বিজ্ঞাপন

আ.লীগে মোজাম্মেল-ই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী, বিএনপিতে এগিয়ে বাবুল

November 18, 2023 | 11:10 pm

মো. তাওহীদ কবির, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

গাজীপুর: একটি সমৃদ্ধ ও প্রাচীন জনপদের নাম গাজীপুর। এই জেলাটিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী বিখ্যাত ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠে এই গাজীপুরে। বাংলাদেশকে বিশ্বে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন বিরল মেধা ও প্রজ্ঞার অধিকারী এবং প্রচণ্ড ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত ক্ষণজন্মা এক ব্যক্তিত্ব। তাজউদ্দিনের বাইরেও সুস্থ রাজনীতির বাহক, দেশ উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় যাদের নাম উচ্চারিত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- প্রয়াত শামসুল হক, শহিদ আরজ উদ্দিন, শহিদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন, গাজী গোলাম মোস্তফা, প্রয়াত হাবিবুল্লাহ, শহিদ হুরমত আলী, শহিদ আহসান উল্লাহ মাস্টার, মো. রহমত আলী ও আ ক ম মোজাম্মেল হক।

বিজ্ঞাপন

পোশাক শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই গাজীপুরকে এক কথায় বলা চলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এই জেলার পাঁচটি আসনই বর্তমানে আওয়ামী লীগের দখলে। রাজনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই গাজীপুরের রাজনীতি আবর্তিত হয় স্থানীয় জনগণ ও পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে। এই জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার পোশাক কারখানা রয়েছে। ফলে এখানে স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। যে কারণে এই জেলার আসনগুলোতে ভোটার অন্যান্য আসনের চেয়ে বেশি।

আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা এখনও হরতাল-অবরোধ দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ও ভোটারের জেলা গাজীপুরের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। এবারও জাতীয় পার্টি মহাজোটে থেকে নির্বাচন করছে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে গাজীপুর-১ আসনের চিত্র।

বিজ্ঞাপন

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ড ও কালিয়াকৈর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গাজীপুর-১ আসন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে গাজীপুর সদরের বাসন, কোনাবাড়ি ও কাশিমপুর ইউনিয়নকে যুক্ত করে আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। পরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও আরেক দফা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে সীমানা ফের পুনর্বিন্যাস করা হয়।

আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হলেও জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসনটি দখলে নিতে নানা কৌশলে মাঠে আছে বিএনপি। গত ১৫ বছর ধরে আসনটি আওয়ামী লীগের আ ক ম মোজাম্মেল হকের দখলে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। বিশেষ করে নব্বইয়ের পট পরিবর্তনের পর অনুষ্ঠিত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন ছাড়া বাকি পাঁচটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন।

গাজীপুর-১ আসনটি শিল্প অধ্যুষিত হওয়ায় আসনটি বরাবরই বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় জাতীয় নির্বাচনে। আসনটিতে এক সময় জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থান ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির আমলে এ আসনে দু’বার বিজয়ী হন দলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মতিউর রহমান। ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আবদুস সালাম মনোনয়নপত্র জমা দিলেও শেষ মুহূর্তে তিনি প্রত্যাহার করে নেন। ফলে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন।

বিজ্ঞাপন

এই আসনটিতে বর্তমান এমপি মোজাম্মেল হক ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হচ্ছেন- কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন সিকদার, জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বাবুল ও নূরে আলম সিদ্দিকী।

নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী আ ক ম মোজাম্মেল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। এবার নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন চাই। জনগণের জন্য কাজ করছি। তাই মনোনয়ন পেলে জয় নিয়ে শতভাগ আশাবাদী। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমি তার জন্যই কাজ করব।’

নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী চাপে রয়েছে বিএনপি। নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক নাশকতার মামলা ঝুলছে। ঠিকভাবে দলীয় কর্মসূচিও পালন করতে পারছেন না। এর মধ্যেই মাঠে থাকার চেষ্টা করছেন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হচ্ছেন- গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী ছাইয়্যেদুল আলম বাবুল, গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক কালিয়াকৈর পৌর মেয়র মজিবুর রহমান, গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জি এস সুরুজ আহাম্মেদ, গাজীপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার চৌধুরী ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকী।

গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী ছাইয়্যেদুল আলম বাবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে অবশ্যই আমি মনোনয়ন চাইব। দল আমাকে মনোনয়ন দেবে, আমি শতভাগ আশাবাদী। এ ছাড়া দল যদি মনোনয়নের ক্ষেত্রে অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয় এতে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমি তার জন্য কাজ করতে ইচ্ছুক।’

বিজ্ঞাপন

জাতীয় পার্টি থেকে গাজীপুর-১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- মহানগর জাতীয় পার্টির সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. শরীফুল ইসলাম শরীফ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়ভাবে দলকে চাঙ্গা রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। নিজেকে প্রচার কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। এছাড়াও জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

এদিকে, জাকের পার্টির গাজীপুর জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মানিক সরকারের নাম শোনা যাচ্ছে নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব ও গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতি এ এন এম মনিরুজ্জামান লাল এ তথ্য জানান।

উল্লেখ্য, এই আসনে মোট ভোটার ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮১৮ জন এবং নারী ভোটার ৩ লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ জন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ২ লাখ ৬১ হাজার ৩০৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আ ক ম মোজাম্মেল হক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির চৌধুরী তানবীর আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি পান ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩৫ ভোট। এর পর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আ ক ম মোজাম্মেল হক। সেবার তিনি এই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আ ক ম মোজ্জাম্মেল। ওই নির্বাচনে তিনি ৪ লাখ ১ হাজার ৫১৮ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চৌধুরী তানবীর আহমেদ সিদ্দিকী পান ৯৪ হাজার ৭২৩ ভোট।

সারাবাংলা/টিকে/পিটিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন