বিজ্ঞাপন

বিদেশি বিবৃতি ও ড. ইউনুসের ক্ষমতা দখলের `ভীমরতি’

August 29, 2023 | 2:30 pm

তাপস হালদার

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে পশ্চিমা একটি গোষ্ঠী বিভিন্ন ইস্যুতে ড. ইউনুসকে সামনে নিয়ে আসছে। যদিও এটি নতুন কিছু নয়, বিগত প্রায় দুই দশক ধরে এরকম চেষ্টা বহুবার হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নুন্যতম জনপ্রিয়তা না থাকার কারণে প্রতিবারই দেশিবিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

বিজ্ঞাপন

অতিসম্প্রতি ড. ইউনুসের পক্ষে হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চিঠি এবং তাকে হয়রানি করার প্রতিবাদে বিএনপিপন্থী ৩৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতি একই দিনে প্রকাশিত হওয়া গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে। দশ দিন আগের লেখা চিঠি প্রকাশ ও বিবৃতি একই সূত্রে গাঁথা। এরপর গত ২৭ আগস্ট শ্রম আদালতের মামলা স্থগিতের অনুরোধ জানিয়ে আরও ১৬০ জনের স্বাক্ষরিত খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। এসব কিছুই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। অনেকদিন ধরেই বিএনপিজামায়াত গোষ্ঠী সরকারের বিপক্ষে ড. ইউনুসকে ব্যবহার করছে। তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের সাময়িক টানাপোড়েনের ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়াচ্ছে ড. ইউনুস। গত মার্চে ৪০ জন বৈশ্বিক নেতা ড. ইউনুসকে হয়রানি না করার অনুরোধ করে বিবৃতি দেন। যখনই ড. ইউনুসের কোনো অনিয়মের তদন্ত হয় তখনই তিনি তার আন্তর্জাতিক বন্ধুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন।

. ইউনুসের অর্থ পাচার মামলা দুদক ও কর ফাঁকি এনবিআর তদন্ত করছে। এসব নিয়ে তার সৎসাহস থাকলে আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারতেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কিছু নেই।

. ইউনুসের বিরুদ্ধে বর্তমানে মানিলন্ডারিংয়ের মামলাসহ চারটি মামলা চলমান রয়েছে। অতিসম্প্রতি দান আয়কর মামলায় উচ্চ আদালতে পরাজিত হয়ে ১২ কোটি দানকর প্রদান করতে বাধ্য হয়েছে। শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দেওয়ানী ও ফৌজদারি দুইটি মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া গ্রামীন টেলিকমের ৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলছে। ড. ইউনুসের প্রতিটি মামলাই অনিয়মদুর্নীতি সংক্রান্ত। ২০২১ সালে ৯ সেপ্টেম্বর শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য ড. ইউনুস সহ আরও তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। কর ফাঁকি দিতে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বিপুল অর্থ গ্রামীণ কল্যাণ তহবিলে স্থানান্তর করেছেন। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দন্ডণীয় অপরাধ। তিনি আইনের সমস্ত সুবিধা ভোগ করে মামলা লড়ে যাচ্ছেন। এসব বিষয়ে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আইনের সাধারণ নিয়মেই বিচারকার্য চলছে। কিন্তু ড. ইউনুস নিজের অপরাধ গোপন রেখে বিদেশিদের কাছে তাকে হয়রানির অভিযোগে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

. ইউনুসের রাজনৈতিক ক্ষমতার খায়েশ নতুন নয়। যখনই দেশে সংকট তৈরি হয়, তখনই তার ক্ষমতায় যাওয়ার ভীমরতি জাগে। ২০০৭ সালে ১/১১ সরকার আসার পর রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা জানিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি জনগণের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লিখেন। সেখানে তিনি রাজনীতিতে নামার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং নিজের দলের নাম দেন নাগরিক শক্তি। চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার চাওয়া পাওয়ার আর অবশিষ্ট কিছু নেই। আমি জানি, রাজনীতিতে জড়িত হওয়া মানে বিতর্কিত হওয়া। আপনারা যদি মনে করেন, আমার রাজনীতিতে আসাটা দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ভালো হবে, তাহলে এ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছি। তখন এই দল গঠনের চেষ্টাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছে প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ কিছু গণমাধ্যম। প্রথম আলো লিখেছিল, ‘বিপুল সংখ্যক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ড. ইউনুস যদি যথার্থ গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে পারেন, তবে তা এদেশের রাজনীতিতে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ’ এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছিলেন, ‘একেবারে জনগণ থেকে বিছিন্ন একটা জায়গা থেকে জনগণকে ডাক দিয়ে কোন রকম রাজনৈতিক দল গড়ার কোন সার্থক ইতিহাস আমাদের জানা নেই।’

কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ড. ইউনুসের প্রত্যাশার বেলুন তিন মাসের মধ্যেই ফুটো হয়ে যায়। জনগণের সমর্থন না পেয়ে ৩ মে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন। এবং আরেকটি খোলা চিঠিতে লিখেন, যাদের সঙ্গে পেলে দল গঠন করে জনগণের সামনে সবল ও উজ্জ্বল বিকল্প রাখা সম্ভব হতো, তাদের আমি পাচ্ছি না। আর যারা রাজনৈতিক দলে আছেন তারা দল ছেড়ে আসবেন না। বাস্তবতা মেনে নিয়েই এ পথ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ড. ইউনুসের প্রত্যাশা ছিল তার ডাকে জনগণ ছুটে আসবে, দুই দল ভেঙে নেতারা চলে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি।

গ্রামীণ ব্যাংকটিকে তিনি পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিনত করেছিলেন। কোনও নিয়ম কানুনের ধার ধারতেন না। ২০১১ সালের মার্চে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের সিইও পদ থেকে পদত্যাগের অনুরোধ করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এই পদে অবসরের বয়স ৬০ বছর। কিন্তু তখন তার বয়স ৭০ বছরের বেশি। সরকার তাকে ইমেরিটাস উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার অনুরোধ জানায়, কিন্তু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায়ে তিনি হেরে যান। আদালতে হেরে যাওয়া এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। এরপর শ্রমিকরা তাদের ঠকানোর বিরুদ্ধে মামলা করলে প্রায় ৪৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে নিজেকে মামলা থেকে মুক্ত করেন। গত ১৭ জুলাই কর ফাঁকির মামলায় ১২ কোটি টাকা দিতে আদালত নির্দেশ দেয়। আদালতে প্রতিবারই হেরে যাচ্ছেন বলে এখন ভিন্নপন্থা গ্রহন করছেন।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ সরকারের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতিবাচক প্রচার করে যাচ্ছে ড. ইউনুস। অনেকের ধারণা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও তার হাত আছে। এর আগেও হিলারি ক্লিনটনের সাথে সম্পর্ককে কাছে লাগিয়ে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে বিশ্বব্যাংকের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।

. ইউনুস বিদেশিদের কাছে মানবতার প্রতীক হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার ভুমিকা রহস্যময়। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ, গার্মেন্টসের জিএসপি বাতিল, রোহিঙ্গা সংকটে একবারও কথা বলতে দেখা যায়নি। সিডর, আইলা, এমনকি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময়ও দেখতে পাওয়া যায়নি। সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নকালেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। দেশের দুর্যোগে, মানুষের দুর্গতিতে কখনো কি মানুষ তাকে পাশে পেয়েছে? তিনি শুধু নিজের স্বার্থ ও লাভ ছাড়া কখনও কিছু দেখেননি। তিনি সবসময় সুযোগের সন্ধানে থাকে। তাকে আন্তর্জাতিক ধান্দাবাজ, সুযোগসন্ধানী হিসেবে অভিহিত করা যায়।

. ইউনুসের দেশপ্রেম নিয়ে বিরাট প্রশ্ন আছে। তিনি কখনো মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য কখনো দেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে কখনো কথা বলেন নি। তিনি কখনো শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে দেখা যায়নি।

. ইউনুস যে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছবক দিচ্ছেন, বাংলাদেশে এর ভূমিকা কতটুকু? ক্ষুদ্র ঋণ বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের কাছে মৃত্যুফাঁদ। ক্ষুদ্র ঋণের উচ্চ সুদের কবলে অনেককেই নিঃস্ব হতে হয়েছে। এই ঋণ চক্রে একবার ঢুকলে কেউ আর বেরোতে পারে না। ড. ইউনুস যতদিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচালক (২ মার্চ, ২০১১) ছিলেন, সেসময় পর্যন্ত ঋণের কিস্তি শোধ করতে না পেরে ২৩৭ জন ঋণগ্রহীতা আত্মহত্যা করেন এবং ২ হাজার ৫২৮ জনকে জেলে যেতে হয়েছে। এরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ব্যক্তিদের ঘরের চালা, গরুছাগল নিয়ে এসেছে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় তিনি এড়াতে পারেন না।

বিজ্ঞাপন

বিদেশে প্রচার করা হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণের কারণেই বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে। কথাটা ডাহা মিথ্যে। বিগত পনের বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে। প্রকৃত সত্য হল, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের কল্যাণমূখী নানা কর্মসূচির কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের পথে বাংলাদেশ।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনার পারদ বইছে। একদিকে আওয়ামী লীগ সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে অনঢ়, অন্যদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের নামে সহিংস রাজনীতির পথে হাঁটছে। বেড়েছে কূটনীতিকদের আনাগোনা। এমন সময় আবার রাজনীতির মাঠে আবারও ড. ইউনুস জুজু। পশ্চিমা গোষ্ঠীরা বিএনপি মিশনে ব্যর্থ হয়ে এখন ড. ইউনুসকে সামনে আনতে চাইছে। এজন্যই তারা ইউনুসের পক্ষ্যে একএকটা বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে এদেশের কিছু সুশীলরা। আর ড. ইউনুসের ক্ষমতায় যাওয়ার ভিমরতি নতুন নয়। ২০০৬ সাল থেকেই তিনি এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কখনো সফল হননি। হয়তো ভবিষ্যতেও হবেন না। তবুও স্বপ্ন দেখতে দোষ কি!

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন