September 18, 2023 | 2:29 pm
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যাদুকরী নেতৃত্বে অকুতোভয় বাঙালি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে লিখিত বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার, সুশাসন নিশ্চিতকরণ, মৌলিক নীতির বাস্তবায়ন ও মৌলিক অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তার বিধান রয়েছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকার সদা সচেষ্ট। দেশে অজস্র মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে মানবাধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ভাসানচরে শরণার্থী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। তাঁদের পুর্নাঙ্গ জীবন লাভের একটি সুযোগ করে দিয়েছে। এর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি শুধু এদেশের মধ্যে নয় সারা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করে বিশ্বব্যাপী তা প্রসংশিত হয়েছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমানে সরকারের একান্তপ্রচেষ্টার ফলে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৩। এ বছর ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ১২৯তম অবস্থানে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেত্রী শেখ হাসিনা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যেখানে বদ্ধপরিকর সেখানে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং তাদের ছায়ায় প্রতিপালিত আদিলুর রহমানেরা সবসময়ই দেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থেকে দেশের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে সবসময়ই অস্বাভাবিক করতে প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে। মানবাধিকারের নামে তাঁরা মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। আদিলুর রহমান একজন মানবাধিকার কর্মী হয়েও মানবাধিকারের বিষয়ে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছিল।
এই অধিকার কর্মী এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করা আদিলুর রহমান খান সবসময় গুজব ছাড়ানোয় পারদর্শী। এছাড়া তিনি যে সংগঠন চালান তাতে নানারকম অসচ্ছতার অভিযোগও রয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে হেফাজত কান্ডে ৬১টি জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থির করার চেষ্টা করেছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে ফায়দা লুটার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
বিগত ৫ মে, ২০১৩ সালে রাজধানী ঢাকাতে ভয়ঙ্কর তান্ডব চালিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম নামের এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। হেফাজতে ইসলামীর ব্যানারে ওই দিন রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এসে জড়ো হন শাপলা চত্বরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাবেশ থেকে শুরু হয় ভয়ঙ্কর তান্ডব। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল থেকে শুরু করে আশপাশের পল্টন, বায়তুল মোকাররম, প্রেস ক্লাব, গুলিস্তানসহ অন্যান্য এলাকায় শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও।
কিন্তু সমাবেশের সময় শেষ হওয়ার পরও হেফাজত কর্মীরা শাপলা চত্বর ছাড়ছিলেন না। তারা পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। এই সমাবেশে পিছন থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করে বিএনপি ও জামায়াতসহ চার দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। ইসলাম রক্ষার নামে হেফাজতে ইসলামীর এই সমাবেশের মূল লক্ষ্য ছিলো সরকারের পতন। সেই লক্ষ্যে দিনভর তান্ডব চালানোর পর রাতভর শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজত কর্মীরা। এই ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও বিএনপি-জামায়াতের নেতা এবং হেফাজতের নেতারা মিথ্যা প্রচার করতে শুরু করেন এই বলে যে, মতিঝিল চত্বর লাশে সয়লাব হয়ে গেছে। হাজার হাজার হেফাজত কর্মীকে আইনমৃঙ্খলাবাহিনী হত্যা করে লাশ গুম করেছে। তাদের এই অভিযোগের সঙ্গে সুর মিলিয়ে চরম মিথ্যাচার ও জালিয়াতি শুরু করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। যার নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির সম্পাদক আদিলুর রমান খান।
তার প্রতিবেদনে বলা হয়, শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকর্মীদের সরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে হেফাজতের ৬১টি জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। কোনো রকম তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই আদিলুর হেফাজতের পক্ষে একটা মনগড়া প্রতিবেদন তৈরি করে গুজব ছড়িয়ে দেন। তার এই গুজব ছড়ানোর কারণে ওই সময় দেশে-বিদেশে সরকারকে তীব সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়। যদিও সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি আদিলুর রহমান খান।
অধিকার সম্পাদক এই আদিলুর রহমান খান ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সুবিধাভোগী। জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। তার চোখেমুখে স্বপ্ন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট আবার ক্ষমতায় এলে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল পদ অলংকৃত করবেন। জোট সরকারের সুবিধাভোগী এই আইনজীবীই নিজেকে মানবাধিকারকর্মী পরিচয় দিয়ে বিএনপি জামায়াতের পক্ষে মাঠে নামেন মিথ্যা অপপ্রচার আর গুজব ছড়ানোর কাজে।
২০১৩ সালে ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ ভন্ডুলের যৌথ অভিযানে ৬১ জন নিহত হয় বলে দেশ-বিদেশে গুজব ছড়ায় আদিলুরের প্রতিষ্ঠান অধিকার। যদিও সেই রাতের অভিযানে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তদন্তেও সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
এমনকি পুলিশের দাবি, মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের সমাবেশে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ৬১ জন নিহত হওয়ার যে তালিকা প্রকাশ অধিকার করেছে, তা ছিলো সম্পূর্ণ অসত্য এবং বিকৃত। গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, রাতের ছবিকে তারা দিনের ছবি করেছে। বিভিন্ন জায়গায় মরদেহ দেখিয়েছে। তদন্তএসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অধিকার যে ৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে তা তদন্তেদেখা গিয়েছে যে, পাঁচজনের নাম দুই বার করে এসেছে। চারজন নারায়ণগঞ্জ এবং দুজন চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে পরের দিন গন্ডগোলে মারা গেছেন। একজন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। নাম আছে কিন্তু ঠিকানা নেই ১১ জনের। নাম এবং ঠিকানা ভুয়া সাত জনের। ১০ নম্বর ক্রমিকে কারও নাম উল্লেখ নেই। এছাড়া চারজন জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে কেউ জেলখানায়, কেউ মাদ্রাসায়, আবার কেউ চাকরি করছেন।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ৬১ জনের মধ্যে ৩৫ জনের নাম বাদ দিলে যে ২৬ জন থাকে, তাদের কেউই শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযানে মারা যাওয়ার কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর এ ২৬ জনের মধ্যে অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মী, অফিস কর্মচারী, পথচারী ও পরিবহন শ্রমিক রয়েছে।
এ তালিকার ১ নম্বরে সিদ্দিকুর রহমান নামে একজনের নাম উল্লেখ রয়েছে। অথচ সিদ্দিক পুলিশের রিক্যুজিশন করা গাড়ির চালক। ৫ মে দুপুরে বায়তুল মোকাররম এলাকায় হেফাজতে ইসলামের হামলায় মারা যান তিনি। অধিকারের প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করা হয়নি।
তাছাড়া ৫ মে হেফাজতে ইসলামের হামলার শিকার হয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা মারা গেলেও অধিকারের তালিকায় তার নাম নেই। অধিকারের প্রতিবেদন ছিল একপেশে। কেননা হেফাজত কর্মীরা ৫ মে দিনব্যাপী যে তান্ডব চালিয়েছে, প্রতিবেদনে তার কোনো বর্ণনাও ছিল না। আদিলুরের সংগঠন ‘অধিকার’ এর বিরুদ্ধের আর্থিক অনিয়ম, তথ্য দিয়ে সহযোগিতা না-করা ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করায় সম্প্রতি এনজিও ব্যুরো সংস্থাটির নিবন্ধন বাতিল করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক এই আদিলুর রহমান খান মূলত টাকা খেয়ে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে বাংলাদেশে মানবাধিকারের বিষয়ে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে বিদেশিদের বিভ্রান্তকরেছিলেন। আদিলুর রহমান হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে মৃত্যু নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন। কিছু সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, কিছু লবিস্ট এবং বিএনপি-জামায়াত ধর্মান্ধদের টাকা খেয়ে তিনি( আদিলুর রহমান) মিথ্যা রিপোর্ট দেন। তার মানে ২০১৩ সালে হেফাজতের ঢাকা-তান্ডবের পর তাঁদের রাতের আঁধারে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। বড় ধরনের ঘটনা ছাড়াই তাদের সরাতে সক্ষম হয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো। এরপর কথিত মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর আদিলুর রহমান খান শুভ্র মৃতের সংখ্যা নিয়ে যে বিভ্রান্তিমূলক এবং কপট মিথ্যাচারের প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়েছিলেন এই দশ বছরেও মৃতের সেই সংখ্যার প্রমাণ মেলেনি। কোনো পরিবার দাবি করেনি তাদের কাউকে পাওয়া না যাওয়ার কথা।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং সকলের জন্য আইনের কার্যকারিতা সমানভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ছত্রছায়ায় পালিত আদিলুর রহমান খানের মতো এমন অনেক মানবাধিকার কর্মী বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকরছে। তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। কারণ এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এভাবে তারা বিদেশেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে।
বাংলাদেশের আইনে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিছড়ানোর অভিযোগে করা মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের দুই বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে, যা অনাদায়ে আরও ১ মাসের কারাদন্ড হবে। এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের এই সোনার বাংলায় এমন মিথ্যাচারী, ষড়যন্ত্রকারী এবং অসাধু আদিলুর রহমান খানের কোনো ঠাঁই হতে পারেনা। বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে উপযুক্ত সাজা দিয়ে মানবাধিকার সংঘটকের নামে মিথ্যাচারী আদিলুর রহমানদের উপড়ে ফেলে দিতে হবে। এতেই বেঁচে যাবে আমাদের এই বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষ। বিশ্ব মানচিত্রে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অবস্থান ধরে রেখে বাংলাদেশের জনসাধারণের শান্তিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সদা সচেষ্ট থাকবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই