বিজ্ঞাপন

অপার্থিব ম্যাক্সওয়েলে স্বপ্নভঙ্গ আফগানদের

November 7, 2023 | 11:18 pm

স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট

অতিমানবীয়, অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়, অসাধারণ, অপার্থিব, মহাকাব্যিক— একেকজন ব্যবহার করছেন একেক বিশেষণ। কেউ কেউ বলছেন ওয়ানডে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ব্যক্তিগত ইনিংস। তারপরও যেন মনে হচ্ছে বিশেষণ কম পড়ে যাচ্ছে। কোনো বিশেষণেই যেন এই ইনিংসটিকে বর্ণনা করা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, ঠিক এমনই একটি ইনিংস খেলেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।

বিজ্ঞাপন

২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে নিজেদের অষ্টম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দল যখন ২৯২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে মাত্র ৯১ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে খাদের কিনারায়, ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে অভাবনীয় এক ইনিংস উপহার দিলেন ম্যাক্সওয়েল।

টার্গেট আর আফগান বোলার কেবল নয়, লড়াই করলেন নিজের শরীরের সঙ্গেও। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল শরীরকে আর দাঁড় করিয়ে রাখতেই পারছেন না। তবু হাল ছাড়েননি। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের উইকেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবিচল। অস্ট্রেলিয়ার ঘোরতর সমর্থকও যে ম্যাচে জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিল, সেই ম্যাচটি একা হাতে জিতিয়ে তবেই ফিরেছেন ড্রেসিং রুমে। স্কোরবোর্ডে তখনো ৭ উইকেট। আর ‘ম্যাক্সি’র নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১২৮ বলে অপরাজিত ২০১! এই বিশ্বকাপের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটিই হাঁকালেন এই অজি ব্যাটার।

অথচ ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়ার পরাজয় তখন কেবলই সময়ের ব্যাপারই মনে হচ্ছিল। কিন্তু একদমই তেমনটি ভাবেননি ম্যাক্সওয়েল আর অজি ক্যাপ্টেন প্যাট কামিন্স। অষ্টম উইকেটে দুজন মিলে গড়লেন ১৭০ বলে ২০২ রানের অপরাজিত জুটি। তবে জুটিতে দুই অংশীদারের অবদান রীতিমতো চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। প্যাট কামিন্স করেছেন ৬৮ বলে ১২ রান। অর্থাৎ জুটির ১৭৯ রানই ম্যাক্সওয়েলের, সেটিও ১০২ বলে!

বিজ্ঞাপন

ছক্কা মেরে অজিদের অবিশ্বাস্য জয় নিশ্চিত করেছেন ম্যাক্সওয়েল। তাতে তার ডাবল সেঞ্চুরিও পূর্ণ হয়েছে। ১২৮ বল খেলে ২১টি চার ১০টি ছক্কার সাহায্যে ২০১ রানের অতিমানবীয় ইনিংস খেলে অপরাজিত ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। তাতে ৪৬.৫ ওভারে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৭ উইকেটের জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া।

ক্র্যাম্পের কারণে মনে হচ্ছিল, ম্যাক্সওয়েলকে হয়তো মাঠই ছাড়তে হবে

এই জয়ের ফলে অস্ট্রেলিয়ার সেমিফাইনাল সুনিশ্চিত হলো। গ্রুপ পর্বের বাকি ম্যাচগুলোতে যাই ঘটুক না কেন, আগামী ১৬ নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় সেমিফাইনালে তারা দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে।

অন্যদিকে আফগানিস্তানের হিসাবটা কঠিন হয়ে গেল। শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে তারা। সে ম্যাচে জয় পেলেও তাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে নিউজিল্যান্ড-শ্রীলংকা আর পাকিস্তান-ইংল্যান্ড ম্যাচের দিকে। রানরেটে পিছিয়ে থাকায় এই সবগুলো ম্যাচে সেমিফাইনালপ্রত্যাশীরা জয় পেলে আফগানিস্তানকে রানরেটের কারণে পিছিয়েই থাকতে হবে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) মুম্বাইয়ের ওয়েংখেড়ে স্টেডিয়ামে ২৯১ রানের জবাব দিতে নামতেই যেন মড়ক লাগে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে। রানের খাতা খোলার আগেই ফিরে যান ট্রাভিস হেড। এরপর ডেভিড ওয়ার্নার ও মিচেল মার্শ দলকে টানা চেষ্টা করেছেন। মার্শ বেশ উড়িয়ে খেলার চেষ্টাই করেছেন। তবে দুজনের কেউই ইনিংস বড় করতে পারেননি।

মার্শ ফিরেছেন ১১ বলে ২৪ রান করে। আর ওয়ার্নার আউট হন ১৮ রানে। দলের রান তখন ৪৯। ওই অবস্থায় উইকেটে এসে প্রথম বলেই অফ স্টাম্পের বাইরের বল খোঁচা দিয়ে প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটা ধরলেন জশ ইংলিশও। প্রথম পাওয়ারপ্লে শেষে আফগানিস্তানের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ৪ উইকেটে ৫২!

বিপর্যয়ের শেষ সেখানেই নয়। আর ২০ রান পরেই অসম্ভব এক রান নিতে গিয়ে সাজঘরে ফিরলেন মারনাস লাবুশেন। এমন অবস্থাতেও ম্যাচে দুর্দান্ত বল করতে থাকা রশিদ খানকে রিভার্স সুইপ করার ‘শখ’ হলো মারকাস স্টয়নিসের। ফলাফলও পেলেন হাতেনাতে— এলবিডব্লিউ! রশিদ পরের ওভারেই মিচেল স্টার্ককে ক্যাচ দিতে বাধ্য করলেন, আফগান উইকেটরক্ষক ইকরাম আলিখিল অসামান্য দক্ষতায় ক্যাচটি নিয়ে অজিদের ৭ উইকেটে ৯৩ রানে পরিণত করলেন।

ম্যাক্সওয়েল এদিন যেভাবেই ব্যাট চালিয়েছেন, বল চলে গেছে সীমানার বাইরে

এরপর প্যাট কামিন্সকে নিয়ে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল যা করলেন, সেটি রীতিমতো সিনেমাটিক। শুরু থেকেই মারতে থাকেন ম্যাক্সওয়েল। পরে রীতিমতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন। একপর্যায়ে পায়ের পেশীতে টান পড়লে মনে হচ্ছিল হয়তো মাঠ থেকে উঠেই যেতে হবে। অ্যাডাম জাম্পা রীতিমতো প্রস্তুত হয়ে বাউন্ডারি লাইন পর্যন্ত চলে এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া তখনো জয় অনেক দূর।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু না, মাঠ ছাড়েননি ম্যাক্সওয়েল। উইকেট কামড়ে ধরে পড়েছিলেন। একপর্যায়ে দৌড়াতে পারছিলেন না। ওই সময় বাউন্ডারি লাইনের কাছে বল পাঠিয়েও ঠাঁই দাঁড়িয়েছিলেন। বল বুঝে বুঝে যে সামনে এগিয়ে বা ফুটওয়ার্কের মাধ্যমে জায়গা করে খেলবেন, পারছিলেন না সেটিও। বলতে গেলে একই পজিশনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু তাকে দমানো যায়নি। ওই এক স্টান্সে দাঁড়িয়েই একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন, হাঁকিয়েছেন ওভার বাউন্ডারি। আফগানিস্তানের কোনো বোলারই তার সামনে বল ফেলার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

৪০ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৩২ রান। অর্থাৎ শেষ ১০ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ৬০ রান। ম্যাক্সওয়েলের রান ১৪২, অর্থাৎ ডাবল সেঞ্চুরির জন্য প্রয়োজন ৫৮। এখান থেকে ম্যাক্সওয়েল আর কামিন্স ম্যাচ শেষ করেন ৪৬ ওভার ৫ বলে। এর মধ্যে দুজনে সিংগেল নিয়েছেন মাত্র ৬টি, ওয়াইড থেকে এসেছে ১ রান। বাকি ৫৪ রানই এসেছে ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটে চার-ছক্কা থেকে। ম্যাচ শেষে ২১টি চার আর ১০টি ছক্কায় ম্যাক্সওয়েলের সংগ্রহ ১২৮ বলে ২০১ রান!

ম্যাক্সওয়েলের অপার্থিব এই ইনিংসে অবশ্য আরও নানা দিক থেকে ঘটনাবহুল। তার অন্তত দুটি সহজ ক্যাচ ছেড়েছেন আফগান ফিল্ডাররা। এ ছাড়া নুর আহমদের বলে তাকে এলবিডব্লিউ আউট দিয়েছিলেন আম্পায়ার। রিভিউ নিলে যখন রিপ্লেতে দেখছিলেন বলটি তার ব্যাটে লাগেনি, তখনই ড্রেসিং রুমের পথে হাঁটাই ধরেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। বলটি অবশ্য উচ্চতার কারণে স্টাম্প মিস করায় আউটের সিদ্ধান্ত বদলাতে হয় আম্পায়ারকে। ম্যাক্সওয়েলও দিক বদল করে ফিরে আসেন উইকেটে। তারপর যা করলেন, তা স্থায়ী হয়ে থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়।

আফগান বোলারদের মধ্যে নাভিন-উল-হক, আজমতউল্লাহ ওমরজাই ও রশিদ খান ২টি করে উইকেট নেন। তাদের মধ্যে রশিদ খান ১০ ওভারে ৪৪ রান দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার রানকেও বেঁধে রেখে চাপ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন বেশি।

ম্যাক্সওয়েলের এই ডাবল সেঞ্চুরি তার তো বটেই, অস্ট্রেলিয়ার পক্ষেও ওয়ানডেতে প্রথম। শেন ওয়াটসনের ১৮৫ রানের ইনিংসটিই এতদিন অজিদের ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ছিল। এ ছাড়া কামিন্সের সঙ্গে ম্যাক্সওয়েলের ২০২ রানের জুটিটি অস্ট্রেলিয়া তো বটেই, ওয়ানডে ক্রিকেটেই অষ্টম উইকেটে সেরা। ২০০৬ সালে ভারতের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যান্ড্রু হল ও জাস্টিন ক্যাম্প ১৩৮ রান করেছিলেন অষ্টম উইকেটে, যা এবার নেমে গেল দুইয়ে।

এর আগে মুম্বাইয়ে স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাট করতে নামে আফগানিস্তান। ইব্রাহিম জাদরানের শতকে বেশ চ্যালেঞ্জিং স্কোরই গড়েছিল তারা। এটি বিশ্বকাপেই আফগানিস্তানের প্রথম কোনো শতরান। তিনি ওপেনার রহমানুল্লাহ গুরবাজ নিয়ে ভালোই শুরু করেছিলেন। তবে গুরবাজ দারুণ শুরু করেও ফিরে যান ২১ রান করে। এরপর জাদরান ও রহমত শাহ ৮৩ রানের জুটি গড়ে সেই ধাক্কা সামাল নেন। রহমত শাহ ফিরে যান ৩০ রান করে।

এরপর জাদরানের সঙ্গে জুটি গড়ে ছোট ছোট সংগ্রহে দলকে এগিয়ে নেন হাসমতউল্লাহ শাহিদি ও আজমতউল্লাহ ওমরজাই। অধিনায়ক শাহিদি খেলেন ২৬ রানের ইনিংস। আজমত যোগ করেন ২২ রান। মোহাম্মদ নবী ১০ বলে ১২ রানের বেশি করতে পারেননি এদিন। তবে রশিদ খান ১৮ বলে ৩৫ রানের একটি চমৎকার ক্যামিও ইনিংস খেলেন। জাদরানের সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে তার ২৮ বলে অপরাজিত ৫৮ রানের জুটি দলকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দেয়।

অন্যদিকে ইব্রাহিম জাদরান শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করেন। অর্থাৎ ওপেনিংয়ে নেমে নিজে আউট না হয়ে ইনিংস শেষ করেন, যাকে ব্যাট ক্যারি করা বলে। তার ব্যাট থেকে আসে ১৪৩ বলে ১২৯ রানের ইনিংস। আটটি চারের পাশাপাশি তিনটি ছক্কাও মেরেছেন তিনি।

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে জশ হ্যাজেলউড ৯ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে ২ উইকেট তুলে নেন। মিশেল স্টার্ক ৯ ওভারে ৭০ রান খরচা করে নেন একটি উইকেট। লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা ১০ ওভারে ৫৮ রান দিয়ে নেন একটি উইকেট।

সারাবাংলা/এসএইচএস

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন