বিজ্ঞাপন

‘দৃশ্যমান’ না হলে নতুন শহীদ মিনারে যাবেন না সংস্কৃতিকর্মীরা

December 2, 2023 | 5:17 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে নতুন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে নির্মিত অবকাঠামো ভেঙ্গে সেটিকে চারপাশ থেকে দৃশ্যমান করার দাবি জানিয়েছেন আপামর সংস্কৃতিজনেরা। এর আগপর্যন্ত বিজয় দিবসসহ অন্যান্য জাতীয় দিবসে এই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

সংস্কৃতিকর্মীদের সিদ্ধান্ত মেনে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী গত দুই বছরের ধারাবাহিকতায় সামনের বিজয় দিবসও অস্থায়ী শহীদ মিনারে পালনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। এছাড়া শহীদ মিনারকে দৃশ্যমান করার প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করতে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তও জানিয়েছেন মেয়র।

শনিবার (২ ডিসেম্বর) সকালে নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও সামনের বিজয় দিবস উপলক্ষে সংস্কৃতিজনসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মেয়র। এর আগে মেয়র শহীদ মিনার নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের খোলামেলা বক্তব্য শোনেন। নগরীর গণগ্রন্থাগার ভবনের নিচতলায় এ সভা সঞ্চালনা করেন নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার।

২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কে সি দে রোডে মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ভেঙে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণ করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে গণপূর্ত বিভাগ। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এর কাজ শুরু হয়। নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ও আটতলা অডিটরিয়াম ভবন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ২৫০ জন ধারণক্ষমতার একটি উন্মুক্ত গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ এবং ক্যাফে ও মিনি মিউজিয়াম। গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন।

বিজ্ঞাপন

২০২১ সালের অক্টোবরে আগের শহীদ মিনার ভাঙ্গার আগে সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। তারা দাবি করেছিলেন, বর্তমান অবয়ব ঠিক রেখেই সংস্কার করতে হবে। তখন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, শহীদ মিনারের মূল নকশার কোনো পরিবর্তন করা হবে না।

সংস্কার কার্যক্রম শেষে খুলে দেয়ার পর গত ১৮ নভেম্বর মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনার পরিদর্শন করেন। এসময় সংস্কৃতিকর্মীরা ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, মুসলিম হল ও শহীদ মিনারের মাঝামাঝিতে সড়কের ওপর সুড়ঙ্গ আকৃতির প্লাজা নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শহীদ মিনারটিকে ‘লোকচক্ষুর আড়ালে’ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উঠানামার পথ সংকুচিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, আবেগ এবং নান্দনিকতা- কিছুই নতুন এ স্থাপনায় ফুটে উঠেনি বলে তাদের অভিযোগ।

বিজ্ঞাপন

এ প্রেক্ষাপটে শনিবারের সভায় আহমেদ ইকবাল হায়দার বিদ্যমান অবকাঠামো ঠিক রেখে পশ্চিম পাশে শহীদ মিনারের সঙ্গে লাগোয়া একটি ১২ ফুট প্রশস্ত সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব করেন, যাতে উঠানামার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা এড়ানো যায়।

এর বিরোধিতা করে সভায় উপস্থিত নগর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘শহীদ মিনারে ঢোকার পথ কমপক্ষে ৩০ ফুট প্রশস্ত হতে হবে। বিভিন্ন দিবসে ফুল দেয়ার সময় মিছিলের পর মিছিল আসে। মিছিল নিয়ে ঢোকার সময় যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আগে যে শহীদ মিনার ছিল, সেখানে প্রবেশের পথটা অন্তঃত ৩০ থেকে ৩৫ ফুট ছিল।’

প্রবীণ জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত এবং ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত শহীদ মিনারের বিদ্যমান অবকাঠামো অক্ষুন্ন রেখে এর আবেগ-গাম্ভীর্য বজায় রাখা সম্ভব কি না, এমন প্রশ্ন তোলেন।

কবি কামরুল হাসান বাদল বলেন, ‘শহীদ মিনার নিয়ে যে সমস্যা তৈরি করা হয়েছে, রাস্তা নির্মাণ করে এর সমাধান হবে না। পুরো স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। সামনে টানেলের মতো যে প্লাজা করা হয়েছে সেটা ভেঙ্গে ফেলা হোক। শহীদ মিনার আগে যেমন ছিল তেমন হতে হবে। দৃশ্যমান করতে হবে। রাস্তা থেকেই যাতে আগের মতো শহীদ মিনার দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার বলেন, ‘শহীদ মিনারে ইট-পাথরের অবগুণ্ঠন আমরা মেনে নেব না।’

আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘শহীদ মিনারের সামনে সুড়ঙ্গ বানানোর কী প্রয়োজন ছিল, আমরা জানি না। এখন শহীদ মিনারটা ফ্ল্যাটবাড়ির মতো হয়ে গেছে।’

আহমেদ ইকবাল হায়দারের প্রস্তাব উল্লেখ করে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা বলেন, ‘এখন যেভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে, এর দুপাশে রাস্তা নির্মাণ করলেও এটা দৃশ্যমান হবে না। শহীদ মিনার যদি দৃশ্যমান করা না হয়, তাহলে আমরা এখানে ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবস পালন করবো না। আগে এটা ভেঙ্গে দৃশ্যমান করা হোক, তারপর এখানে জাতীয় দিবসগুলো পালন হোক।’

একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের সমাধানের দিকে যেতে হবে। এখানে তিনটি স্থাপনা যুক্ত হয়েছে- শহীদ মিনার, পাবলিক লাইব্রেরি এবং মুসলিম হল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হওয়ার কথা ছিল শহীদ মিনার, কিন্তু সেটাই সবচেয়ে ‍গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। একটা কর্পোরেট শহীদ মিনার বানিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা গণমানুষের শহীদ মিনার চাই। সামনের স্থাপনা ভেঙ্গে ফেললে আমার মনে হয় একটা সমাধান হয়ে যেতে পারে।’

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডাক্তার মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘শহীদ মিনার এবং সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স এ দুটোকে আলাদা করে ফেলা হোক। মেয়রের নেতৃত্বে একটি কমিটি হোক। কমিটি যাচাইবাছাই করে প্রয়োজনীয় প্রস্তাব করবে।’

একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন বলেন, ‘মেয়র মহোদয়, আপনি এই শহীদ মিনারের নকশা যিনি করেছেন, উনাকে ডাকুন, আরও কয়েকজন স্থপতিকে ডাকুন। যেভাবে শহীদ মিনার করা হয়েছে, এখানে উঠানামা বিদপজনক। সুতরাং এখানে উঠানামার পথটা আরও প্রশস্ত করে কিভাবে করা যায় সেটা ভাবতে হবে। সামনের টানেলটা সরিয়ে এটাকে দৃশ্যমান করতে হবে, সাথে সবুজ বজায় থাকতে হবে। মেয়র সাহেব স্থপতিদের সঙ্গে বসে এটা ঠিক করুন।’

আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, ‘আপাতত সামনের সুড়ঙ্গপথটা (প্লাজা) সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব আমরা করতে পারি। এটা করলে শহীদ মিনারের সামনে ফাঁকা জায়গা থাকবে। উঠানামার প্রশস্ত পথও পাওয়া যাবে। স্থপতিদের একটা প্যানেল করে এ বিষয়ে উনাদের মতামত নেয়া হোক।’

গণপূর্ত অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বদরুল আলম খান বলেন, ‘সামনের প্লাজা যদি আমরা ভেঙ্গে ফেলি তাহলে শহীদ মিনার আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু পাবলিক লাইব্রেরির ১৫ তলা ভবনের তুলনায় এটা তখন বামন হয়ে যাবে। তখন কি আবার ১৫ তলা ভবন ভাঙার কথা বলা হবে ?’

প্রকল্প পরিচালক লুৎফুর রহমান বলেন, ‘ভাঙার সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। যে কোনো পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও সরকারিভাবে নিতে হবে। আমরা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।’

সভাপতির বক্তব্যে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘সবার আলোচনায় দুটি বিষয় এসেছে। শহীদ মিনারকে দৃশ্যমান করা এবং দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলো এখানে না করা। আমি বক্তব্যের সঙ্গে একমত। শহীদ মিনারটি যেভাবে নির্মাণ হয়েছে, এটা মানুষকে খুঁজে নিয়ে দেখতে হবে, না হলে কেউ জানতেও পারবে না চট্টগ্রামে একটি শহীদ মিনার আছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার আগে যদি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একটু কথা বলত, তাহলে এ সমস্যা হতো না। অথচ শহীদ মিনারের জায়গাটিও সিটি করপোরেশনের।’

‘যাক, এখন আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে শহীদ বেদি উঁচু হতে হবে এবং এটা চারপাশ থেকে দৃশ্যমান হতে হবে। এজন্য কি করতে হবে সেই প্রস্তাবনা তৈরির জন্য একটি কমিটি করা হবে। কমিটিতে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা থাকবেন, সব শ্রেণি-পেশার লোক থাকবেন। কথা বলতে গেলে বছরের পর বছর চলে যাবে। দ্রুত আমরা কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করবো।’

মেয়র আরও বলেন, ‘আপনারা মতামত দিয়েছেন যে, শহীদ মিনারটা দৃশ্যমান না করা পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর এখানে পালন না করার জন্য। আপনাদের সঙ্গে আমিও একমত। ১৬ ডিসেম্বর আমরা মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে অস্থায়ী শহীদ মিনারে করবো এবারও।’

সভা শেষে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনার পরিদর্শন করেন।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাহিম উদ্দিন, সাংস্কৃতিক সংগঠক দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ, মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সভাপতি ডা. চন্দন দাশ ও সহ সভাপতি সুনীল ধর, নাট্যকর্মী শেখ শওকত ইকবাল, সুচরিত দাশ খোকন, সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সহ সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম আর আজিম, কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী ও আতাউল্লা চৌধুরী, নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তী ও অনন্য বড়ুয়া, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পাল, শিল্পী দীপেন চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী মিলি চৌধুরী এবং কণ্ঠনীড় আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি সেলিম রেজা সাগর।

সারাবাংলা/আরডি/এনইউ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন