বিজ্ঞাপন

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা: আইন ও বাস্তবতা

September 26, 2023 | 3:40 pm

বিভুরঞ্জন সরকার

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও বিদেশে চিকিৎসার দাবি কোনো নতুন বিষয় নয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই গুরুতর অসুস্থ। উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর দাবি এর আগে বিএনপির পক্ষ থেকে ও বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি তিনি আবার নতুন করে অসুস্থ হওয়ায় আবার তার মুক্তির বিষয়টি সামনে এসেছে এবং এ নিয়ে কিছু খবরাখবরও সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখযোগ্য যে, দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন। করোনা মহামারি শুরু হলে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ সাজা স্থগিত করে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ওই সিদ্ধান্ত নেয়। সে আবেদনে আইনের ধারা উল্লেখ না থাকলেও আইনগত দিক খতিয়ে দেখে সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার উপধারা-১ এর বিধান প্রয়োগ করে দণ্ড স্থগিত ও মুক্তির ওই সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর দফায় দফায় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ৭৮ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী লিভার, ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট তাকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ডের অধীনে চিকিৎসাধীন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে আইনের অবস্থান থেকে সরকারের কিছু করার নেই। বিদেশে যেতে হলে তার শর্তযুক্ত মুক্তি বাতিল করে পূর্বের অবস্থানে অর্থাৎ পুনরায় কারাগারে যেতে হবে। এরপর আবেদন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দণ্ড শর্তযুক্তভাবে স্থগিত করা হয়। পরিবর্তন করতে হলে খালেদা জিয়ার শর্তযুক্ত মুক্তি বাতিল করে সহাবস্থান আনতে হবে। এরপর অন্য বিবেচনা করা যাবে। তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে আইনের অবস্থান থেকে সরকারের আর কিছু করার নেই।

সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে আইনের শাসন আছে। আমরা আদালতের রায়কে শ্রদ্ধা করি। আদালতের রায় আছে। আদালত তাকে শাস্তি দিয়েছে। ৪০১ ধারায় তাকে শর্তযুক্ত যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা সরকারের নির্বাহী আদেশ দেওয়া হয়েছে। তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করেই এবং শর্তযুক্তভাবেই যে, শর্ত তিনি মেনেছেন। জাতিসংঘের কথা বলা হচ্ছে। একটা কথা জাতিসংঘে বলা আছে। সেটা হচ্ছে, আমাদের দেশের আইনটা অগ্রাধিকার পাবে এবং সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের আইনে যে অবস্থান তাকে ৪০১ ধারায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আমি বহুবার বলেছি, এ আইনের অবস্থায় এটার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আবেদন করা হলে আমরা আইনি মতামতের জন্য সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। আইন মন্ত্রণালয় যদি মনে করে সেটি আদালতে পাঠানো দরকার, তাহলে পাঠাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবারই তারা আবেদন করেন, আমরা যতটুকু মঞ্জুর করতে পারি, সেটুকুই আমরা মঞ্জুর করে দিচ্ছি। এরপর করতে হলে আদালতে যেতে হবে। আমরা আদালতের বাইরে যতখানি করতে পারি, সেটুকু করছি।’

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার প্রথমত খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়। সেখানে দুটি শর্ত দেওয়া হলো, নিজের বাসায় থাকার এবং দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার। ছয় মাস শেষ হওয়ার পর আরও ছয় মাস বাড়াল। এভাবে প্রতিবার বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবারই কিন্তু নতুন আদেশ দিতে হচ্ছে। এর অর্থ, শর্ত পরিবর্তন হচ্ছে। বারবার শর্ত পরিবর্তন করছে। এখন শর্ত পরিবর্তন করে, দেশের হাসপাতালের জায়গায় যে কোনও হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন যুক্ত করলেই তো হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের আর কিছু করার নেই বলে আইনমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। আগের শর্তযুক্ত মুক্তির আদেশ বাতিল করতে হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতেও একমত নই। সরকার ৪০১ ধারা অনুযায়ী তার ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আদালতের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, সেটাও করতে পারে। সব সুযোগই তো আইনে রয়েছে।’

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও তার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছে। তবে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া না পাওয়ায় এবার দলটি কি হার্ডলাইনে যাচ্ছে? গত রোববার বিকেলে নয়াপল্টনে ঢাকা মহানগর বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের চেয়ারপারসনকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে বলেছেন, কোনো ছলচাতুরি করে লাভ নেই, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামের পর সরকার দাবি না মানলে কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির একজন নেতা বলেছেন, সেক্ষেত্রে কী হবে সেটা যথাসময়ে মহাসচিব বলবেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে মহাসচিব একা দেখা করেছেন। সেখানে বিএনপির আমরা অন্য কেউ ছিলাম না। এ আলটিমেটাম খুবই বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের সাড়া পাওয়া না গেলে দলের মহাসচিব পরবর্তী কর্মসূচি দেবেন।

বিজ্ঞাপন

কর্মসূচি নতুন মোড় নিচ্ছে কি না- এ প্রশ্নে ওই নেতা বলেন, কর্মসূচি তো নতুন মোড় নিতে বাধ্য। গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রত্যাশা ও দেশের জনগণের প্রত্যাশা যখন গোয়ার্তুমির মাধ্যমে সরকার প্রত্যাখ্যান করছে, তখন কর্মসূচিতেও সঙ্গত কারণেই বড় ধরনের মোড় নেবে। তবে খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে সেই মোড় হয়তো একটু আগেই নিচ্ছে।

বিএনপি মহাসচিব আলটিমেটাম দেওয়ার একদিন পর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস অন্য একটি সভায় এনিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আবারও অনুরোধ জানাবো, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা চলে গেছে। আর ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে যেন দেশনেত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘একটা কথা আমি আবারও বলছি, এই অবস্থায় দেশনেত্রীর যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আপনাদের কারও কোনো অস্তিত্ব বাংলাদেশে আমরা রাখবো না। আমি দুঃখিত, আমি একটু বোধহয় আবেগপ্রবণ হয়ে গেছি।’

বিএনপির এই নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা আসলে বোকার স্বর্গে বসবাস করছি। আমরা বুঝতে পারিনি। যেদিন নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেদিন থেকেই তাকে হত্যার চক্রান্ত করা হয়েছে। এই গ্রেফতার ছিল তাকে হত্যা করার জন্যে। আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা বুঝেছি গ্রেফতার করা হয়েছে, অসুস্থ হওয়ার পরে আমরা বলা শুরু করেছি তিনি অসুস্থ হয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘আসলে ওনাকে গ্রেফতার করে অসুস্থ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে- এটাই ছিল তাদের প্ল্যান। সেই প্ল্যান এখন কার্যকর করছে। আর না হলে কীভাবে অমানুষের মতো, অমানবিকতার মতো একটা কথা বলেন, খালেদা জিয়াকে বাইরে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই, আইনের জটিলতা আছে।’

মির্জা আব্বাস বলেন, ‘একটা মানুষের জীবন বাঁচাতে পৃথিবীর কোনো আইন-টাইন কাজে লাগে না। যখন জীবন বাঁচানোর প্রয়োজন হয়, তখন তার জন্য যে চিকিৎসা দরকার, সেটা করা দরকার। এটা হলো মানবিক আইন। আন্তর্জাতিক জেনেভা কনভেনশনের একটা আইন আছে- সেই আইনে উনি চিকিৎসা পেতে পারেন। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি সরকার এই সুযোগটা নেবে। দেশনেত্রীকে বিদেশে তারা পাঠিয়েছেন- এই সুযোগটা তারা নিতে পারেন।’

কারাবন্দি নেতাদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অতীত উদাহরণ তুলে ধরে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘গতকাল আমাদের মহাসচিব বলেছেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওনাকে বিদেশে পাঠাতে হবে। আজকে দেখলাম ওনারা (সরকার) বলছেন, আইনের জটিলতা আছে। আমি আজ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জিয়াউর রহমানের সময়ে আ স ম আবদুর রবকে জার্মানি পাঠানো হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে রাশেদ খান মেননকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন, তার লিভার টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, তাকে সুস্থ করেছিলেন। আজ তিনি (মেনন) আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন।’

আব্বাস বলেন, ‘হাজী সেলিম ব্যাংকক গেলেন, চিকিৎসা করে ফেরত এলেন। তিনি বাইরে আছেন, এখন সহিসালামতে আছেন। ম খা আলমগীর (মহিউদ্দিন খান আলমগীর) একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েও বাইরে ঘোরারাফেরা করছেন, মায়া (মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া) একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করছেন। অথচ আমার নেত্রী কোনো অপরাধ করেননি, তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।’

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটআপে কেবিনেই চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন খালেদা জিয়া। এমন অবস্থায় এর মধ্যে হঠাৎ শর্ত শিথিল করে ‘শিগগিরই’ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেবে সরকার- এমন জোর গুঞ্জন চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে বিএনপিপ্রধানের মুক্তি মিলছে কোন প্রক্রিয়ায়- রাজনৈতিক চাপ, সমাঝোতা নাকি মানবিকতায়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই।

তবে বিএনপির আন্দোলনের জোরে বা সমঝোতা নয়; খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি ‘সংকটাপন্ন’- বিষয়টি যাচাই করে তবেই সরকার তার সুচিকিৎসার খাতিরে বিদেশে যাওয়ার অনুমতির বিষয়ে ভাবছে বলে মনে হয়।

আবার এমনও শোনা যায়, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় তাকে ‘উন্নত চিকিৎসার’ জন্য মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তবে এ ব্যাপারে সব পক্ষই দেখে-শুনে-বুঝে এগোচ্ছেন। পরিবারের কাছেও এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার বেঁচে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা শিথিলের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সব দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নমনীয়তা দেখালেই খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টির জট খুলতে পারে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন