বিজ্ঞাপন

নদী রক্ষার দায় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে: আনু মুহাম্মদ

November 10, 2023 | 6:51 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা আন্দোলন সংগঠক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় নদী ও পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। নদী রক্ষার দায় সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘নদী শুধু রক্ষার কথা বললেই হবে না। দায়ও নিতে হবে। এর জন্য প্রথমেই সরকারি সংস্থার নদী দখল ঠেকাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদী রক্ষা কমিশন, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটকে কার্যকরী করতে ক্ষমতা দিতে হবে এবং তৃতীয়ত, এই কাজগুলো করার জন্য প্রয়জনীয় আইন সংস্কার করতে হবে এবং সর্বশেষ, নদী ও পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে।

শুক্রবার (১০ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে নোঙর বাংলাদেশ আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে নদী দখলদারের নাম মুছে দেওয়া এবং নদীর সংখ্যা কমানোর প্রতিবাদে এই সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন, ইনিশিয়েটিভ ফর পিস (আইএফপি) এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমানসহ নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ বলে শুনি কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসেও নদ-নদীর সংজ্ঞা এবং সংখ্যা নির্ধারিত হয়নি। নদ-নদীর বেসরকারি এবং সরকারি সংখ্যার হিসেবে গড়মিল দেখা যায়। এসব গড়মিল স্বত্বেও আমরা দেখি বহু নদী খুন হয়ে গেছে। এখন যেসব নদী অর্ধমৃত তারাও কিছুদিনের মধ্যে মারা যাবে।’

বিজ্ঞাপন

এ সময় তিনি নদ-নদী খুনের তিনটি উৎসের কথা জানিয়ে বলেন, ‘এক, ভারতে নদীগুলোকে নিয়ে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে তার ফলে আমাদের দেশের নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুই, সরকারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ। সরকার দেশের বহু জায়গায় এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে যার ফলে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিন, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে দখল এবং দূষণ।’

সরকারের পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন প্রকল্পের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা জিডিপির হিসাব পাচ্ছি কিন্তু কিসের বিনিময়ে জিডিপি বাড়ছে তার হিসেব নেই। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ইত্যাদি নদী যেসব কারণে আস্তে আস্তে মৃতের দিকে যাচ্ছে সেসব কারণেই কিন্তু জিডিপি বাড়ছে। নদী শেষ হয়ে গেলে যদি দূষণ হয় তার জন্য আবার আপনি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। তার জন্য আপনাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে যার ফলে জিডিপি বাড়ছে। এভাবে নদী মেরে, মানুষ মেরে জিডিপি বাড়া দেখে আমরা খুশি হয়ে বসে থাকলাম কিন্তু এদিকে আমদের পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে।’

এছাড়া ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদী বিষয়ক যে জটিলতা তার ফয়সালা সরকারকেই করতে হবে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে ফয়সালা সরকারকেই করতে হবে যা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সংরক্ষিত। কিন্তু জাতিসংঘের সেই আইনে সঙ্গতকারণে ভারত স্বাক্ষর না করলেও বাংলাদেশের নিজ স্বার্থেই সেই আইনে স্বাক্ষর করা দরকার ছিল। প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলেন, কিছুদিন আগেও বলেছেন নদী এবং পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু আমরা কথা এবং কাজের মিল পাচ্ছি না। পরিবেশ নষ্ট করে একের পর এক কাজ হচ্ছে। নদী ভরাট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানও অবকাঠামো নির্মাণ করছে। দেখা যাচ্ছে কনস্ট্রাকশন আর কেনাকাটার স্বার্থে বন, নদী, হাওর শেষ হচ্ছে কি হচ্ছে না তার দিকে তাকানো হচ্ছে না।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে নদী রক্ষা কমিশনের অক্ষমতা প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশের যত কমিশন আছে তাদের কোনো কর্মক্ষমতা নাই। দুদক, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, নদীরক্ষা কমিশন কারুরই আদতে কোনকিছু ঠেকানোর ক্ষমতা নেই। নদী রক্ষা কমিশনের কোনোকিছু রক্ষা করার বা দখল ঠেকানোর ক্ষমতা নেই। লোকবল, আইনি সুরক্ষা কিছুই নেই।’

তিনি বলেন, ‘নদী রক্ষা কমিশন, পরিবেশ অধিদফতরকে শক্তিশালী করতে হবে। সর্বশেষ নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তিনি দখলদারদের নাম মুছে দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে তাকে কি দখলদারদের নাম মুছে দেওয়ার স্বার্থেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল? আবার দেখা গেল, মেঘনা নদী দখলে মন্ত্রীর নাম নেওয়ার পর তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো। নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকার পরেও তাকে কি কারণে নিয়োগ দেওয়া হলো, ওয়েবসাইট থেকে নদী দখলদারদের নাম মুছে দেওয়া হলো বা তাকে কেন সরিয়ে দেওয়া হলো এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা পাইনি। আবার বালু উত্তোলনের কারণে নদী শেষ হয়ে যাচ্ছে যার সঙ্গে মন্ত্রী জড়িত এমন অভিযোগ যে তিনি করলেন এটির কোনো ব্যাখ্যা আমরা ওই মন্ত্রী বা সরকারের তরফ থেকে পাইনি। এই বিষয়ে সরকারের অবস্থান জনগণ চায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমন সব ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যাদের কাছে নদী হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ। নদী শুকিয়ে গেলে মাটি উঠবে যেখানে আবার কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া যাবে।’

অনুষ্ঠানে বলা হয়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তাড়াহুড়া করে বাংলাদেশের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা অনুসন্ধান না করে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখ ১০০৮ টি নদী নির্ধারণ পূর্বক গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে নদ-নদীর অসম্পূর্ণ সংজ্ঞা উপস্থাপন করেছে। অথচ নদীমাতৃক এ দেশে আরও ৬০০ এর বেশি নদ-নদীর অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি ৩৭ হাজার ৩৯৬ নদী দখলদারের তথ্য মুছে আরও একটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে নদী রক্ষা কমিশন। এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে এই নাগরিক সেমিনার। নোঙর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামসের সঞ্চালনা ও সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী।

সেমিনারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নোঙর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেন, ‘৫০ হাজারের উপর দখলদারদের তালিকার ওপর যে বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল সেটিকে ভুলে ভরা তালিকা বলে মুছে ফেলা হয়েছিল। পরবর্তীতে নদী কমিশনের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ভুলে ভরা এই তালিকা সংশোধন করে আপলোড করার কথা বলেছিলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ৪৮টি নদীকে নিয়ে সমীক্ষা করলেন সেই প্রকল্পের ফলফল আমরা এখনও জানতে পারিনি। সার্ভার থেকে সেই তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তিনবছর মেয়াদী ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প যা পরবর্তীতে পাঁচ বছরে যায় সেই প্রকল্পের ফলাফল আমরা জানতে পারিনি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘এখন সরকারের কাছে আমাদের দাবি দখলদারদের তালিকা যেটি পরবর্তীতে জরিপ করে দেখা গেছে; যা পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজারে পৌঁছে গেছে সেই তালিকা প্রকাশ করা হোক। আমরা তথ্য পেয়েছি এই তালিকা কখনোই প্রকাশ করা হবে না। আমাদের দাবি সেই তালিকা প্রকাশ করা হোক।’

সুমন শামস বলেন, ‘আমরা নদীকে ভালবাসি। আমাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকার নদী কমিশন তৈরি করেছে, নদ-নদীর তালিকা প্রণয়ন করেছে। আবার মহামান্য আদালত আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে নদীকে জীবন্তসত্তা ঘোষণা করে। এখন আমাদের দাবি নদী রক্ষার যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হোক।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল রাজনৈতিক দলই ডামাডোল পিটাচ্ছে ক্ষমতার যাওয়ার জন্য। কিন্তু কাউকেই নদীকে রক্ষার কথা বলেন না। আমাদের দাবি আসন্ন নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নদী ও প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য অঙ্গীকার করতে হবে।’

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘প্রকল্প থেকে দখলদারদের যে তালিকা রয়েছে তা দ্রুত যাচাই করে বর্তমান কমিশন প্রকাশ করুক । ভুলে ভরা যে নদীর সংখ্যা নিয়ে যে বইটি আছে তা আপাতত স্থগিত করা হোক।’

অভিযোগ বিষয়ে নদী কমিশনের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মনজুর চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েব সাইটে (www.nrcc.gov.bd) ৪৮টি নদী সমীক্ষার সব তথ্য আপলোড করা আছে। মেনুতে গিয়ে ‘প্রকল্প’ তে ক্লিক করলে সকল ডাটা দেখা যাবে। নদীর দখলদারদের কোনো ডাটা মুছে ফেলা হয়নি। একটি স্বার্থান্বেষী মহল দখলদারদের ডাটা আমি মুছে ফেলেছি বলে একটা মিথ্যা প্রচারণা কয়েকমাস ধরে চালিয়ে আসছে। শুক্রবারে প্রেস ক্লাবে ‘প্রতিবাদ’ সেমিনার এই চক্রেরই আর একটা অপপ্রয়াস। ধারণা করি এই চক্র মেঘনা, কর্ণফুলী নদীর রাঘববোয়াল দখলদারদের কাছ থেকে প্রণোদনা পেয়ে এই অপতৎপরতা চালাচ্ছে।’

সারাবাংলা/আরএফ/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন