বিজ্ঞাপন

ছিনতাই শেষে নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট পরিকল্পনাকারীর

July 11, 2023 | 7:44 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে দিনে-দুপুরে ‘মারধরের নাটক সাজিয়ে’ ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করছে পুলিশ। এদের মধ্যে ছিনতাইয়ের মূল পরিকল্পনাকারী ও নেতৃত্বদাতা আছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। মূল পরিকল্পনাকারী ছিনতাইয়ের পর ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আহতদের রক্তাক্ত ছবিসহ ফেসবুকে দু’টি পোস্টও শেয়ার করেন।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ-যুবলীগের বিভিন্ন নেতার ছত্রছায়ায় থেকে বেপরোয়া এসব ছিনতাইকারী দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায় বলে জানা গেছে। সোমবার (১০ জুলাই) থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

রোববার দুপুরে নগরীর কোতোয়ালি থানার রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকার রয়েল প্লাজা’র সামনে নুর এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মচারী ছিনতাইয়ের শিকার হন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে যাওয়ার পথে মোরশেদ আলম ও ত্রিদিব বড়ুয়া নামে দুই কর্মচারীকে মারধরে গুরুতর জখম করে টাকাগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়। প্রথমে ছিনতাইকারীরা নিজেরা মারধর শুরু করে। তারপর কৌশলে সেই জটলার ভেতর দুই কর্মচারীকে ঢুকিয়ে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।

এ ঘটনায় ‍নুর এন্টারপ্রাইজের মালিক নুর মো. ইয়াছিন কবির বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার চারজন হলো- একরামুল আলম (৩৭), সাহেদ হোসেন মনা (২৪), মো. ইয়াছিন সাব্বির (২৪) ও রবিউল হোসেন (২৩)।

বিজ্ঞাপন

ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারের তথ্য জানাতে মঙ্গলবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে আসেন নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা, কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার অতনু ভট্টাচার্য এবং কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদুল কবীর ছিলেন।

উপ পুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনার পর আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে জড়িত চারজনকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে প্রথমে সাহেদ হোসেন মনাকে নগরীর রউফাবাদ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে ছিনতাইয়ের ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

মনা’র তথ্যানুযায়ী নগরীর মাদারবাড়ি এলাকা থেকে একরামুলকে গ্রেফতার করে তার কাছে ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। এর পর কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা সৈন্যেরটেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাব্বির ও রবিউলকে গ্রেফতার করা হয়।

বিজ্ঞাপন

মোস্তাফিজুর বলেন, ‘চারজনকে গ্রেফতার করা মোট ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। একই ঘটনায় আরও ৪/৫ জন জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ছিনতাইয়ের টাকার মধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা পলাতক ছিনতাইকারীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’

যেভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনা

পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, একরামুল আলম এই ছিনতাইয়ের মূল পরিকল্পনাকারী। রিয়াজউদ্দিন বাজারে একসময় তার ব্যাগের দোকান ছিল। দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি এখন রিয়াজউদ্দিন বাজারে ঘুরে ঘুরে পণ্য বেচা-কেনার মধ্যস্বত্ত্বভোগী হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘসময় ধরে রিয়াজউদ্দিন বাজারে অবস্থানের কারণে ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে তার সখ্যতা আছে। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের টাকা লেনদেনসহ অভ্যন্তরীণ অনেক তথ্য তার নখদর্পণে থাকে।

নুর এন্টারপ্রাইজের দুই কর্মচারী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়ার তথ্যটি জানতে পেরে একরামুল সাহেদ হোসেন মনা’র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা নিয়ে মনা ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে সেটি বাস্তবায়ন করেন।

বিজ্ঞাপন

ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার অভিযানে অংশ নেওয়া কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোমিনুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মনা পেশাদার ছিনতাইকারী দলের নেতা। আগেও তার বিরুদ্ধে সাতটি ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মামলা আছে। রউফাবাদ এলাকায় বাসা হলেও তার বিচরণ মূলত রিয়াজউদ্দিন বাজার, জামতল বস্তি, সিআরবি, গোয়ালপাড়া- এসব এলাকায়। একরামুল টাকা ব্যাংকে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে মনাকে দিয়ে সেই টাকা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে।’

‘দুই কর্মচারী টাকার ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে রয়েল প্লাজার সামনে আসে। একরামুলসহ ২-৩ জন তাদের আশপাশে ছিল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মনা ও তার গ্রুপের ৭-৮ জন ছিনতাইকারী মিলে হঠাৎ জটলা করে মারামারি শুরু করে। অতর্কিতে কর্মচারীদের ঘিরে তারা মারধর শুরু করে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, মারধরের এক পর্যায়ে টাকার ব্যাগ নিয়ে প্রথমে একজন দৌড়ে জলসা মার্কেটের দিকে চলে যায়। এর পর একে একে দৌড়ে অন্যরাও চলে যায়।’

এসআই মোমিনুল সারাবাংলাকে জানান, ছিনতাইয়ের পর একরামুলের সঙ্গে মনা ও তার সহযোগীদের বৈঠক হয়। সেখানে কিছু টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়। ছিনতাই করা ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার মধ্যে ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা একটি ব্যাগে ভরে একরামুল স্টেশন রোডে প্যারামাউন্ট সিটি হোটেলের রিসিপশনে রেখে দেয়। পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে হোটেলের রিসিপশনের কর্মীরা এ বিষয়ে অপরাগতা জানায়নি। একরামুলকে গ্রেফতারের পর তার তথ্যে হোটেল থেকে টাকাগুলো উদ্ধার করা হয়।

‘ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজে আমরা অদূরে দাঁড়ানো একরামুলকে দেখতে পাই। তার গতিবিধি আমাদের কাছে তখনই সন্দেহজনক মনে হয়। ফেসবুকে সে ছিনতাইয়ের পর নিন্দাসূচক দুটি পোস্টও শেয়ার করে। আমরা শুরু থেকেই তাকে নজরে রেখে তদন্ত শুরু করি। মনাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে একরামুলের পরিকল্পনায় ছিনতাইয়ের বিষয়টি আমাদের জানায়। এরপর আমরা তাকে গ্রেফতার করি’- বলেন এস আই মোমিনুল।

নেতাদের ‘আশ্রয়ে’ ছিনতাইকারীরা

রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী-কর্মচারী ও পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, একরামুল আলম ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ, বৃহত্তর রিয়াজউদ্দিন বাজার শাখা, চট্টগ্রাম’ নামে একটি নামসর্বস্ব সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। তার ফেসবুকের টাইমলাইনেও এই পরিচিতি আছে। এছাড়া নিজেকে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ‘যুব সংগঠক’ পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে পোস্টারও শেয়ার করেছেন তিনি। এতে একরামুল নিজেকে রয়েল প্লাজা’র সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও পরিচয় দিয়েছেন, যে মার্কেটের সামনে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের বিপরীতে সিডিএ মার্কেটের তিনতলায় ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদের’ কার্যালয়, যেখানে নিয়মিত একরামুল বসেন। মূলত সংগঠনটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একরামুল রিয়াজউদ্দিন বাজারে হুণ্ডি ব্যবসা, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের বিরোধকে ব্যবহার করে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে যুক্ত।

জানা গেছে, আক্তার মাস্টার নামে এক ব্যক্তি প্রথমে নামসর্বস্ব সংগঠনটি গড়ে তোলেন। তার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ ছিল। আক্তার মারা যাওয়ার পর সংগঠনটির নেতৃত্বে আসেন একরামুল। আক্তারের সঙ্গে নগরীর ওমরগণি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আলোচিত নেতা আইয়ূব আলীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। একরামুলের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা আছে।

রিয়াজউদ্দিন বাজারসংলগ্ন স্টেশন রোডে প্যারামাউন্ট সিটি হোটেলসংলগ্ন একই নামে একটি মার্কেট আছে। সেই মার্কেটে আইয়ূব আলীর একটি কার্যালয় আছে। সেই হোটেলের রিসিপশন থেকেই ছিনতাইয়ের টাকাগুলো উদ্ধার হয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আইয়ূব আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আক্তার মাস্টারের বাড়ি পটিয়া। আমার বাড়িও পটিয়া। সেজন্য আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। সে তো মারা গেছে। একরামুলকে আমি চিনি। তবে আমার সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই। যে হোটেল থেকে টাকা উদ্ধার হয়েছে, সেখানে আমার অফিস নেই। পাশের মার্কেটে অফিস আছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা আমি শুনেছি। তবে এসব বিষয়ে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

আইয়ূবের ছবি দিয়ে একরামুলের বিভিন্ন পোস্ট আছে ফেসবুকে তার টাইমলাইনে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইয়ূব আলী বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি। আমার ছবি কেউ দিতে পারে। তার মানে এই নয় যে, আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।’

এদিকে, গ্রেফতার সাহেদ হোসেন মনা যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া রিটু দাস বাবলু’র অনুসারী বলে জানা গেছে। সিআরবিতে জোড়া খুনে অভিযুক্ত রিটু দাসের কার্যালয় আছে নগরীর গোয়ালপাড়ায়। ফেসবুকে ‘মোহাম্মদ শাহেদ হোসেন মনা’ নামে সাহেদের টাইমলাইনে দেখা গেছে, তার কাঁধে রিটু দাসের হাত দেওয়া ছবি আছে প্রোফাইলে।

জানা গেছে, মনা একসময় নগরীর নন্দনকানন এলাকায় থাকতো। পরে সদরঘাটে চলে যায়। সেখান থেকে এখন রউফাবাদ এলাকায় থাকে। তবে সিআরবির পাশে গোয়ালপাড়ায় রিটু দাসের অফিস ঘিরেই মনা সক্রিয়।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন