বিজ্ঞাপন

‘৩টি ছড়া থেকে ২ বছরে ১০০ মণ ধান’

May 11, 2018 | 7:08 pm

।। জামাল হোসেন বাপ্পা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

বাগেরহাট: ২০১৬ সালের ঘটনা। বাগেরহাটের কৃষক লেবুয়াত শেখের মা ফাতেমা বেগম ধান কাটার মৌসুমে তাদের ধানকাটা শ্রমিকদের মাঠে পানি খাওয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে ধানের ক্ষেতের মধ্যে তিনি বেশ বড়সড় তিনটি ধানের ছড়া (শীষ) দেখতে পেয়ে সেগুলো তুলে নিয়ে বাড়িতে আসেন।

এরপর সেই ধানগুলো তিনি আলাদা করে চাষ করতে বলেন ছেলেকে। পরের বছর ২০১৭ সালে তার ছেলে লেবুয়াত শেখ এক শতক জমিতে সেই ধানের চাষ করে আড়াই কেজি ধান সংগ্রহ করেন। এর পরের বছর তিনি ওই আড়াই কেজি ধান ৭৫ শতক জমিতে চাষ করে ঘরে তোলেন প্রায় এক শ মণ ধান।

স্থানীয় কৃষি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ধানের গাছ, ফলন, পাতা, শীষ সবকিছু অন্য যে কোনো জাতের ধানের থেকে সম্পুর্ণ আলাদা। প্রতি গোছে একটি করে চারা রোপন করতে হয়। যা পরে ৮ থেকে ১২টি গাছে পরিণত হয়। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এক একটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৬ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি ছড়ায় ধান হয় ১ হাজার থেকে ১২ শ টি। যার ওজন ৩০ থেকে ৩৫ গ্রাম। ধান গাছের পাতা লম্বায় প্রায় ৮৮ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় দেড় ইঞ্চি, ফ্লাগলিপ (ছড়ার সাথের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, এই জাতের ধান গাছের কাণ্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখ গাছের মতো এবং অনেক বেশি শক্ত। একরপ্রতি ফলন প্রায় ১৩০ মণ। অন্য যেকোনো জাতের তুলনায় এই জাতের ধান একদম ব্যতিক্রম।

অপরদিকে আফতাব-৫ জাতের হাইব্রিড ধান প্রতি ছড়ায় ১৮০ থেকে ২৫০টি দানা হয়। এই ধানের বীজ প্রতিবারই বাজার থেকে কিনতে হয়। হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয় ৫ টন। একই জমিতে কৃষক লেবুয়াত উদ্ভাবিত জাতের ধানের উৎপাদন ১১ টন।

বিজ্ঞাপন

এই বিশেষ জাতের ধানের খবর ছড়িয়ে পড়ায় কৃষক লেবুয়াত শেখের বাড়ি ভিড় জমাচ্ছেন উৎসুক সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই ধানের খবর ছড়িয়ে পড়ায় অন্যান্য জেলার কৃষকরাও চেষ্টা করছে এই ধানের বীজ সংগ্রহ করার।

প্রতি কেজি ধান বীজ ৪ শ টাকা দরে অনেকে সংগ্রহ করেছেন। এখনও তার বাড়িতে শত শত কৃষক এই ধানের বীজ সংগ্রহ করতে ভিড় জমাচ্ছে। শুধু সাধারণ কৃষক নয় নতুন এই জাতের ধান নিয়ে উৎসুক বাগেরহাটের কৃষি বিভাগও।

মাত্র ৩ ছড়া (শীষ) ধান দুই বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ শ মণ। খোদ কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন এই জাতের ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিলে বদলে যাবে খাদ্য উৎপাদনের চিত্র।

কৃষি বিভাগের মতে, ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের চাকুলী গ্রামের একজন আদর্শ কৃষক লেবুয়াত শেখ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি দীর্ঘদিন ধান ও মাছের চাষ এবং মাছের ব্যবসা করেন। স্থানীয় বেতাগা বাজারে তার একটি মাছের আড়তও রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

লেবুয়াতের মা ফাতেমা বেগম বলেন, ‘দুই বছর আগে মাঠে ধান কাটতে থাকা কাজের লোকরা পানি চাইলে আমি পানি দিতে যাই। এ সময় ধানের ভিতর একটি বড় ধরনের ধানের বাইল (শীষ) পাই। তখন মনে করলাম এটি আবার কী ধান? একটু সামনে গিয়েই আরও দুটি বাইল (শীষ) পাই। এই ধানগুলো নিয়ে বাড়ি এসে ছেলেকে দিলে সে বলল, এটা আবার কী ধান ? এ দিয়ে আবার কী করতে হবে? তখন বললাম, আমি রাখবো এবং জমির এক কোণে ফেলে রাখবো। পরে একটি কাচের বোতলে এটি সংরক্ষণ করি। পরের বছর এই ধান থেকে ৩ আটি পতো (চারা) হয়। সেখান থেকে যে ধান হয় তা আবারও পরের বছরের জন্য বীজ হিসেবে রেখে দেই। সেখান থেকে আজ এতগুলো ধান হয়েছে।

কৃষক লেবুয়াত হোসেনের সঙ্গে তার মা ফাতেমা বেগম

চাকুলী গ্রামের কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান হাফিজ জানান, এই ধান নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। প্রতিটি ধানের শীষ ১৩ ধেতে ১৫ ইঞ্চি লম্বা, প্রতি শীষে ১ হাজার থেকে ১২ শ’টি ধান রয়েছে। যার ওজন ৩০ থেকে ৪০গ্রাম। যা দেশের অন্য কোনো স্থানে আছে বলে কারো কাছে শুনিনি। মাত্র ৩টি শীষ থেকে আজ ৭৫ শতক জমিতে এই ধানের চাষ করেছে লেবুয়াত। আর এই ভিন্ন জাতের ধান দেখতে প্রতিদিনই অনেক লোক বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে। এবং তারা ধান সংগ্রহের আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিনি সরকারিভাবে কৃষক লেবুয়াতের নামেই এই ধানের নামকরণের জন্য সবার কাছে দাবিও জানান।

স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোলায়মান আলী জানান, প্রথমে তারা লেবুয়াতের ধানের ক্ষেতে গিয়ে ধানের নমুনা দেখে অবাক হয়ে যান। বিষয়টি তিনি তাৎক্ষণিক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। পরে তার পরামর্শে লেবুয়াতকে হাতে কলমে ও সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হয়।

ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মোতাহার হোসেন জানান, প্রতিটি শীষে ১ হাজার থেকে ১২ শ দানা আছে। যা সাধারণ বিআর-২৮ জাতের ধানের থেকে প্রায় ৬ গুণ বেশি। সবচেয়ে বড়কথা হলো এটি ‘ফাইন রাইস’ প্রজাতির ধান। এই ধান ইতোমধ্যে অনেক বেশি সাড়া জাগিয়েছে।

বাগেরহাট জেলা বীজ প্রত্যায়ন কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান জানান, কৃষক পর্যায়ে উদ্ভাবিত এটি একটি নতুন জাতের ধান। এই ধান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালনো হচ্ছে। কৃষক পর্যায়ে যে এত উন্নত ধরনের ধান উদ্ভাবন হয়েছে তা স্থানীয়দের মাঝে চমক সৃষ্টি হয়েছে। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মাধ্যমে এটি ছাড় করানোর ব্যবস্থা করা হবে।

সারাবাংলা/এমআই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন