বিজ্ঞাপন

গরীবের ব্যাংকার থেকে কীভাবে ৫০ কোম্পানি মালিক হলেন ড. ইউনূস?

September 1, 2023 | 4:57 pm

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাকে নিয়ে চিঠি, টুইটার ফেসবুকে ঝড় তুলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশ বিদেশের হাজারো মানুষ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস খ্যাতি লাভ করেন ক্ষুদ্র ঋণ ধারণার প্রবর্তন করে। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অথচ এখন তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন গ্রামীণ নামধারী প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদের পরিমান দশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে একজন চাকুরিজীবী থেকে তিনি কিভাবে এই বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হলেন? কোথা থেকে আসলো এই মূলধন? ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সারাজীবনের আয়কর নথিতে কখনো কোন ব্যবসায়িক বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেননি। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এসব প্রতিষ্ঠান আসলে তৈরি হলো কিভাবে? কিংবা এসকল প্রতিষ্ঠান থেকে আসলেই দেশের কি উপকার হচ্ছে?

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণ ভূমিহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ঋণ বিতরণ পদ্ধতির আওতায় আনার উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্পের আওতায় ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমের সূচনা হয়। ১৯৭৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উক্ত প্রকল্পটিকে সহায়তা প্রদান করে। ৪ নভেম্বর ১৯৯৬ সালে ‘কোম্পানী আইন-১৯৯৪’ এর আওতায় ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মেমোরেন্ডাম অব আর্টিক্যাল অনুযায়ী গ্রামীণ কল্যাণে সর্বোচ্চ ২৫ জন সদস্য থাকবে এবং তন্মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক সর্বোচ্চ ১০ জনকে মনোনীত করতে পারবে। গ্রামীণ কল্যাণের আর্টিকেলস অফ এসোসিয়েশন ৩২ অনুচ্ছেদের ৩ নং ধারায় উল্লেখ করা হয় যে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা পরিষদের দুইজন সদস্য মনোনয়ন প্রদান করবে এবং ৪৮ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয় গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংক মনোনীত একজন ব্যক্তি।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে দাতাদের নিকট হতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাপ্ত অনুদানের ৩৪৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল SAF ফান্ডের ৪৪ দশমিক ২৫ কোটি টাকা গ্রামীণ কল্যাণে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে দাতা সংস্থা NORAD এর আপত্তির কারণে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৭ এবং ১ নভেম্বর ২০০৩ সালে দুই দফায় অনুদানের ৩৪৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরিয়ে আনা হলেও SAF ফান্ডের অর্থ ফেরত আনা হয়নি। উপরন্ত ১৯৯৬ সালের পর SAF এর আরো ২৫ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা গ্রামীণ কল্যাণকে দেয়া হয়। অর্থাৎ, গ্রামীণ ব্যাংক হতে গ্রামীণ কল্যাণে প্রদত্ত মোট অর্থের পরিমাণ ৬৯ দশমিক ৮২ কোটি টাকা।

গ্রামীণ ব্যাংকের ৪৬তম বোর্ড সভায় গ্রামীণ টেলিকমকে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ৩০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের জামিনদার হওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়াও ৫০ তম বোর্ড সভায় গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃক সোর্স ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (SEDF) হতে ১০ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক Keep Well Commitment এবং গ্রামীণ ফোন কর্তৃক IFC, CDC, ADB থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক SIDE Letter প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । এছাড়াও গ্রামীণ কল্যাণ গ্রামীণ ব্যাংকের SAF ফান্ড হতে প্রাপ্ত অর্থ হতে বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বমোট ৫৩ দশমিক ২৫ কোটি টাকা গ্রামীণ টেলিকমকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে, যে অর্থ দিয়ে গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ফোনের শেয়ার ক্রয় করে। গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ টেলিকমের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী গ্রামীণ কল্যাণ উক্ত বিনিয়োগের জন্য গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃক গ্রামীণ ফোন হতে প্রাপ্ত লভ্যাংশের ৪২ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রাপ্য হবে । ২০২২ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ কল্যাণকে ২ হাজার ২২২ কোটি টাকা লভ্যাংশ প্রদান করেছে। বর্তমানে গ্রামীণ কল্যাণের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা। উক্ত অর্থের মাঝে ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা এফডিআর এবং অবশিষ্ট অর্থ গ্রামীণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইকুইটি শেয়ার, ঋণ ও অনুদান হিসেবে রয়েছে। অতএব এটি অনস্বীকার্য যে, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ফোনের ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক যার মূল্য প্রায় ১৩ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। ২০০৩-২০২২ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ফোন হতে ১০ হাজার ৮৯০ কোটি ১৯ লক্ষ টাকা (প্রায়) লভ্যাংশ প্রাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে গ্রামীণ ফোনের শেয়ার ছাড়াও গ্রামীণ টেলিকমের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। উক্ত অর্থের মাঝে ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা এফডিআর হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে এবং ৩ হাজার ১৩ কোটি টাকা গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টকে ঋণ ও অনুদান হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। অবশিষ্ট অর্থ গ্রামীণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইকুইটি শেয়ার, ঋণ ও অনুদান এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ কল্যাণে গ্রামীণ ব্যাংকের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। যে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ দিয়ে এবং অনুমোদন নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই দুটো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন সেই গ্রামীণ ব্যাংকের কোন প্রতিনিধি নেই প্রতিষ্ঠান দুটোর পরিচালনা পরিষদে। গঠনতন্ত্রকে কাটাছেঁড়া করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউনূস এই প্রতিষ্ঠান দুটোর উপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন গ্রামীণ ব্যাংক তথা এই ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা লাখো প্রান্তিক মানুষজন। গরীবের রক্তচোষার এর থেকে ভাল উদাহরণ আর কিইবা হতে পারে?

এবার আসা যাক গ্রামীণ ব্যাংকের অন্য একটি ফান্ডের বিষয়ে। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে দাতাসংস্থাসমূহের অর্থায়নে ১৯৮৪ সালে Studies, Innovation, Development and Experimentation (SIDE) নামক একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। পরবর্তীতে উক্ত প্রকল্পের নামকরণ করা হয় Soccial Venture Capital Fund (SVCF)। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত NORAD, SIDA, CIDA, USAID Ges Ford Foundation কর্তৃক উক্ত প্রকল্পে সরবরাহকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯ দশমিক ১০ কোটি টাকা। ৭ অক্টোবর ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩১তম সভায় গ্রামীণ Soccial Venture Capital Fund (SVCF)-কে পৃথক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উক্ত সিদ্ধান্তের আলোকে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ‘গ্রামীণ ফান্ড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সংঘ স্মারক অনুমোদিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে SVCF ফান্ডের সকল কার্যক্রম গ্রামীণ ফান্ডের নিকট হস্তান্তর করা হবে। গ্রামীণ ফান্ডের আর্টিকেলস অফ এসোসিয়েশন অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদে দুইজন সদস্য মনোনয়ন প্রদান করবে এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংক হতে মনোনীত একজন ব্যক্তি। গ্রামীণ ফান্ড পরবর্তীতে গ্রামীণ সংশ্লিষ্ট ১৫টি প্রতিষ্ঠানে ইকুইটি ও ঋণ বাবদ অর্থ বিনিয়োগ করে।

এটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালিকানাধীন যত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার সবই মূলত গ্রামীণ ব্যাংকের দুটি ফান্ডের অর্থ দিয়ে তৈরি। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস সে গ্রামীণ ব্যাংককে এসকল প্রতিষ্ঠানের ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে না দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রম মূল্যায়নের লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ ১০ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম মনোয়ার উদ্দীন আহমেদকে চেয়ারম্যান করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে।

বিজ্ঞাপন

উপরের আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার যে, গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ড গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল হতে তৈরি এবং সুনিশ্চিতভাবেই উক্ত প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক গ্রামীণ ব্যাংক তথা প্রতিষ্ঠানটির সদস্যগণ (ঋণগ্রহীতা) এবং বাংলাদেশ সরকার। অপরদিকে, গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ব্যাংকের পরোক্ষ আর্থিক সহায়তায় তৈরি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে নিয়মবহির্ভূতভাবে গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ ফান্ড গঠন তাতে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ স্থানান্তর করেছেন এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে পরবর্তীতে আরো প্রায় ৫০টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। উক্ত সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের স্বার্থরক্ষিত হয়নি। গরীবের ব্যাংকার ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ কিভাবে দশ হাজার কোটি মূল্যের অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন। তিনি বার বার বলেন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হলো সকল ঋণগ্রহীতা। তাহলে সেই ঋণ গ্রহীতাদের ন্যায্য পাওনা থেকে কেন তাদের বঞ্চিত করছেন তিনি? তার বিদেশী বন্ধুগণ কি জানেন তার এই অপকর্মে কথা! এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে নিয়ে প্রতিনিয়ত যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটি কি তারই ধারাবাহিকতা?

লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন