত্তিহীন গুজব রটিয়ে সারা দেশে ছেলে ধরা সন্দেহে অন্ততপক্ষে বাইশ জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ব্যাংকের রিজার্ভ নেই, দেশ শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যাবে এমন গুজব ছড়িয়ে দেখা হাজার হাজার মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়িতে রাখছে। এ গুজবের অর্থ হলো ব্যাংকের তারল্যসংকট তৈরি করে অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলা। দেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলাম ধর্ম বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের নাস্তিক বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ তুলে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম গুলো ব্যবহার শিক্ষাঙ্গনকে অস্থির করার চেষ্টা করা হয়। যা ছিল সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও শিক্ষাঙ্গনকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা। প্রায় প্রতিবছরই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। বিগত দিনে এমন গুজবে রামু, কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ভোলা, চাঁদপুর, রংপুর, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর লুটপাট এমনকি জীবননাশের মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটেছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় দুর্বৃত্তরা ফেসবুক লাইভে এসে ‘চার শিক্ষার্থীকে খুন করে ফেলেছে, চার মেয়েকে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে আটক করে রাখা হয়েছে’ এমন গুজব রটিয়ে হামলা চালায়।

প্রতিটি ঘটনায় পর দেখা গেছে, ভিকটিম যারাই হোক না কেন দুর্বৃত্তদের মূল টার্গেট সরকার, বিশেষ করে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। তাকে বেকায়দায় ফেলতে পরিকল্পিত ভাবে দীর্ঘদিন ধরে গুজবকে হাতিয়ার করা হচ্ছে। এসব দুর্বৃত্তরা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে থেকেও সমানতালে সরকার ও রাষ্ট্র বিরোধী নানা গুজব অপপ্রচার চালাচ্ছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ, দুবাই থেকে কিছু ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে মনগড়া তথ্য দিয়ে এমন সব তথ্য উপস্থাপন করা হয় যাতে করে প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক অল্প কিংবা স্বল্প শিক্ষিত লোকজন বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এসব সাইবার দুর্বৃত্তদের বিএনপি-জামাত বিপুল অর্থ ব্যয়ে ভাড়া করেছে।

বিজ্ঞাপন

গুজব-অপপ্রচার বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও তেমন কোনো কঠিন পদক্ষেপ এখনও দেখা যাচ্ছেনা। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, Prevention is better than cure অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। গুজব প্রচারের ক্ষেত্রে ফেসবুক ও ইউটিউবকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই সেটা করেছে। আমাদের দেশে তাদের বিশাল বাজার। তাদেরকে চাপ দিলে তারা মানতে বাধ্য হবে।

গুজব এক অর্থে বায়বীয়। শোনা যায়, দেখা যায় না। অর্থাৎ যার কোনো অস্তিত্ব নেই। একদল মানুষ গুজব ছড়িয়ে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে। বিরোধী পক্ষকে জব্দ করতে কিংবা ঘায়েল করতে গুজব রটিয়ে দেয়া হয়। আর আবেগপ্রবন বাঙালি ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাছাই না করেই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়। ক্ষতি হয় সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের। আর এই সুযোগটির জন্য বসে থাকে বিএনপি। যতবারই গুজব সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে, ততবারই বিএনপি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা গোপাল ভাঁড়ের গল্পের মতো ‘আলু পোড়া’ খাওয়ার জন্য সবসময় বসে থাকে। তাদের কাছে দেশের ক্ষতি হোক, সেটা বড় কথা নয়। তাদেরকে ক্ষমতায় বসতে হবে সেটাই বড় কথা। এজন্যই তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে এক শ্রেনীর সাইবার দুর্বৃত্তদের দিয়ে অবিরাম মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন