বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতু: বাঙালির স্বপ্নজয়ের এক বছর

June 25, 2023 | 12:41 pm

ইমরান ইমন

সব আলোচনা, সমালোচনা আর জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন হলো আমাদের স্বপ্নের সেতু। সত্য হলো বাঙালির স্বপ্ন, প্রমাণিত হলো বাঙালির সক্ষমতা। সে হিসেবে বাঙালির স্বপ্ন জয়ের এক বছর (২৫ জুন ২০২২-২৫ জুন ২০২৩) পূর্ণ হলো আজ। গত এক বছরে পদ্মা সেতু থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৭৭৪ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতু দেশের জন্য কী পরিমাণ সুফল বয়ে এনেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন এক দরজা উন্মোচন হলো পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। খরস্রোতা নদীর থই থই জলরাশির মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর রঙের দ্বিতল কাঠামোর এই জাতীয় স্থাপনার প্রতি মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। স্বপ্নের সেতুকে ঘিরে মানুষের তাই অন্যরকম অনুভূতি ও উচ্ছ্বাস। বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণের অনন্য এক নিদর্শন তো বটেই সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের রুটি-রুজির নতুন এক সম্ভাবনাও।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর জেলার জাজিরাসহ দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলার সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক যোগসূত্র স্থাপন হয়েছে। আর এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে অনন্য অবদান রাখবে। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। ঢাকার সাথে মংলা বন্দর, বরিশাল, কুয়াকাটা, পায়রা বন্দর, খুলনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলার অর্থনৈতিক খাতে এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর ভূমিকা নিয়ে এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ।

পদ্মা সেতু দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাড় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক পদ্মার দুই পাড়ে নান্দনিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ঘুরতে যায়। মাওয়া ও শরীয়তপুর প্রান্তে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানাবিধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট জাজিরায় তাঁত পল্লী প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান ও খ্যাতনামা দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান এসব এলাকায় বিনিয়োগ করছে যা উক্ত অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।

বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা দেখছেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, দেশের পর্যটনের মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু। এর ফলে দ্রুততম সময়ে যাওয়া যাবে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ও সাগরকন্যা কুয়াকাটায়। লঞ্চে পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা পৌঁছাতে সময় লাগে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা। তবে পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে অর্ধেক সময়েই পৌঁছানো যাবে। গত বছরের অক্টোবরে পটুয়াখালীর লেবুখালী সেতুর উদ্বোধন হওয়ায় এ যাতায়াত আরও সহজ হবে। বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বাগেরহাট ঘিরে পর্যটনশিল্পে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন তারা। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার ও বন বিভাগকে সমন্বিত ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নিলে এর গতি আরও তরান্বিত হবে।

এতদিন মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট নদী পার হতে আসা মানুষের ভিড়ে ঠাসা ছিল। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন সেই ঘাট রূপ নেবে নিস্তব্ধতায়। তবে এ ঘাট রাতে পরিণত হয় নাগরিক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার কেন্দ্র হিসেবে। পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটকের পদভারে আবারও মুখর হবে আশপাশের এলাকা। এ ছাড়া দক্ষিণবঙ্গের দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলোতে বাড়বে পর্যটক। এতে প্রাণ পাবে এ বিস্তীর্ণ এলাকার পর্যটন। শিমুলিয়া ঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী নুর হোসেন বলেন, ঘাটের পালা শেষ হলেও নদীর ধারে বেড়াতে আর ইলিশ খেতে আসা মানুষের আনাগোনায় পর্যটন জমবে পদ্মা সেতুর পথে। এখন তারা সেই আশাতেই বুক বাঁধছেন। আদি পেশা বদল করে মাওয়া-জাজিরার অনেকেই এখন পর্যটনকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসায় ঝুঁকছেন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের পর্যটনের উদ্যোক্তারাও নতুন সেবা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।

পদ্মা সেতু চালুর ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায়, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার উপকূলজুড়ে অবস্থিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনও নতুন রূপে জেগে উঠবে। পাশাপাশি শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা সৈকত, পাথরঘাটার হরিণঘাটা বন, সমুদ্রসৈকত, বরিশালের দুর্গাসাগর দিঘি, সাতলার শাপলাবিল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারা বাজার, ভোলার চর কুকরী মুকরী, মনপুরা হতে পারে পর্যটকদের নতুন গন্তব্য।

বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতু চালুর আগেই দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের উভয় পাশেই শুরু হয়েছে পর্যটকদের জন্য নানা বিনোদনের আয়োজন। স্থানে স্থানে চা-কফির দোকান, খাবার হোটেল, বিশ্রামাগার, সুদৃশ্য যাত্রী ছাউনিও নির্মাণ করা হয়েছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গার চার রাস্তা মোড়ে গোল চত্বরের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় কয়েকটি স্পট। বরিশালের দপদপিয়া, বিমানবন্দর, গড়িয়ার পাড়, শিকারপুর এলাকায় মহাসড়কের দুপাশে বেসরকারি খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন চলছে একের পর এক। আর এসবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে টার্গেট করে। জাজিরার নাওডোবা থেকে শিবচরের মাদবরচর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর জন্য নির্মিত সাড়ে ১০ কিলোমিটার নদীশাসন এলাকা এখন দৃষ্টিনন্দন বিনোদনকেন্দ্র। খুব কাছ থেকে সেতু দেখার জন্য সেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছেন।

পর্যটন উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এই সেতু দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ঈর্ষণীয় ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভ্রমণপ্রেমীদের অন্যতম আকর্ষণ পদ্মা সেতু। দেশের পর্যটনের গতিধারাও বদলে দিতে পারে এই সেতু। ইতিমধ্যে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোও পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিভিন্ন রকম ভ্রমণ প্যাকেজের পরিকল্পনা করছেন।

রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্য পরিবহন করে মংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি গতিশীল হবে এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি হবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত (যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়), ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট দ্বীপগুলোকে মালদ্বীপের ন্যায় পর্যটন আকর্ষণ তৈরি করা সম্ভব এবং সুন্দরবন ঘিরে ওয়াইল্ড লাইফ ট্যুরিজম উন্নয়নের অনন্য সুযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চরগুলোকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মালদ্বীপের ন্যায় পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা গেলে প্রচুর পরিমাণ আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে যে সময় লাগে পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে তার চেয়ে অর্ধেক সময়ে পর্যটকেরা কুয়াকাটা ও সুন্দরবন পৌঁছে যাবে।

পায়রা বন্দরের সাথে বুলেট ট্রেন চালু করার কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে যা দেশি ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

প্রতিবছর পর্যটকবাহী ৪৫টি ক্রুজ ভারতে কুচবিহার-চেন্নাই-গোয়া হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে চলে যায়। তবে এই ক্রুজগুলো যদি পায়রা বন্দরে আকৃষ্ট করা যায় তবে আন্তর্জাতিক পর্যটক উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। পদ্মা সেতু গতিশীল করবে মংলা ও পায়রা বন্দরকে যা সুনীল অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রাখবে।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল যেমন কুয়াকাটা, মংলা বন্দর ও পায়রা বন্দর কেন্দ্র করে সমুদ্র পর্যটনের সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। নদীভিত্তিক ও সমুদ্রভিত্তিক পর্যটনে সময়োপযোগী সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য মাত্রা বাস্তবায়নের পাশাপাশি তৈরি করবে কর্মসংস্থান সুযোগ, শক্তিশালী হবে জাতীয় অর্থনীতি। তবে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য পদ্মা সেতুর ও দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণগুলো ছোট ছোট প্রমো তৈরি করে ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং করা প্রয়োজন।

পদ্মা সেতু আমাদের বড় অর্জন। যেখানে পুরো বিশ্ব বলেছিল বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না, সেখানে খরস্রোতা পদ্মার বুকে বাংলাদেশ নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করে দেখিয়েছে। এটা বাঙালি জাতির সাহস ও সামর্থ্যের বড় দৃষ্টান্ত। পদ্মা সেতু এখন মানুষের চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। এই পদ্মা সেতু ঘিরে এখন তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনা। পদ্মা সেতু হওয়াতে আশপাশের অঞ্চলসমূহে এখন বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। যা পূর্বে ছিল অকল্পনীয়। আর এতে দেশের অর্থনীতিতে খুলবে নতুন নতুন সম্ভাবনার দরজা। সমৃদ্ধ হবে দেশ, দেশের অর্থনীতি। পাশাপাশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ফলে দূষণের প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। তাই পদ্মা যেন দূষণমুক্ত থাকে সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। তাছাড়া পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে বিভিন্ন অনভিপ্রেত ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা গেল। এসব অনভিপ্রেত ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পদ্মা সেতু সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের জায়গা। এ সেতু নির্মাণে আমাদের অনেক বাধা, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সব বাধা পেরিয়ে, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অবশেষে আমরা সফল হয়েছি। এ সেতু আমার, আপনার, আমাদের সবার। আর এ সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও এর মর্যাদা রক্ষা আমাদের সবার দায়িত্ব।

লেখক: কলামিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন