বিজ্ঞাপন

মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র

October 21, 2023 | 9:02 am

সিএনএন-এর বিশ্লেষণ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। সিরিয়ায় দুটি আমেরিকান ঘাঁটিতে আগুন লেগেছে। ইরাকে মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য করে ড্রোন ও রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক স্থাপনায় একের পর এক হামলার কারণে এ অঞ্চলে বড় আকারের সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা ছড়িয়ে পড়তে পারে অঞ্চল জুড়ে। সেই বিপদের লাল সতর্কবাতি জ্বলছে।

ইরান ও তার মিত্র সিরিয়া এবং হিজবুল্লাহকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট খোলা থেকে বিরত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে দুটি সেনাদল মোতায়েন করেছে। আরও দুই হাজার মার্কিন মেরিন সেনা এই অঞ্চলে মোতায়েনের জন্য স্ট্যান্ডবাই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবার (১৮ অক্টোবর) ইসরাইলে সাত ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন। গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের প্রচারণার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন তিনি। যদিও তিনি ক্রোধে অন্ধ না হওয়ার জন্য ইসরাইলি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউজ থেকে দেওয়া বক্তৃতায়ও তিনি একই আহ্বান পুনরাবৃত্তি করেছেন। তবে জো বাইডেন ইসরাইলে বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

তারও আগে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সঙ্গে সাত ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। আমাদের বুঝতে হবে, এটি ইসরাইলের নিয়মিত কোনো মন্ত্রিসভা নয়, এটি যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা। ইসরাইলের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ এবং সরঞ্জাম বিমানযোগে পাঠাচ্ছে।

এই সবকিছুর অর্থ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি আঞ্চলিক মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে সরাসরি জড়িত হওয়ার খুব বাস্তব সম্ভাবনার কাছাকাছি  বলে ভাবছে। এটি কুয়েত থেকে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের জন্য ১৯৯১ সালের অভিযান বা ইরাকে ২০০৩ সালের আক্রমণের মতো নয়। ওই দুইবার কয়েক মাসের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর আক্রমণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা আক্রমণের সময়, স্থান এবং পরিসর নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরের ঘটনাগুলো মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই বিপজ্জনক ভূখণ্ডে হঠাৎ করে বিস্তৃত আমেরিকান সামরিক উপস্থিতির দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা

উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য রয়েছে। সিরিয়া এমন একটি দেশ যেখানে বহু পক্ষের সেনা বিদ্যমান। বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান, হিজবুল্লাহর বাহিনী, বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক বিরোধী দলগুলোর বাহিনী, কুর্দি মিলিশিয়া, ইসলামিক স্টেটের অবশিষ্টাংশ সিরিয়ায় সক্রিয়। ইসরাইল নিয়মিতভাবে সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে বোমা বর্ষণ করে থাকে। আলেপ্পো এবং দামেস্কের বিমানবন্দরে ইরানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চলাচলে বাঁধা দেওয়ার লক্ষ্যে ইসরাইল ব্যাপক হামলা চালায় বলে মনে করা হয়।

বিজ্ঞাপন

ইরাকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। সেদেশে সুসজ্জিত এবং কঠোর যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ইরান-সমর্থিত অসংখ্য মিলিশিয়া কাজ করছে। বাগদাদ সরকারের চেয়ে অনেকাংশে স্বাধীনভাবে কাজ করছে তারা।

এবং তারপর ইরান।

কয়েক দশকের কঠোর মার্কিন অনুপ্রাণিত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরিতে সফল হয়েছে। দেশটির ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) সিরিয়া এবং ইরাকে মূল্যবান যুদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তারা ইয়েমেনে হুথিদের, সিরিয়ার সরকার, হিজবুল্লাহ, হামাস এবং ইসলামিক জিহাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে আইআরজিসি কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পর প্রতিবেশী ইরাকের একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণে সক্ষম হয়েছিল ইরান। যখন একজন সৈন্য বা মেরিনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যেতে হাজার হাজার ডলার খরচ হয়, তখন একজন আইআরজিসি সৈন্যের জন্য বাগদাদ, দামেস্ক বা বৈরুতে যেতে বড়জোর একটির বাসের একটি সিটের প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর মালিক হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু ভিয়েতনাম এবং আফগানিস্তানে তাদের পরাজয় প্রমাণ করেছে, একটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সম্পদশালী শত্রুর বিরুদ্ধে জয়ের কোনো নিশ্চয়তা তাদের নেই।

বৈরুত, দামেস্ক, বাগদাদ এবং দোহায় সাম্প্রতিক সফরের সময়, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, যদি ইসরাইল গাজার বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তাহলে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খোলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়ত এটি শুধুই একটি কথার কথা, অথবা হয়ত সিরিয়াস কিছু।

ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

গাজায় যুদ্ধ যখন উত্তাল, তখন মধ্যপ্রাচ্য ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। জর্ডান, লেবানন, লিবিয়া, ইয়েমেন, ইরান, তুরস্ক, মরক্কো, মিশর এবং অন্যত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্রোধ ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে সোচ্চার, অবিচল এবং উদার সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, ওয়াশিংটনের সবচেয়ে সহযোগী আরব বন্ধু। তিনি গাজার আল-আহলি ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে মারাত্মক বিস্ফোরণের পর আম্মানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে নির্ধারিত শীর্ষ বৈঠক বাতিল করেছেন। সন্দেহ নেই যে, তিনি এবং পরিকল্পিত শীর্ষ সম্মেলনের অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা, যেমন মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, গাজায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ইসরাইলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী একজন আমেরিকান নেতার সঙ্গে দেখা করতে ঘৃণাবোধ করেছিলেন।

মঙ্গলবার গাজার আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে হামলার কারণে শত শত মানুষ মারা গেছে। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ইসরাইলকে দায়ী করেছেন। তবে ইসরাইল তা অস্বীকার করেছে।

বৃহস্পতিবার কায়রোতে এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট সিসি এবং বাদশাহ আবদুল্লাহ একটি যৌথ বিবৃতি জারি করেছেন। এতে তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যদি যুদ্ধ বন্ধ না হয়ে আরও প্রসারিত হয়, তাহলে তা সমগ্র অঞ্চলকে একটি বিপর্যয়ের মধ্যে নিমজ্জিত করবে।

আমি গত সপ্তাহে লেবানন-ইসরাইলের সীমান্ত বরাবর এলাকায় রিপোর্টিং করেছি। এই সংঘাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এটি। হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা প্রতিদিন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছে। ট্যাঙ্ক, সৈন্য এবং সবচেয়ে ধারাবাহিকভাবে নজরদারি এবং যোগাযোগ সরঞ্জামে এসব ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানছে। হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের সামরিক শাখা মাঝে মাঝে ইসরাইলে রকেট নিক্ষেপ করে। ইসরাইলিরা হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালায়। উভয় পক্ষের যোদ্ধা ও বেসামরিক লোকজন হতাহত হচ্ছে।

স্নায়ু উত্তেজনার জন্য এই সংঘাত যথেষ্ট, কিন্তু একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার জন্য তা যথেষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতে টেনে আনার জন্যও তা যথেষ্ট নয়। কিন্তু যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার খুব বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ইরান, হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্যদের বেশি দূর পর্যন্ত এগুতে বাধা দেওয়ার জন্য দিগন্তরেখায় মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। যদি তারা বেশি দূর যেতে চায় এবং যুক্তরাষ্ট্র বাধা দেয়, তাহলে কী হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের কয়েক দশকের পুরনো ঝগড়া একটি আঞ্চলিক বিপর্যয় হিসেবে বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য সমস্ত উপাদান তৈরি হয়েছে। আর এই আঞ্চলিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রে থাকতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

লেখক: বেন ওয়েডেম্যান, বৈরুতে অবস্থিত সিএনএন-এর সিনিয়র আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন