বিজ্ঞাপন

তরুণ প্রজন্মের ক্যারিয়ার ও সরষের ভেতরে ভূত

September 9, 2023 | 8:33 pm

মুহম্মদ সজীব প্রধান

আমরা শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিনিয়ত পত্রিকায় লেখালেখি করছি, টকশোতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছি। কিন্তু আদৌ কি মূল সমস্যা বের করে ঝোপ বুঝে কোপ দিতে পেরেছি? আমরা ক্যারিয়ার গড়তে চাই আমাদের আলোকিত ও স্বপ্নীল ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু ক্যারিয়ারই যখন আমাদের আশার প্রদীপ নিভিয়ে দেয় তখন বিষয়টা সরষের ভিতরেই ভূত থাকার গল্প হয়ে যায়। টাইটানিক ডুবার পর মহাসমুদ্র সাতরে যাত্রীদের বেঁচে ফেরার চেষ্টার চেয়ে সদ্য স্নাতক শেষ করা একজন শিক্ষার্থীর একটি চাকরি পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচার লড়াই কোনো অংশে কম নয় । বাংলাদেশের প্রায় সমবয়সী এবং আয়তনে বাংলাদেশের চেয়েও ছোট দেশ সিঙ্গাপুর। দেশটি একসময় জেলেপল্লী নামে পরিচিত থাকলেও বর্তমানে অর্থনীতি, গবেষণা ও আবিষ্কারে বিশ্বকে চোখ রাঙানি দিচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত তো চাঁদ জয় করে এখন সূর্যের কথা ভাবছে। সিঙ্গাপুর, ভারত বা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের ঈর্ষণীয় সাফল্যের পিছনে রয়েছে তাদের সৃজনশীল তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীলতার শক্তি। কিন্তু কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ? তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কোথায়?

বিজ্ঞাপন

এক.
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে উন্নত দেশে তরুণ তরুণীরা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ক্যারিয়ার এবং উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুকছে। ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। এখানে তরুণ প্রজন্ম হাতেগুণা কয়েকটি সরকারী চাকরির পিছনে আদা জল খেয়ে ছুটছে। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম কি এমনে এমনেই সরকারী চাকরির পিছনে ছুটছে? অসংখ্য বিসিএস ক্যাডার রয়েছেন যারা ক্যাডার হতে চান নি। তাদের স্বপ্ন ছিলো গবেষক হওয়া, চাঁদ কিংবা মঙ্গলগ্রহের রহস্য উন্মোচন করা। মরণব্যাধি ক্যান্সারের চিকিৎসা আবিষ্কার করা। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পেরেছেন তাদের সেই স্বপ্ন আসলে দুঃস্বপ্ন তখনই তারা বাধ্য হয়ে বাংলা, ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞান মুখাস্ত করে রাতের পর পর বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করেছেন। মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, বাংলাদেশে বিসিএসের ছাকনির মাধ্যমে যেভাবে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, পদার্থ, রসায়নে পড়ুয়া তুখোড়ে মেধাবীদের ক্যাডার বানানো হচ্ছে ঠিক সেরকম একটা ছাকনির মাধ্যমে যদি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানী বানানো হতো এবং সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হতো তাহলে আমরা হয়তো ভারতের আগেই চাঁদ জয় করে মঙ্গল অভিমুখে রওনা হতে পারতাম।আমরা হয়তো এখানে বিসিএসের মতো প্রতি বছর আড়াই হাজার ক্যাডার পেতাম না কিন্তু ৫০ জন বিজ্ঞানী তো অনায়সেই পেতাম, তাইনা? আমাদের ক্যাডাররা অন্য দেশে যান আইটি প্রশিক্ষণ নিতে। তখন অন্য দেশের বিজ্ঞানীরা আমাদের দেশে আসতো বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের জন্য। এটা কল্পনা নয়, বাস্তব। সেজন্য চাই রাষ্ট্রের আন্তরিকতা। এমতাবস্থায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী যারা গবেষণায় আগ্রহী তারা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে যাকে মেধা পাচার বা ব্রেন ড্রেন বলে । মেধা পাচারকে আমি জাতির ভবিষ্যৎ পাচার বলি। কারণ, একটি দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্ভর করে ঐ দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও মেধার ওপর। আর আমাদের সেই প্রতিভা চলে যাচ্ছে বিদেশে! চীন ও ভারত থেকেও অনেক শিক্ষার্থী অন্য দেশে পড়াশোনা করতে যান। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হলে তাদেরকে আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এতে তাদের ব্রেন ড্রেনের বদলে ব্রেন গেইন হচ্ছে। অথচ আমরা সেটা করতে ব্যর্থ। আমাদেরকে এই বিষয়টা গভীর ভাবতে হবে।

দুই.
দেশে চাকরির অভাব নাকি দক্ষতার অভাব? এই বিষয়ে চাকরি দাতা এবং চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক সবসময়ই দেখা যায়। আমি ধরে নিলাম চাকরিপ্রার্থীদের দক্ষতার অভাব। এখন আমার কৌতুহলি মন জানতে যাচ্ছে এই দক্ষতার অভাবের দায় কি শুধু শিক্ষার্থীদের? যে দেশে ব্যবহারিক পরীক্ষায় সরাসরি ব্যাঙ কেটে এক্সপেরিমেন্ট করার বদলে খাতায় ব্যাঙের ছবি আঁকলেই পূর্ণ মার্ক পাওয়া যায় সেদেশে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার অভাব হবে, এটা কি স্বাভাবিক নয়? আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা স্মার্ট হচ্ছে? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এখনো আন্তর্জাতিক মানের না হলেও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং কর্পোরেট সেক্টরে জব করতে আমাদেরকে ঠিকই আন্তর্জাতিক মানের হতে হয়। চাকরির বাজারে রিসার্চ পেপার, কম্পিউটার স্কিল, কমিউনিকেশন হ্যাকস, টিম ওয়ার্ক, লিডারশীপ, ইউনিক আইডিয়া জেনারেট, প্রবলেম সলভিং এন্ড ইন্সট্যান্ট ডিসিশন মেকিং এবং ফিল্ড ওয়ার্ক এর স্কিল চাকরিদাতারা আমাদের মাঝে খুঁজে পাননা। ফলে শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, চীন এবং পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে কর্মী এসে মোটা অঙ্কের বেতন নিয়ে যান। অথচ আমাদের দেশের টাকা আমাদের পকেটে ঢুকার কথা। এর একটি বড় কারণ আমরা বাস্তবধর্মী প্রায়োগিক শিক্ষার দিকে নজর না দিয়ে বরং শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে চাপিয়ে দিচ্ছি অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয় গৎবাঁধা মুখাস্তবিদ্যা। এর ফলাফল এই যে, আন্তর্জাতিক জরিপে নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিং এ থাকে অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাঁই মিলেনা। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি এই বিষয়গুলো আসলেই ভাবেন?

তিন.
চাকরির কথা বাদ দিয়ে এবার উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলি। কখনো কি ভেবেছেন চীনের একজন ২৫ বছরের তরুণ এবং বাংলাদেশের একজন ২৫ বছরের তরুণের মধ্যে পার্থক্য কত বছর? আপাতত দৃষ্টিতে বয়সের কোনো পার্থক্য নাই। তবে চীনের একজন তরুণ ২৫ বছর বয়সে যা অর্জন করে বাংলাদেশের একজন সেগুলো ৫০ বছর বয়সে অর্জন করে। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে চীনের তরুণ প্রজন্ম চাকরি করার চেয়ে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের চাকরি দেওয়ার মতো কর্মক্ষেত্র তৈরিতে বেশি মনোযোগী। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যে একেবারেই উদ্যোক্তা হতে চান না সে কথা সত্য না। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হিসেবে শক্ত-পোক্ত অবস্থানে যেতে খুব বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা। এমতাবস্থায় একজন শিক্ষিত তরুণ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কিংবা বেসরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আশানুরূপ সহায়তাও পাচ্ছে না। ফলে সে কূল কিনারা না পেয়ে দুই বেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার পয়সা পেতে চাকরিতে ঢুকে। আর এজন্যই হয়তো আমাদের দেশে বিল গেটস, জ্যাক মা কিংবা ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তির জন্ম হয়না। তাছাড়া আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা নেই। ফলে ভিটেমাটি বিক্রি করে অনেকে উদ্যোক্তা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখতে পান না। তখন তো এই ছেলেটার পথে বসা ছাড়া আর কোনো পথ থাকলো না! আমরা সভা সেমিনারে চিৎকার করে বলি উদ্যোক্তা হও কিন্তু বাস্তবে উদ্যোক্তা হওয়ার কণ্টকাকীর্ণ পথ মসৃণ করতে সত্যি কি চেষ্টা করছি? বর্তমানে সরকার শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের দুর্দশা দূর করে দেশের অগ্রগতিতে তাদের অবদান নিশ্চিত করতে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যা প্রশংসনীয়। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে আরো বিচক্ষণতার সাথে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, যে তরুণ প্রজন্ম ১৯৭১ সালে পরাধীন দেশে শত্রুর বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে সে তরুণ প্রজন্ম স্বাধীন দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে ঈর্ষণীয় সাফল্যের মাইলফলক তৈরি করবে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন