বিজ্ঞাপন

মিশন ২০৪১: আমিই সল্যুশন— কেমন হবে আগামীর স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা?

December 17, 2023 | 10:05 pm

ডা. শবনম মোস্তারী

ডাক্তাররা বাড়িতে বাড়িতে গেলে কেমন সুবিধা হয় বলুন তো? হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা চেম্বারে গিয়ে অসুস্থ শরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে না, তাদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন সহজেই পড়া যাচ্ছে, প্রয়োজন হলেই হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে ডাক্তারদের— কী ভাবছেন, কল্পনা বিলাস? বাস্তবে সম্ভব নয়?

বিজ্ঞাপন

বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় এটি কিন্তু বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। আমাদের দেশের ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রযুক্তিবিদরাই তা সম্ভব করেছেন। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে লকডাউনের কারণে যখন রোগীদের পক্ষে সশরীরে চিকিৎসা সেবা নেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, তখন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় টেলিমেডিসিন সেবা। এই সেবার আওতায় রোগীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসা পরামর্শ নিয়েছেন। এমনকি রোগীদের ই-প্রেসক্রিপশন প্রদান এবং ভিডিও মিটিংয়ের সহায়তায় রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ সেবাও চালু করা হয়। এই টেলিমেডিসিন সেবার আওতায় রোগীর সব তথ্য সংরক্ষণ এবং ফলোআপের ব্যবস্থাও রাখা হয়।

টেলিমেডিসিন সেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে এবং এটুআইয়ের কারিগরি সহায়তায় জাতীয় পর্যায়ে কোভিড-১৯ ড্যাশবোর্ড তৈরি করা হয়। এই ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম রোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল পৃথকীকরণ, হাসপাতালের সক্ষমতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় লোকবল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ মাঠ পর্যায়ে নির্দেশিকা প্রদান এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ে লকডাউন কার্যকরের মতো নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সুবিধা হয়।

বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময়ে অতি অল্প সময়ে সীমিত রিসোর্স ব্যবহার করে যদি এত বড় পরিসরে সেবা প্রদান ও নীতি নির্ধারণ সম্ভব হয়, তবে এখন আমরা এমন স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা কেন পাব না?

বিজ্ঞাপন

ঠিকই তো, কেন পাব না? মূলত এ জন্যই পুরো বাংলাদেশকে ঢেলে সাজাতে নেওয়া হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের উদ্যোগ। এ উদ্যোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্যই ডিজিটাল থেকে স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবার দিকে ছুটে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু কী এই স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা?

এ ব্যবস্থায় সারাদেশের স্বাস্থ্যসেবাদান পদ্ধতিতে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা হবে। এতে দেশের প্রতিটি মানুষ এই ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় চলে আসবে। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সব নাগরিক পাবেন প্রযুক্তিনির্ভর সার্বজনীন চিকিৎসা সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও ঘরে বসেই প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা নিতে পারবে। পাওয়া যাবে উচ্চমানের সহজলভ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হোম ল্যাব।

প্রযুক্তি জ্ঞান ও তা ব্যবহারে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তৈরির কাজও চলছে। দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এরই মধ্যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, রোবোটিক্স, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিষয়ক ফ্রন্টিয়ার ভিত্তিক গবেষণা ও ইনোভেশন কালচার তৈরির লক্ষ্যে সেন্টার ফর এক্সিলেন্স/রিসার্স অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার গড়ে তোলার পক্ষে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন নিশ্চিতভাবে সম্ভব। কিন্তু এতটা নিশ্চিত আমরা কীভাবে হচ্ছি? কেননা বাংলাদেশে এরই মধ্যে সার্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য অনেক দূরে যাওয়ার প্রয়োজনই হচ্ছে না। তবে কথা তো হচ্ছিল ডিজিটালাইজেশন নিয়ে। তার কী হবে? সেটিও এরই মধ্যে বাস্তব রূপ পেতে শুরু করেছে।

শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রমের পুরোটাই অটোমেশনের আওতায় চলে এসেছে। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করা, রোগ নির্ণয় ও রোগীর স্বাস্থ্যবিষয়ক ইতিহাস পুরোটাই ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় করা হয়। অনেক রোগীই আগে কী ওষুধ খেয়েছেন, ডায়বেটিস কিংবা রক্তচাপ কেমন, তা ঠিকমতো বলতে পারেন না। আবার রোগীদের একেক দিন একেক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয় বলে ট্র্যাক রাখাও মুশকিল। কিন্তু এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাপের মাধ্যমে রোগীর সব তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। কিউআর কোড স্ক্যান করে নিমিষেই রোগীর স্বাস্থ্যবিষয়ক ইতিহাস জানতে পারেন ডাক্তাররা। ফলে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যকার স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া-নেওয়ায় ঘাটতির ঝুঁকি আর থাকছে না।

কিন্তু দেশের সবার জন্য এমনটি কীভাবে সম্ভব? কেউ যদি বাদ পড়ে যান? শতভাগ নিশ্চিত থাকুন, একজনও বাদ পড়বেন না। একজনও যেন বাদ না পড়েন, সে জন্য প্রতিটি নাগরিকের জন্য থাকবে স্মার্ট হেলথ আইডি। শেয়ারড হেলথ রেকর্ড সিস্টেমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। সার্বজনীন স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অন্যতম এ উদ্যোগেরও রয়েছে মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষিত সাফল্য। সে গল্প শুনতে আমাদেরকে সমতল ছাড়িয়ে যেতে হবে পাহাড়ে।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আলী কদম উপজেলার সব গর্ভবতী নারী হেলথ আইডি দিয়ে যেকোনো এলাকায় চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সব তথ্য ওই কার্ডে সংরক্ষিত থাকে। ই-এমআইএসের মাধ্যমে এই পেপারলেস স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। প্রতিটি দিনই ভারী রেজিস্ট্রার খাতা নিয়ে ঘোরার ঝক্কি থেকেও মুক্তি মিলেছে স্বাস্থ্যকর্মীদের।

বিজ্ঞাপন

উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং মা ও শিশু মৃত্যু রোধে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উদ্যোগে এবং অ্যাসপায়ার টু ইনোভেটের (এটুআই) সহযোগিতায় স্মার্ট প্রেগন্যান্সি মনিটরিং সিস্টেমটি চালু করা হয়েছে। সিস্টেমটি সন্তানসম্ভবা মা ও নবজাতকদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার জন্য ধারাবাহিকভাবে গর্ভাবস্থা পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি গর্ভকালীন অবস্থার বিভিন্ন তথ্যাদি সংরক্ষণ, গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান ও জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করতে পারবে।

স্বাস্থ্যকে শুধু স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে নয়, একে আমাদের বিজ্ঞান হিসেবে দেখতে হবে। কেননা স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নে প্রতিটি নাগরিককে দীক্ষিত হতে হবে ‘আমিই সল্যুশন’ মন্ত্রে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা এআই আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সাহায্য করবে। নতুন নতুন ওষুধ, হেলথ ডিভাইস ও ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন হবে। নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে চোখ রাখতে হবে বিশ্ববাজারে রফতানির ওপরও। প্রযুক্তি ও ডেটা নির্ভর মেশিং লার্নিং এবং এআইয়ের সহায়তায় আমাদের উদ্ভাবনগুলো হবে বিশ্বমানের। অর্জন করবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’খ্যাত ব্র্যান্ডের সুনাম।

গবেষণা ও উদ্ভাবনের এ পথে আমরা এরই মধ্যে সাফল্য পেতে শুরু করেছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি যেমন এআই, আইওটি ও বিগ ডেটা কাজে লাগিয়ে স্মার্ট ডিভাইস তৈরি করছে ইউনাইটেড ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাডভান্সড ইন্টেলিজেন্স মাল্টিডিসিপ্লিনারি সিস্টেমস ল্যাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স বিভাগের গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে সায়শ্রী ও দেশের ব্যবহার উপযোগী আল্ট্রা ভায়োলেট রুম ডিজইনফেকশন ডিভাইস। দূর নিয়ন্ত্রিত এই ডিভাইসের মাধ্যমে পানি, এমনকি বাতাসের জীবাণু ও ফাঙ্গাস ৯৯ দশমিক ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ধ্বংস করা যায়। এর মাধ্যমে সার্জারি পরবর্তী সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যাবে। পাশাপাশি করোনাভাইরাসের মতো অতি ছোঁয়াচে রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় তৈরি করা হয়েছে প্রেশারাইজড এয়ার পিউরিফাইং রেসপিরেটর। এর ফলে ব্যবহারকারীর শরীরে বায়ুবাহিত কোনো জীবাণু ঢুকতে পারবে না।

প্রতিদিনের জীবনযাপনে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন সুফল বয়ে আনে, তেমনি এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশেষত মোবাইল ফোনের স্ক্রিন আসক্তিজনিত কারণে প্রধান নন-কমিউনিকেবল রোগে পরিণত হবে বিষণ্ণতা। বাংলাদেশে এতদিন কমিউনিকেবল বা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকলেও বর্তমান বাস্তবতায় ক্রমেই নন-কমিউনিকেবল বা অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে, মানসিক অসুস্থতা যার মধ্যে অন্যতম প্রধান। কিন্তু যথাযথ গুরুত্ব ও সামাজিক সচেতনতার অভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগত উন্নয়ন আশানুরুপভাবে হয়নি। আর তাই স্মার্ট হেলথ বাস্তবায়নে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে প্রতিটি নাগরিক যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ পাবেন।

২০৩২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ চালুর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। যেকোনো ধরনের আর্থিক পরিস্থিতিই হোক না কেন, যখন ও যেখানে প্রয়োজন, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ সিস্টেম। দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ ইকোসিস্টেম তৈরি ও হেলথ কভারেজ মডেল তৈরির কার্যক্রম চলমান।

প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা-নির্ভর স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম ভিত্তি। ব্যক্তির চাহিদানির্ভর ওষুধ ও সেবা, পূর্ণাঙ্গরূপে ডিজিটালাইজড স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গবেষণা ও নিত্য-নতুন উদ্ভাবনই স্মার্ট স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বাস্তব সত্যে পরিণত করবে। আর এর প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন দেশের সবাই। জিরো ডিজিটাল ডিভাইড বা সহজ করে বললে ডিজিটাল বৈষম্য কমানো ও অংশগ্রহণে সমতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষটিও এই স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবার আওতার মধ্যে থাকবেন।

লেখক: পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট, এটুআই

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন