বিজ্ঞাপন

পানি-খাবার সংকটে বানভাসী মানুষ, সাপ-ডাকাতের আতঙ্কও

August 10, 2023 | 9:32 pm

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বন্যাকবলিত চট্টগ্রামের তিন উপজেলার অধিকাংশ এলাকার ঘরবাড়ি-লোকালয় থেকে পানি নেমে গেছে। তবে মারাত্মক দুর্ভোগে দিন পার করছেন কয়েক লাখ মানুষ। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এসব দুর্ভোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাপ ও ডাকাত আতঙ্ক।

বিজ্ঞাপন

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর সড়ক-মহাসড়কে ক্ষয়ক্ষতির চিত্রও উঠে আসছে। বিস্তীর্ণ সড়কে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ, অনেক এলাকায় সড়কের একাংশ ভেঙে পড়েছে।

এক সপ্তাহ আগে ৩ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। দুইদিনের মাথায় সেটি অতি ভারি বর্ষণে পরিণত হয়।

টানা বৃষ্টির সঙ্গে অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার ও পাহাড়ি ঢল যুক্ত হয়ে বন্যা পরিস্থিতিতে রূপ নেয়। সাতকানিয়া ও চন্দনাইশে মহাসড়কে পানি উঠে যাওয়ায় কক্সবাজার ও বান্দরবানের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ গত দুইদিন বন্ধ ছিল। তবে বুধবার (৯ আগস্ট) রাত থেকে পানি নামতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কক্সবাজার-বান্দরবানের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে। একইসঙ্গে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ পানিবন্দি এলাকাগুলো থেকেও পানি সরতে শুরু করে।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের হিসেবে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলা ও নগরী মিলে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৫০৫ জন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া এবং বাঁশখালী উপজেলার একাংশ পানিতে তলিয়ে যায়। সাতকানিয়ায় সাড়ে ২২ হাজার পরিবার, চন্দনাইশে ৫ হাজার, পটিয়ায় ১৬ হাজার ৫৯৫ পরিবার এবং লোহাগাড়ায় ৪ হাজার পরিবার পানিবন্দী ছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা।

চন্দনাইশ উপজেলার সহকারী ভূমি কমিশনার জিমরান মোহাম্মদ সায়েক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বরমা, বরকল এবং বৈলতলি ছাড়া সব এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। তবে ফসলের ক্ষেত এখনও তলিয়ে আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে বা নিরাপদ অন্যান্য আশ্রয়ে যেসব লোকজন গিয়েছিলেন, তারা বাড়িতে ফিরছেন। সমস্যা হচ্ছে, পানিবন্দি থাকার কারণে অনেক কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক কিংবা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।’

বিজ্ঞাপন

‘সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির। উপজেলায় টিউবওয়েলগুলো বিকল হয়ে গেছে। পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর হয়ত সচল হবে কিংবা মেরামত করতে হবে। এর মধ্যে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সহায়তায় প্রত্যেক ইউনিয়নে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠিয়েছি। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি বিতরণের ব্যবস্থা করা যায় কি না সেটি আমরা দেখছি।’

সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাতকানিয়া সদর, এওচিয়া, কাঞ্চনা, ঢেমশা, সোনাকানিয়া থেকে পানি নেমে গেছে। সাতকানিয়া পৌরসভা, নলুয়া, চরতী, আমিলাইষ, কেওচিয়া এলাকায় এখনও পানি আছে। আমাদের এলাকায় এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি এবং খাবার। কোথাও খাবার পানি মিলছে না। টিউবওয়েলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। বিদ্যুতের অভাবে মোটর চালানো যাচ্ছে না।’

‘ঘরে ঘরে চাল, ডাল, খাবার কিছু নেই। পকেটে টাকা থাকলেও খাবার কেনা যাচ্ছে না। দোকানপাট-বাজারও তো পানিতে ডুবে ছিল। আবার কাঁচা ঘরবাড়িতে চুলা জ্বালানো যাচ্ছে না। মানুষ খুব কষ্টে আছে। সরকারিভাবে কিংবা ব্যক্তিপর্যায়ে খুব সীমিত ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, এটি একেবারেই অপ্রতুল।’

বিজ্ঞাপন

লোহাগাড়া উপজেলার সহকারী ভূমি কমিশনার মোহাম্মদ শাহজাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পানি পুরোপুরি নেমে গেছে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাবার-পানির সমস্যা বেশি হচ্ছে না।’

চন্দনাইশের দিয়াকুল, দোহাজারী ও সাতকানিয়ার ধর্মপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ নিয়ে ঘুরেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক জুয়েল আইচ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পানি অনেক এলাকায় কমে গেছে বা পুরোপুরি নেমে গেছে। কিন্তু বানভাসী মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বিশুদ্ধ পানি, খাবারের সংকট যেমন আছে, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লোকজনের মধ্যে এখন সাপ আর ডাকাতের আতঙ্ক ভর করেছে। পানির তোড়ে প্রচুর সাপ লোকালয়ে এসে গেছে।’

এদিকে বন্যাকবলিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে বোয়ালখালী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, পটিয়া, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর অধীনে। চট্টগ্রাম নগরী, চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী, সাতকানিয়া এবং বান্দরবানের বড় অংশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী জানিয়েছেন, বৃষ্টি কমে গিয়ে পানি সরতে শুরু করার পর দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ভেঙে পড়া খুঁটি ও বিদ্যুৎ লাইন মেরামত করা হয়েছে। বুধবার রাত থেকে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সাতকানিয়ার বিভিন্ন গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে।

দিলীপ চন্দ্র চৌধুরী আরও জানান, বুধবার রাত ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন ছিলেন। শঙ্খ নদে পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে পটিয়া ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে বুধবার পর্যন্ত ওই লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। গত পাঁচ দিনে পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি বিকল হয়েছে ১২১টি।

এ ছাড়া ২৭টি ট্রান্সফরমার, ৬৩টি ক্রস আর্ম, ৪৮টি ইনসুলেটর, ৫টি এসিআর নষ্ট হয়েছে। ৪৫২টি স্থানে বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী তার ছিঁড়ে গেছে। এতে প্রায় ৬০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া পানি উঠে যাওয়ায় দোহাজারী, সাতকানিয়া ও বোয়ালখালী উপকেন্দ্র এখনও চালু হয়নি।

পিডিবির চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, চন্দনাইশের দোহাজারী, সাতকানিয়া ও বান্দরবানে তাদের অধিকাংশ গ্রাহক বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। কিছু দুর্গম এলাকায় এখনও সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।

এদিকে পানি সরে যাওয়ার পর রাস্তাঘাটের খানাখন্দসহ বিধ্বস্ত অবস্থার চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের তথ্য সংগ্রহ করছেন। আগামী রোববার (১৩ আগস্ট) নাগাদ পূর্ণাঙ্গ তথ্য মন্ত্রণালয়ে সরবরাহ করা হবে।

সওজের চট্টগ্রামের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন সড়কে পাহাড় থেকে মাটি এসে পড়েছে। কয়েকটি সড়কের বিভিন্ন অংশ প্রায় বিধ্বস্ত হয়েছে। খালের সঙ্গে লাগোয়া সড়কগুলোর অনেকস্থানে একপাশ ভেঙে পড়েছে। কর্ণফুলী সেতুর (শাহ আমানত সেতু) সংযোগ সড়কে বড় বড় খানাখন্দ তৈরি হয়েছে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আজিজ আহমেদ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, নগরীতে ৫০ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সড়ক, ২ দশমিক ১৯৯ কিলোমিটার নর্দমা, ১ দশমিক ৯৯৩ কিলোমিটার ফুটপাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেরামতে ব্যয় হতে পারে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা।

একমাসের মধ্যে নগরীর সড়ক মেরামতের আশ্বাস দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরীর বহদ্দারহাটে ৩০০ পরিবারের মাঝে খাবার বিতরণের সময় মেয়র একথা বলেন।

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘পিচঢালা রাস্তার সবচেয়ে বড় শত্রু জমে থাকা পানি। প্রবল বর্ষণে নগরীর প্রচুর রাস্তার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরইমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। একমাসের মধ্যে মেরামত সম্পন্ন করা হবে।’

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন