বিজ্ঞাপন

মানবাধিকার ও শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র প‍্যারি কমিউন

December 10, 2023 | 2:09 pm

সৈয়দ আমিরুজ্জামান

১৫২ বছর পূর্বে সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র প‍্যারি কমিউন প্রতিষ্ঠিত। ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণি প্রুশিয়ান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির সাহায্য নিয়ে লড়াই করার বদলে যখন আত্মসমর্পণ করে বসলো, তখন প‍্যারির শ্রমিকরা বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করে নিল। তারা বুর্জোয়া পার্লামেন্টের বদলে স্থাপন করল কমিউন– যার প্রশাসনিক ও আইন তৈরির দু’রকম ক্ষমতাই ছিল। এর সদস্যরা নির্বাচিত হত সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে, এবং যে-কোনো মুহূর্তে তাদেরকে প্রত‍্যাহার করে নেওয়া যেত। স্থায়ী সৈন‍্যবাহিনী তুলে দিয়ে তার বদলে জনতাকে সশস্ত্র করা হল। পুলিশরা পুরোপুরি জনতার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এলো। ম‍্যাজিস্ট্রেট ও অন‍্যান‍্য সরকারি কর্মচারীরা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হত, তারা মাইনে পেত শ্রমিকদের মজুরির হারে। ইতিহাসে এই প্রথম সর্বহারাশ্রেণি বুর্জোয়াদের উৎখাত করে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই কমিউনার্ডরা যদিও মার্কসবাদী ছিল না তবুও তাদের হাতে এই নতুন রাষ্ট্র সর্বহারা একনায়কত্বেরই রূপ পেল– মার্কস ও এঙ্গেলস যেমনটা ভেবেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এঙ্গেলস লিখেছিলেন: আপনারা জানতে চান, সর্বহারা একনায়কত্ব কেমন দেখতে? প‍্যারি কমিউনের দিকে তাকান। এটাই হচ্ছে সর্বহারা একনায়কত্ব।

কমিউন মাত্র কয়েক সপ্তাহ টিকে ছিল। শ্রমিকশ্রেণির কোনো পার্টি ছিল না, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তখনও ছিল নিতান্তই শৈশবে, আর অভিজ্ঞতার অভাবে নেতারাও কয়েকটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন। শত্রুদের প্রতি তারা খুবই কোমল ছিলেন, শ্রমিক কৃষক মৈত্রীও তারা গড়ে তুলতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা, শহর-অবরোধকারী শত্রু সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য তাদের এত বেশি ব‍্যস্ত থাকতে হত যে, সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের জন্য তারা আদৌ সময়ই পাননি। … (লেনিন)

মে মাসের শেষে কমিউনের পতন ঘটলো এবং নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে প‍্যারির শ্রমিকরা সেই বুর্জোয়াদেরই রাইফেলবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হল, যারা মাত্র আশি বছর আগে সাম‍্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর ধ্বনি দিয়ে সামন্তবাদী রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তবুও, ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে, প‍্যারি কমিউন ব‍্যর্থ হয়নি।… এটা যে শুধু প্রথম সর্বহারা একনায়কত্ব ছিল তাই নয়, উপরন্তু এর সাংগঠনিক একক কমিউন ছিল রাশিয়ার শ্রমিক-প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলোর– যা সেখানে ১৯০৫ সালে, এবং আবার ১৯১৭ সালে গড়ে উঠেছিল– আদি রূপ। লেনিন লিখেছিলেন: পুঁজিবাদের অধীনে, এমনকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলিতেও, আমলাতান্ত্রিক ও বিচারবিভাগীয় বুর্জোয়া যন্ত্রটিকে বজায় রাখতে হয়, বাস্তবত শ্রমিকশ্রেণি ও সমগ্র মেহনতী মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবেই। একমাত্র রাষ্ট্রের সোভিয়েত সংগঠনই এই সেকেলে অর্থাৎ বুর্জোয়া যন্ত্রটিকে অবিলম্বে ও চিরদিনের জন্য চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। এ পথে প্রথম যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল প‍্যারি কমিউন। আর দ্বিতীয় পদক্ষেপ সোভিয়েত শাসনের।

১৮৭১ সালের অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত শিক্ষাকেই লেনিন মূর্ত করে তুলেছিলেন তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং তারই নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী পার্টির কাজের মধ‍্য দিয়ে।

সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থার জন্য মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব:

বিজ্ঞাপন

১০৬ বছর পূর্বে ১৯১৭ সালে জনগণের সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থার জন্য মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। রুশ বিপ্লব ১৯১৭ সালে সংগ‌ঠিত দুইটি বিপ্লবের মিলিত নাম। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় জার শাসনের অবসান হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান হয়।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংগঠিত প্রথম বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার সম্রাজ্য ভেঙে পরে এবং শেষ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে উৎখাত করে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে অন্তর্বতীকালীন সরকারকে উৎখাত করে বলশেভিক (কমিউনিস্ট) সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী মার্চ মাস) এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল তৎকালিন রাজধানী পেট্রোগ্রাদ (বর্তমানে সেইন্ট পিটার্সবার্গ) ও তার আশেপাশের অঞ্চল। বিশৃঙ্খলার মধ্যে, দ্যুমা ইম্পেরিয়াল সংসদ সদস্যরা একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন বলে অনুমিত হয়। সেনা নেতৃত্ব অনুধাবন করেন যে, সম্রাটের উৎখাতের ফলে যে জনদ্রোহ দেখা দিয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় তাদের হাতে নেই। সোভিয়েতরা (শ্রমিক কাউন্সিল), প্রথমদিকে অন্তরবর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন দিলেও একটি বিশেষ ক্ষমতা বলে তারা সরকার‌কে প্রভাবিত করতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর (১৯১৪-১৮) সামরিক বিপর্যরের প্রেক্ষাপটে ফ্রেব্রুয়ারি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। এ সময় সেনাবাহিনী বিদ্রোহম্মুখ অবস্থায় ছিল।

তৎকালীন রা‌শিয়ায় একটি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চলতে থাকে যেখানে অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের হাতে ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর সোভিয়েতদের হাতে ছিল জাতীয় পর্যায়ে সমাজের শ্রমিক শ্রেনী ও বামপন্থীদের আনুগত্যের ফলে প্রাপ্ত ক্ষমতা। এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে ঘন ঘন বিদ্রোহ, প্রতিবাদ ও ধর্মঘট সংগঠিত হতে থাকে। অন্তরর্বর্তীকালীন সরকার যখন জার্মানির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন বলশেভিক ও অন্যান্য সমাজাতন্ত্রিক জোটগুলো সংঘাত বন্ধের জন্য প্রচারণা চালায়। বলশেভিকরা শ্রমিক মিলিশিয়াদের রেড গার্ডস, পরবর্তিতে রেড আর্মিতে রূপান্তরিত করে এবং তাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।

বিজ্ঞাপন

১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুসারে নভেম্বর) মধ্য দিয়ে বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড ভ ই লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ও শ্রমিক সোভিয়েতরা পেট্রোগ্রাদের অন্তরবর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করে রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেশন সোস্যালিস্টিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করে। সেই সাথে রাজধানী মস্কোতে স্থানান্তর করা হয়। বলশেভিকরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের প্রধানের দায়িত্ব নেয় এবং গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ভিন্নমত দমন করা জন্য তারা সর্বত্র চেকা প্রতিষ্ঠা করে। মার্চ ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণ সমাপ্ত করার জন্য বলশেভিক নেতারা ট্রিটি অব ব্রিস্ট-লিটভস্ক স্বাক্ষর করে।

বলশেভিক (রেড) ও সমাজত্রন্ত্রবিরোধীদের (হোয়াইট) ও অন্যান্য অ-বলশেভিক সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ বেশ কয়েকবছর ধরে চলে এবং বলশেভিকরা তাদের বিরোধীদের পরাজিত করে। বলশেভিদের এই জয় ১৯২২ সালে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএসআর) প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন