বিজ্ঞাপন

মিয়ানমারের নাগরিকের সহায়তায় গড়ে ওঠে মানবপাচার চক্র

August 19, 2023 | 5:43 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন-যাপনের আশায় মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ২২ জন তরুণ ও যুবক। পরে তাদের কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ট্রলারযোগে মিয়ানমার নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে চক্রটি। মিয়ানমার থেকে ট্রলারে পাচারকালে ১৯ যুবককে মিয়ানমার কোস্টগার্ড আটক করে। বাকি তিন যুবক অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছে যায়। কিন্তু পাচারকারী চক্রের নির্মম নির্যাতিনে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পরও ভুক্তভোগী যুবক জহিরুল ইসলাম মারা যান। বাকি দুই যুবক অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় রয়েছে বলেও জানায় র‌্যাপিড আ্যকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

বিজ্ঞাপন

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ১৯ যুবককে মিয়ানমারে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি ও সেখানে বন্দিদশায় নির্যাতনের ফলে একজনের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী এ চক্রের বাংলাদেশের মূলহোতা মো. ইসমাইল ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

শুক্রবার (১৮ আগস্ট) দিনগত রাতে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় অভিযান চালিয়ে মূলহোতা ইসমাইলসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যরা হলেন- সহযোগী জসিম (৩৫) ও মো. এলাহী (৫০)।

শনিবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

বিজ্ঞাপন

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, চলতি বছরের ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ১৯ জন যুবক মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মিয়ানমার কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়। পরে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা গত ১০ জুলাই আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গিয়ে তাদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানান। এ ঘটনায় ১৫ এপ্রিল আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানায় একটি মানবপাচার আইনে মামলা (নম্বর- ২১/১৪৯) দায়ের করেন।

এ চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাচার হওয়া জহিরুল ইসলাম গত ২৪ মে মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। গত ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার মরদেহ দেশে নিয়ে আসা হয়। এই ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলে র‌্যাব এ মানবপাচার চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। পরে অভিযান চালিয়ে চক্রের মুলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি জানান, গ্রেফতার ইসমাইল গত ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থানকালীন মিয়ানমার আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে মিয়ানমারের রশিদুল ও জামালের সঙ্গে যোগসাজশে ১০ থেকে ১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে তোলেন। স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানবপাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে।

বিজ্ঞাপন

চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদের কোনো ধরনের অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আশ্বাস দেন। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পরে কাজ করে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ২২ জনকে পাচার করে। এরপর মিয়ানমারে তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করতে অমানবিক নির্যাতন চালায়।

তিনি আরও বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আদায় করা ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে গ্রেফতার ইসমাইল, জসিম ও আলম ৩০ হাজার টাকা করে টাকা করে নেন। চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার টাকা করে পেতো এবং বাকি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতেন চক্রের বাংলাদেশ অংশের মূলহোতা ইসমাইল।’

যেভাবে পাচার হয় ২২ তরুণ ও যুবক

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন যাপনের আশায় যেসব তরুণ ও যুবকরা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করতো, তাদের জসিম ও এলাহীসহ চক্রের অন্য সদস্যরা ইসমাইলের কাছে নিয়ে যেতো। তারপর তাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসযোগে কক্সবাজারের টেকনাফের মানবপাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের কাছে হস্তান্তর করা হতো।’

বিজ্ঞাপন

টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে তাদের ট্রলারযোগে মিয়ানমারে জামালের কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে মিয়ানমারের জামাল তার ক্যাম্পে ভুক্তভোগীদের রেখে নির্যাতন করে এবং তা ভিডিও করে গ্রেফতার ইসমাইলের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করত।

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিপণ দেওয়া না হলে ভুক্তভোগীদের নির্মমভাবে আরও বেশি নির্যাতন করা হতো। যেসব ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিতো, তাদের মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের কাছে পাঠিয়ে দেয়। গ্রেফতার ইসমাইল নিজের ও অন্যান্য সদস্যদের অংশের টাকা রেখে অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতো। পরে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুল ও মিয়ানমারে অবস্থানরত জামাল মুক্তিপণের টাকা তারা সমন্বয় করে ভাগ করে নিতো বলে জানা যায়।’

এদিকে, রশিদুল প্রায় ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে এবং প্রায় ২০ বছর ধরে মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, চক্রটি গত ১৯ মার্চ মোট ২২ জনকে ট্রলারযোগে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করার সময় মিয়ানমার উপকূলে পৌঁছালে মায়ানমার কোস্ট গার্ড ১৯ জনকে গ্রেফতার করে। বাকি ৩ জনকে এ চক্রের সদস্য মিয়ানমারের জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করতে থাকে। তাদের মধ্যে জহিরুলের পরিবারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে চক্রটি। পরে জহিরুলের পরিবার গত ১০ মে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দেয়। বাকি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর দেবে বলে জানায়। পরে ভুক্তভোগী জহিরুলকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়।

নির্যাতনের কারণে জহিরুল অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় এবং মৃত্যু সনদপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, পরে ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালয়েশিয়া সরকারের তত্ত্বাবধানে জহিরুলের মরদেহ বাংলাদেশে এনে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এছাড়া মিয়ানমার কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়া ১৯ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের কার্যক্রম নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চলমান রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

সারাবাংলা/ইউজে/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন