বিজ্ঞাপন

আশ্বিনে ‘শ্রাবণের ঢল’, বৃষ্টিতে ‘জলে আবদ্ধ’ ঢাকা

September 22, 2023 | 1:58 am

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বর্ষপঞ্জির পাতা থেকে বিদায় নিয়েছে শ্রাবণ মাস, সে হিসাবে বর্ষাকালও। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার দেখাও মিলছে। তবু মাঝে মাঝেই গোমড়া হয়ে উঠছে আকাশ। দেশের এখানে-ওখানে বৃষ্টি ঝরছে হরহামেশাতেই। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীতে ঘণ্টা তিনেক যে বৃষ্টি হয়েছে, তা মনে করিয়ে দিল শ্রাবণের ভারী ও টানা বর্ষণের কথা। সে বৃষ্টিতেই ডুবে গেছে রাজধানী ঢাকা।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার ছিল সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস। পরদিন সাপ্তাহিক ছুটি। সেই আমেজ নিয়ে রাজধানীবাসী যাদের বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়েছে, তারাই আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহের এই ‘শ্রাবণের ঢলে’ পড়েছেন বিপাকে। দেড়-দুই-তিন ঘণ্টা করে আটকে থাকতে হয়েছে অফিস, দোকানপাট, বাজারঘাটে। যতক্ষণে বৃষ্টির হাত থেকে নিস্তার পেয়েছেন, ততক্ষণে তলিয়ে গেছে ঢাকার রাস্তাঘাট। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও তা কোমড় ছুঁই ছুঁই। ঢাকার রাজপথ যেন ‘রাজ নৌ পথ’, তাতে গাড়িতে চড়েও মিলেছে নৌ পথে ভ্রমণের অনুভূতি।

বৃহস্পতিবার সারাদিনই ঢাকার আকাশ ছিল চঞ্চল। কখনো রোদ, কখনো মেঘ। এর মধ্যে দুপুর আড়াইটার দিকে বেশ খানিকটা বৃষ্টি বাগড়া দেয় বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে। সেই ম্যাচ আবার ফিরেছিল মাঠে। তবে সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাতেও না থামলে সে বৃষ্টি ম্যাচ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিপাকে ফেলে যায় ঢাকার অফিস-ফিরতি কর্মজীবীসহ শ্রমজীবীদেরও।

আজিমপুরের সড়ক পানির নিচে। ছবি: সোহেল রানা

সন্ধ্যার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত ‘শ্রাবণের ধারা’য় পরিণত হয় রাত ৮টা নাগাদ। মুষলধারে বৃষ্টি চলে টানা প্রায় আড়াই ঘণ্টা। এরপরও থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েছে রাত ১২টাতেও। ততক্ষণে গ্রিন রোড, কাঠালবাগান, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল, উত্তর ধানমন্ডি, আসাদ গেট, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, পলাশীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থল পথ পরিণত হয়েছে ‘পানি পথে’।

বিজ্ঞাপন

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানালেন, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীতে বৃষ্টি হয়েছে ১১৩ মিলিমিটার। রাতে আর বৃষ্টির খুব একটা সম্ভাবনা বা আশঙ্কা না থাকলেও শুক্রবারও বৃষ্টি হতে পারে ঢাকায়।

মিরপুরের সব সড়কের চিত্র প্রায় এমনই। শামীম হোসাইন শিশিরের ফেসবুক থেকে

মিরপুরে শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ড্রেনেজ সিস্টেম তথা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সেরা। ফলে বৃষ্টি থামলে আর সময় থাকলে খুব দ্রুতই শেরেবাংলার ক্রিজে ফেরেন ব্যাটাররা, আউটফিল্ডে ফিল্ডিং দল। কিন্তু রাজধানী ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেম সে মানের নয় বলেই বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে ১২টা পেরিয়ে সাড়ে ১২টা পর্যন্তও নীলক্ষেত, আজিমপুর, গ্রিন রোড, ধানমন্ডি, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কগুলো ছিল পানির নিচে। পথচারীরা এসব সড়কে চলাচলে পড়েছেন ভোগান্তিতে। যানবাহন নিয়েও পথ অতিক্রম করা হয়ে পড়েছে দুরূহ।

প্রতিবছরই ঝড়-জলের মৌসুমে রাজধানীবাসীর জলে আবদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ হতে থাকলেও সেই ‘বন্ধন’ থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে না দুই সিটি করপোরেশন। এ বছরও ভারী বৃষ্টি হলেই কিছু সময়ের জন্য হলেও ডুবে গেছে ঢাকা। বৃহস্পতিবার রাতে আরেকবার হলো সে অভিজ্ঞতা। যে যেখানে আটকা পড়েছিলেন, বৃষ্টির অবিরাম ও ক্লান্তিহীন রূপ দেখে একসময় ভিজেপুড়েই বেরিয়ে গেছেন বাসার পথে অথবা ভিন্ন কোনো গন্তব্যে।

বিজ্ঞাপন

শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের সড়কও পানির নিচে। ছবি: প্রতীক মাহমুদ

স্বাভাবিকভাবেই এমন বৃষ্টিতে ‘ভিজে গেছে’ যাপনের অন্যতম অংশে পরিণত হওয়া ফেসবুকও। তাতে ঘুরেফিরে একটি কথা বারবারই এসেছে— ‘ঢাকায় এমন বৃষ্টি কখনো দেখিনি’। এর সঙ্গে কেউ কেউ দিয়েছেন নিজ নিজ এলাকার ছবি। কেউ কেউ যুক্ত করেছেন ভিডিও।

বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম শুভ্র যেন একটি ভিডিও যুক্ত করে ক্যাপশন দিয়েছেন— ‘আমাদের বাসার নিজস্ব জলপ্রপাত’। ভিজেপুড়ে ঘরে ফেরার পর আবু হাসান লিখেছেন, ‘ভয়ংকর দুর্যোগ পেরিয়ে বাসায় ফিরলাম। দুই ভাই একসঙ্গে অফিস থেকে বাইকে ফিরি, আজ দুর্যোগেও একসঙ্গে হাঁটুপানি ডিঙিয়ে ফিরলাম। পছন্দের জুতা জোড়ার জন্য কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলেও বাসায় ফিরে স্বস্তি।’

ঢাকার অন্য এলাকার মতো একই অবস্থা ছিল শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণিতেও। ছবি: রাজনীন ফারজানা

শামীম হোসাইন শিশির গণমাধ্যমকর্মী, বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড সিরিজ কাভার করতে ছিলেন শেরেবাংলায়। তিনি লিখেছেন, “প্রথমে মিরপুর-১০ হয়ে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া দিয়ে মহাখালী যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম। কিন্তু মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর পার হতে উল্টো দিকে ঘুরতে হলো। কারণ রাস্তায় কোমড় সমান পানি। এত পানিতে বাইক ঠেলে নেওয়া সম্ভব না। দ্বিতীয় চেষ্টা— ভাবলাম মিরপুর-১১ দিয়ে কালশী হয়ে বনানী দিয়ে বের হব। কিন্তু মিরপুর-১১ পার হতেও দেখি কোমড় সমান পানি। তৃতীয় চেষ্টা— মিরপুর-১ হয়ে বাংলা কলেজ দিয়ে কল্যাণপুর হয়ে বের হতে চাইলাম। কিন্তু মিরপুর-১ পর্যন্তই যেতে পারলাম না। চতুর্থ চেষ্টা— ভাবলাম ৬০ ফিট দিয়ে আগারগাঁও হয়ে বের হব। কিন্তু সামনে যেতেই রিকশাওয়ালা মামা ডেকে বললেন, ‘মামা যাইয়েন না, সামনে এক গলা পানি!’”

পান্থপথ, গ্রিন রোড এলাকার বাসিন্দারাও সড়ক-অলিগলির ছবি শেয়ার করেছেন। জানাচ্ছেন, হাসপাতাল-অধ্যুষিত ওই এলাকায় রোগী এবং তাদের স্বজনদের পোহাতে হচ্ছে চূড়ান্ত দুর্ভোগ। তারা না পাচ্ছেন কোনো ধরনের যানবাহন, না পারছেন পায়ে হেঁটে বের হতে।

বিজ্ঞাপন

লেগুনা থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোটা ছোঁয়ার চেষ্টা। নাহিদ জিহানের ফেসবুক থেকে নেওয়া

তবে যত দুর্ভোগই হোক, মানবজীবন তো থেমে থাকার নয়। তাই বৃষ্টিবিলাসেরও কমতি নেই ফেসবুকের দেয়ালে। কেউ প্রিয় মানুষটির সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছেন রোমান্টিকতার বহির্প্রকাশে, কেউ হয়তো বাধ্য হয়েই। কোনো কোনো বাসায় ছড়াচ্ছে খিচুড়ির সুঘ্রাণ। বৃষ্টি নিয়ে কাব্য আর গানও দোলা দিয়ে যাচ্ছে ভাবালু মনগুলোকে। প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে জীবনকে উপভোগের এই মন্ত্রই তো মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ঠিক যেমন এই বৃষ্টিজল পেরিয়ে ঘরে ফেরার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেও উপভোগের উপকরণ খুঁজে নিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী নাহিদ জিহান। নিজের মোবাইলে তোলা ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আজ ছিল বৃহস্পতিবার, রাস্তা মানুষ আর গাড়ি দিয়ে বোঝাই! অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি বাংলামোটরে প্রকাণ্ড জ্যাম। হাঁটা শুরু করলাম। ঠিক ২ দশমিক ৬ কিলোমিটার হেঁটে যখন খামারবাড়ি পৌঁছালাম, তখন গাড়ি-বাস হালকা চালে চলতে শুরু করল। আর খামারবাড়ি এসে দেখি লেগুনার জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন! আর সে সময় নামল ঝুম বৃষ্টি। লেগুনা আসতেই লাইন ভেঙে পরিমড়ি করে উঠলাম। কিন্তু হায়! দুই কদম পেরিয়ে আবার সেই জ্যামে থেমে থাকল আধ ঘণ্টা! মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আমি ছবি তুলতে যাব, তখন একজন হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির স্পর্শ নিলেন, সেটাই capture হলো। খিচড়ে থাকা মেজাজটা মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। যেখানে, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, উপভোগের মনটা থাকা চাই। তাই তখন এফএম রেডিও ছেড়ে হেডফোন কানে গুজলাম।’

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন