বিজ্ঞাপন

খোঁজ নেই বিএনপির, আ.লীগ-জাপার ভরসা রাঙ্গাঁ!

September 19, 2023 | 9:59 pm

রাব্বী হাসান সবুজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রংপুর: আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই উত্তরের জেলা রংপুরের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

তবে এক সময়ের প্রচলিত বাণী ‘রংপুরের মাটি, জাতীয় পার্টির ঘাঁটি’ এবং ‘রংপুরের রাজনীতিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদই যে শেষ কথা’- বাস্তবে এখন আর এমন নেই। আগে রংপুর জেলার সবক’টি আসনই জাতীয় পার্টির দখলে থাকতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র আর নেই। ছয়টি আসনের মধ্যে টানা মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে জেলার চারটি আসন। বাকি দুটি আসনও নিজেদের দখলে নিতে দীর্ঘদিন থেকেই তৎপর সরকারি দলটি। কিন্তু মহাজোটের শরিক হওয়ায় বার বার রংপুরের এই দু’টি আসন ছেড়ে দিতে হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে। তবে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলটিতে দ্বন্দ্বের সুযোগকে এবার কাজে লাগিয়ে আসন দু’টি দখলে নিতে চায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তেমন কোনো তৎপরতা নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসনের চিত্র।

গঙ্গাচড়া উপজেলা এবং রংপুর সিটি করপোরেশনের ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে রংপুর-১ আসন গঠিত। তিস্তা নদীবেষ্টিত এই আসনটি দীর্ঘদিন ধরে ভাঙন কবলিত। তিস্তার করাল গ্রাসে বছরের বিভিন্ন সময় যুদ্ধ চলে টিকে থাকার। এলাকাবাসীর দাবি, রংপুরের অন্যান্য আসনের চেয়ে এই আসনটি সবসময়ই উন্নয়ন বঞ্চিত। তবে এই আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর দাবি, তিনি তার নির্বাচনি আসনে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন।

১৯৮৬ সাল থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাই এই আসনটিতে জয়লাভ করে আসছে। ১৯৮৬ সালে ময়েন উদ্দিন সরকার, ১৯৯১ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (উপনির্বাচনে করিম উদ্দিন ভরসা), ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু, ২০০১ সালে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, ২০০৮ সালে এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আবার মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ জয়লাভ করেন। তাই আসনটি ধরে রাখতে জাপা ঐক্যবদ্ধ বলে জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

এই আসনটি নিয়ে কথা উঠলে সবার আগে আসতো জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম। আর এখন প্রথমেই আসে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর নাম। এখনো এই আসনে রাঙ্গাঁ-ই শেষ কথা বলে চাউর আছে। তবে রাঙ্গাঁ আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনের আগে তিনি ক্ষমতাসীন দলটিতে যোগ দিতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার পর থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। গত ২ আগস্ট আওয়ামী লীগের বিভাগীয় মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে স্থানীয় এমপি হিসেবে রাঙ্গাঁর ছাপানো ব্যানার-পোস্টার সেই গুঞ্জনকে পোক্ত করেছে। তবে রাঙ্গাঁর দাবি, আওয়ামী লীগ থেকে এমন কোনো প্রস্তাব তিনি পাননি। এমনকি দলটিতে যোগদানের গুঞ্জন সত্যি নয়।

এদিকে, আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলেছ, নির্বাচনের আগে রাঙ্গাঁ আওয়ামী লীগে যোগ দিলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নৌকার মনোনয়ন পেয়ে যেতে পারেন। আর জাতীয় পার্টির একটি সূত্র বলছে, নির্বাচনের আগেই রাঙ্গাঁকে ফের জাতীয় পার্টিতে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। যদি তিনি নিজ দলে ফিরে যান তাহলে ফের গঙ্গাচড়া আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন- এমনটাই জানিয়েছেন তার সমর্থকরা। তবে তার মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে রয়েছে সংশয়। এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই জাপাকে দলীয় জটিল ইস্যুর মুখোমুখি হতে হবে।

এসব নিয়ে জানতে চাইলে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমার নির্বাচনি এলাকা (রংপুর-১ আসন) গঙ্গাচড়ায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সেখান থেকে মঙ্গা চিরদিনের জন্য বিতাড়িত করেছেন। সেজন্য গঙ্গাচড়াবাসী তার প্রতি কৃতজ্ঞ। এ কারণে তাকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন টাঙিয়েছিলাম। এর বাইরে অন্য কিছু নয়।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যোগ দেওয়ার কোনো প্রস্তাব আমাকে দেওয়া হয়নি। আমি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’ আপনি তো জাপা থেকে বহিষ্কৃত, তাহলে আগামী নির্বাচনে কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ কৌশলে উত্তর দেন, ‘সেটা সময় বলে দেবে।’

রাঙ্গাঁপন্থী হিসেবে পরিচিত গঙ্গাচড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রাঙ্গাঁ লাঙ্গল নিয়ে রংপুর-১ আসনে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। তাকে ছাড়া গঙ্গাচড়ায় আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দের তালিকায় থাকায় আগামী নির্বাচনে তাকেই এমপি হিসেবে দেখা যাবে।’

অপরদিকে, নির্বাচনের বিষয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে আভাস পেয়েছি। সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।’

এদিকে, মহাজোটের সমীকরণের কারণে তৈরি হওয়া ‘লাঙ্গলের ঘাঁটি’ ভাঙতে তৎপর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। নিজেকে যোগ্য প্রমাণে দীর্ঘ দিন থেকেই ব্যস্ত সময় পার করছেন কেউ কেউ। তবে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে এবারও আসন ছেড়ে দিতে হবে জোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে- এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে স্বস্তি ও অস্বস্তি দুটোই আছে। তবুও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। যেকোনো মূল্যে আসনটি পেতে চায় তারা। নেতাদের দাবি, জাতীয় পার্টি নয়, এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে রাখতে হবে এই আসনে। সরকারি দলের এমপি ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটি যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল আমিন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু। তবে এ আসনে নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপিকে নিয়ে তেমন আলোচনা নেই।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দলীয় সভানেত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, যদি রংপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেন, তাহলে আমাকেই দেবেন।’

আওয়ামী লীগের আরেক প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। নির্বাচনের জন্য দল থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি। তাই আর নির্বাচন করতে পারিনি। এবার এ আসনের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা আমার হাতে নৌকার মনোনয়ন তুলে দেবেন বলে আশাবাদী।’

স্থানীয়দের তথ্য মতে, আগে এই আসনটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে ভোটে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো জামায়াতে ইসলামীর। আওয়ামী লীগ সব সময় তৃতীয় অবস্থানে থাকতো। তবে নিবন্ধন বাতিল হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এখানে আর আগের মতো অবস্থান নেই জামায়াতের। বর্তমানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরে ফের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। এখন এই আসনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে লড়াই করার মতো অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

অন্যদিকে, বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জেলার সহ-সভাপতি ওয়াহেদুজ্জামান মাবু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোকাররম হোসেন সুজনের নাম শোনা গেলেও তেমন কোনো প্রচারণা নেই তাদের। তবে তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়নে কোনো ঝামেলা হবে না। দ্রুতই তারা প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবেন। সেরকম প্রস্তুতি তাদের রয়েছে।

রংপুর-১ আসনে মোট ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার ৩৭৪ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪২৯ জন পুরুষ, ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৪৪ জন নারী ও ১ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে জয়লাভ করেন হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। তিনি ভোট পান ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৯টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর আব্দুল গণী পান ২৮ হাজার ২৭০ ভোট। ২০১৪ সালের ১০ জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি জয় লাভ করেন। সেই নির্বাচনে রাঙ্গাঁ লাঙ্গল প্রতীকে পান ১ লাখ ৯৮ হাজার ৯১৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মো. শাহ্ রহমত উল্লাহ্ পান ১৯ হাজার ৪৯৩ ভোট।

সারাবাংলা/আরএইচএস/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন