বিজ্ঞাপন

ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো চলচ্চিত্র এবং আমরা

November 11, 2023 | 3:31 pm

শিশির ওয়াহিদ

বলিউডের ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি দেখলাম। মুভিটি আমার দেশ এবং আমার নিজ এলাকার ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে বিধায় আগ্রহের কমতি ছিলোনা। যশোরের চৌগাছার গরিবপুর ও বুরিন্দিয়ার যুদ্ধের ঘটনা এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শুরু থেকে শেষ অব্দি আমি একজন সমালোচকের দৃষ্টিতে সিনেমাটি দেখেছি, আগেই বলেছি এটি আমার নিজ এলাকার। মুভির শুরুর দৃশ্যে খুব সংক্ষেপে ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করেছে, ২৫শে মার্চ গণহত্যার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সমকালীন ব্যবহৃত শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সম্বলিত ও মোটা অক্ষরে লেখা জয় বাংলা যুক্ত পোস্টারগুলো আমার বেশ ভালো লেগেছে। ভারত যে এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সহযোগিতা করতে মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়েছে, ভারতীয় নাগরিকেরা আন্দোলন ও সাধ্যের মধ্যে সহযোগিতা করেছে, এটাও অবিকৃতভাবে আংশিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সিনেমাটি ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার লেখা ‘দ্য বার্নিং চ্যাফিস’ বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, এবং মূখ্য চরিত্রে ক্যাপ্টেন বলরাম সিংকে রাখা হয়েছে। চৌগাছা, গরিবপুর, বুরিন্দিয়া, বয়রা ও যশোরের যুদ্ধের কথা বেশকবার এখানে উঠে এসেছে। তবে একটা চরিত্র আমার ভীষণভাবে দৃষ্টি কেড়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, আমি তাকে জীবন্ত ইন্দিরা গান্ধী ভেবে বসেছিলাম। মাঝেমধ্যে অভিনয়শিল্পীদের মুখ থেকে শুদ্ধ বাংলায় কথোপকথন শুনতে বেশ ভালোই লাগছিলো।

মুভির ভালো দিক বলতে গেলে এগুলোই। মোটামুটি ভালো দিকের বাইরে বেশকিছু বিষয় আমাকে হতাশ করেছে। হতাশ মানে কিছু কারণে রীতিমতো আমি ক্ষুব্ধ।

এই চলচ্চিত্রে ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইটকে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালানো গণহত্যার অভিযান আখ্যা দিয়ে বসে থাকা হয়েছে। যে যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেই গরিবপুরের সম্মুখসমরের নেতৃত্ব দিয়েছেন কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, যিনি তৎকালীন বয়রা সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিশেবে নিযুক্ত ছিলেন। ঐ অঞ্চলের যুদ্ধ জয়ের প্রেক্ষাপট রচিতই হয়েছিল মূলত নাজমুল হুদার নেতৃত্বে থাকা মুক্তিবাহিনীর প্রচেষ্টায়। ভারতীয় সেনা এখানে সহযোগিতা করেছে মাত্র, যুদ্ধ জয়ের প্রকৃত নিয়ামক তারা নন। কিন্তু ঘটনা দেখলাম উল্টোটা। দেখানো হলো যুদ্ধটা ভারতীয় সেনাদের, মুক্তিবাহিনীরা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে মাত্র।

বিজ্ঞাপন

যেহেতু চলচ্চিত্রটি বলিউডের, তারকাটার এপারে বসে আশা রাখা ঠিক নয়। তবুও আমি আশা রেখেছিলাম অন্ততপক্ষে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে কর্নেল নাজমুল হুদাকে হয়তো রাখা হতে পারে! কিন্তু সেসব তো দূরের কথা, আমার আশা বা ধারণার কাছ দিয়েও যায়নি। আরেকটা দৃশ্যে নদীপথে ট্যাংক পারাপারের সময় ভৈরব নদের চারপাশে যে উঁচু-উঁচু পাহাড়-পর্বত দেখানো হয়েছে, তা আদতে সত্য নয়। নদীমাতৃক যশোর অঞ্চলে এত সুউচ্চ পাহাড় বিগত কয়েক হাজার বছর পূর্বেও ছিলো কি-না তা আমার জানা নেই। আর ভৈরব নদ দেখাতে গিয়ে নির্মাতা অনেকটা সমুদ্র দেখিয়ে ফেলেছে। তবে যশোরের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের স্বাদ আনতে সিনেমাতে বেশকিছু গ্রাম্য পরিবেশ ও খেঁজুর গাছ ঘেরা এলাকায় দৃশ্যধারণ করেছে বলে মনে হয়েছে।

এতকিছুর পরও সবথেকে যে দিকটা জঘন্য এবং নিম্নরুচির, তা হলো আল্লাহ রাখা রহমান ওরফে এ.আর রহমানের পরিবেশন করা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ সংগীতটি। আমার ধারণা, কাজী নজরুল ইসলাম যদি পুনর্জন্ম লাভ করতেন, তার রচিত সংগীতের এই হাল দেখে নির্ঘাত আত্মহত্যা করতেন। কিংবা তিনি বলে উঠতেন, ‘আরে এরা কারা! কোত্থেকে এলো ওরা’। অথবা এ.আর রহমানের দিকে খড়ম হস্তে ছুটে গিয়ে হয়তো উচ্চস্বরে গেয়ে উঠতেন—

“আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।”

বিজ্ঞাপন

আমি জানিনা এ.আর রহমানের মতো একজন গুণী সংগীত পরিচালক এত বিশ্রী কাজ কীভাবে করতে পারেন! এমনকি যুদ্ধের মতো দুর্বিষহ সময়ে ঐ বিকৃতি ঘটানো গান শুনে মুক্তিযোদ্ধারা নাচানাচি করছে, উল্লাস করছে, ‘পিপ্পা’র বদৌলতে সেটাও আমাকে দেখতে হলো।

সর্বপরি একটা বিষয় স্বীকার করতে হবে, ঐ যুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অবদান যথেষ্ট, কিন্তু তারা একক নিয়ামক নয়। চলচ্চিত্রে যেভাবে যুদ্ধজয়ের একক কর্তৃত্ব নেওয়ার প্রচেষ্টা, একাত্তরের ৯ মাস ধরে চলা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধকে ১৩ দিনের অবদান রাখার দায়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আখ্যা দেওয়া, এটা ইতিহাস সইবেনা।

এ-থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ারও প্রয়োজন আছে। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হলেও উল্লেখযোগ্য দুয়েকটা চলচ্চিত্র বাদ দিলে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য নিয়ে, বীরযোদ্ধাদের সংগ্রাম নিয়ে গর্ব করে বলার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারিনি, নতুন প্রজন্মের সামনে কিছু রেখে যেতে পারিনি। অথচ এই জায়গায় ভারত সফল, তাদের বলিউড সফল। ভারতের আনাচে-কানাচে কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলেও তারা সেটাকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে চলচ্চিত্ররূপে জাতির সামনে উপস্থাপন করে। অথচ আমরা?

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে, সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ, জাতীয় চার নেতা, ক্রাক প্লাটুনের খালেদ মোশাররফ, শহিদ কর্ণেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রম, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, জাহানারা ইমামসহ এই সকল সংগ্রামী আত্মত্যাগী মানুষগুলোকে নিয়ে কমপক্ষে অর্ধশতক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব, সম্ভব মানে অবশ্যই সম্ভব। সব বাদ দেন, যে চলচ্চিত্র নিয়ে এত আলোচনা করছি, সেই চলচ্চিত্র যে জায়গার ঘটনা নিয়ে নির্মিত, শুধুমাত্র সেই চৌগাছা-গরিবপুর-যশোরের ঘটনাগুলো নিয়েও অন্তত হাফ ডজন সিনেমা বানানো যাবে। সিনেমা বানানোর মতো সমৃদ্ধ ইতিহাস ও উপাদান ঐ স্থান ও তার ঘটনাগুলোর আছে। কিন্তু আমরা পিছিয়ে। কেন পিছিয়ে, কেন আমাদের অনাগ্রহ— সেসব অন্য আলাপ, অনেক দীর্ঘ। বলতে গেলে শুধু হতাশা বাড়বে। হতাশা ফুঁড়ে আলো আসুক। দেরিতে হলেও আসুক। অন্তত যেন ভীনদেশের নির্মাণ করা চলচ্চিত্র দেখে আমার দেশের সংগ্রামী ইতিহাসের স্বাদ না পেতে হয়, এই আশা আমি রাখতে চাই।

বিজ্ঞাপন

লেখক: শিক্ষার্থী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন