বিজ্ঞাপন

ধীরে ধীরে গিলে ফেলা হলো আস্ত একটি খাল!

October 8, 2023 | 11:47 pm

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: মিরপুর কমার্স কলেজসংলগ্ন হাজীরোড। সড়কের পূর্ব দিকে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মালিকানাধীন একটি জমির সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে চিত্রিত জমির স্কেলম্যাপ অনুযায়ী দক্ষিণে ৪০ ফুট চওড়া সড়ক আর উত্তরে ৫০ ফুট চওড়া খাল থাকার কথা। ম্যাপ অনুসরণ করে দক্ষিণে সড়ক পাওয়া গেলেও উত্তরে কোনো খালের দেখা পাওয়া গেল না।

বিজ্ঞাপন

খাল কোথায় গেল— দুয়েকজনের কাছে জানতে চাইতেই লোকজন জড়ো হয়ে গেল। তারা জানালেন, এখানে এখন আর খালের অস্তিত্ব নেই। অল্প অল্প করে একের পর এক স্থাপনায় ভরাট হয়েছে খালটি। এরপরও সামান্য একটু খাল ছিল, বছরখানেক আগে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে তাতে শেষ পেরেক মারা হয়েছে।

খাল না থাকায় একটু বৃষ্টি হলেই এখন হাজীরোডে দেখা দেয় মারাত্মক জলাবদ্ধতা। বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সেই জলাবদ্ধতা থাকবে ৩০ মিনিট নাকি তিন ঘণ্টা। হাজীরোডের জলাবদ্ধতার নির্মমতম রূপটি দেশবাসী দেখতে পান গত ২১ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছয় ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার মতো তলিয়ে যায় মিরপুরের কমার্স কলেজসংলগ্ন এই সড়ক। সেই সড়কে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন। বিদ্যুৎপৃষ্ট একটি শিশুকে পানির নিচ থেকে কুড়িয়ে পাওয়ার দৃশ্য আজও ভুলতে পারেননি অনেকে। মৃত তিনজন এই শিশুর মা-বাবা ও বোন। তারা সবাই হাজীপাড়া বস্তির বাসিন্দা।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মালিকানাধীন জমিতে গড়ে ওঠা বস্তি। ছবি: প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মালিকানাধীন জমিটিতেই গড়ে উঠেছে এই বস্তি। আর বস্তির পরেই দারুল আমান গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি নামের আবাসিক এলাকার গেট। বস্তিবাসীর অভিযোগ বছরখানেক আগে রাস্তার পাশে খাল ভরাট করে হাউজিং সোসাইটি অফিস কক্ষ ও দারোয়ানের থাকার ঘর নির্মাণ করেছে। যার ফলে একটু বৃষ্টিতেই এই সড়কে পানি জমে যায়।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, রাস্তার দুইপাশের কয়েকটি এলাকার বৃষ্টির পানি স্ট্রম ওয়াটার ড্রেনের মাধ্যমে এই খাল দিয়ে চলে যেত। কিন্তু এক বছর আগে এখানে খাল বন্ধ করায় এখানে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যাচ্ছে রাস্তায়। রাস্তার পাশে যে ড্রেন আছে সেগুলোও ময়লায় ভরা থাকায় পানি পার হতে পারে না। আর এই জলাবদ্ধতার শিকার শুধু বস্তিবাসীই নয়, দারুল আমান হাউজিংয়ের বাসিন্দারাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে যা সরতে অনেক সময় লাগে।’

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হাউজিংয়ের গেটের দক্ষিণ পাশে বস্তিঘেঁষে গড়ে তোলা হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন এক স্থাপনা। সেটির পিলার ও দেওয়ালেই আটকে গেছে রাস্তার পাশে কালভার্টের নিচে থাকা খালের মুখ। উপরে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা। বস্তির বাসিন্দা শামসুন্নাহার, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ রাসেলসহ আরও অনেকে অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে একটি খাল ছিল। আশপাশের সমস্ত এলাকার ড্রেনের পানি এই খাল দিয়ে বের হয়ে যেত। কিন্তু এখানে অফিসঘরের দেওয়াল দেওয়ার পর থেকে পানি রাস্তায় জমতে শুরু করেছে। শুধু এই অফিসঘরই নয়, তারও আগে আবাসিকের ভেতরে খাল বন্ধ করে একটি মসজিদ তৈরি করা হয়।’

গুগল ইমেজের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের আবাসিকের গেটের ভেতরের ওই অংশে কোনো স্থাপনা ছিল না। মসজিদ বা অফিস ঘর কিছুই না। ছিল বড় বড় গাছ। আর পাশেই টংয়ের ওপর বস্তিঘর।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মালিকানাধীন জমিটির অবস্থান ও স্কেলম্যাপ, যেখানে ৫০ ফুট চওড়া খাল দেখানো হলেও নেই তার অস্তিত্ব। ছবি: প্রতিবেদক

এ বিষয়ে দারুল আমান হাউজিংয়ের সভাপতি মামুনুর রসুল জানান, তিনি মাত্র ছয় মাস আগে এখানকার সভাপতি হয়েছেন তাই আগের বিষয় ভালো বলতে পারবেন না। তবে এখানে কোনো খাল দখল হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

মামুনুর রসুল বলেন, ‘আমরা হাউজিংয়ের জমিতে মসজিদ নির্মাণ করেছিলাম। বর্তমানে একটি অফিস নির্মাণ করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এখানে পঞ্চাশ ফিট সড়ক থাকার কথা। আমরা কোনো খাল দখল করিনি।’

খাল ছিল যার অস্তিত্ব বিলীন করা হয়েছে বলে স্বীকার করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তবে আবাসিক সোসাইটি কর্তৃক দেওয়াল তুলে খাল আটকে দেওয়ার বিষয়টি তার অজান্তে ঘটেছে বলে দাবি তার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. তফাজ্জল হোসেন (টেনু) বলেন, ‘এখানে একটি নালামতো ছিল। শুধু সাত নং ওয়ার্ডই নয় ৬, ৮, এবং ১২ নং ওয়ার্ডের পানিও এই নালা দিয়ে রূপনগর খালে যেত। বস্তিবাসীরা খাল দখল করে ঘরবাড়ি করেছে বলে শুনলেও এখানে যে আবাসিক সোসাইটি দেওয়াল তুলেছে তা তার অজানা ছিল। তবে আবাসিক সোসাইটি অল্প অল্প করে প্রথমে মসজিদ ও পরে অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে যার পুরোটাই অবৈধ।’

এই গেটের ঠিক পরেই ডানে যে দুটি স্থাপনা দেখা যাচ্ছে, সেখানেই ছিল ৫০ ফুট খালের শেষ অংশটি। ছবি: প্রতিবেদক

সরেজমিনে এলাকা ঘুরিয়ে তিনি দেখান কোন কোন জায়গা দিয়ে পানি রূপনগর খালে যায়। দেখা যায়, পানি যাওয়ার প্রায় প্রতিটি জায়গাই আটকে দিয়েছে আবাসিক কর্তৃপক্ষ। আবাসিকের দক্ষিণদিকে পানি সরার জায়গা না রেখেই দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। আর এদিকে পূর্বদিকে যেদিক দিয়ে পানি যাওয়ার কথা সেদিকে ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকলেও যেখান দিয়ে পানি আসবে সেই খালই তো বন্ধ করে ফেলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তীতে খালের অস্তিত্ব খুঁজে দেখতে হাউজিংয়ের একটি ভবনের ছাদে উঠে দেখা গেল হাউজিংয়ের গেট থেকে শুরু করে দক্ষিণে চল্লিশ ফিট সড়ক পর্যন্ত শত শত বস্তিঘর। টিন, কাঠ ও ইটের তৈরি এ সব বস্তির কোন কোন ঘর আবার তিনতলা। এ সব ঘরের নিচে খালের অস্তিত্ব দেখা যায়নি। দেয়ালের দক্ষিণ পাশে খোলা মাঠমতো জায়গার এখানে সেখানে পানি জমে থাকতে দেখা গেল। আগে এই পানি বের হয়ে যেত।

এখন কী করা হবে জানতে চাইলে কাউন্সিলর বলেন, ‘এই এলাকায় তেমন জলাবদ্ধতা নেই। আধাঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে যায়। আমরা আরও একবছর আগে থেকে এখানে কাজ শুরু করছি। আলমের টেক বলে একটি জায়গা আছে যেখান দিয়ে পানি যাওয়ার কথা সেটিও এখন ডুবে যায়। মেয়র মো. আতিকুল ইসলামসহ ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য কর্মকর্তারা দেখে গেছেন। খুব শিগগিরই আমরা এখানে জলাবদ্ধতা নিরসন করব।’

কাউন্সিলর বলেন, ‘আমি জানতাম, এখানে এমন কোনো স্থাপনা নেই। আপনাদের অনেক জোর গলায় দেখাতে নিয়ে আসছিলাম, কিন্তু এসে দেখি এ অবস্থা। আমি এটি ভেঙে উচ্ছেদ করে দেব। আমার এখানে কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকতে পারবে না।’

সারাবাংলা/আরএফ/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন