বিজ্ঞাপন

সমঝোতার আসনে ২ স্বতন্ত্রের দাপট, রুস্তমের পক্ষে বিএনপি-জামায়াত

December 30, 2023 | 10:16 am

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) থেকে: দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে পিরোজপুর-৩ আসনের নির্বাচনি প্রচার জমে উঠেছে। ভোটের মাঠে এই আসনে প্রার্থীর সংখ্যা আটজন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার অংশ হিসেবে এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মাশরেকুল আজম (রবি)। তবে স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেত্বাধীন জোটের এই প্রার্থীর তুলনায় বরং মাঠের লড়াইয়ে এগিয়ে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শামীম শাহনেওয়াজ ও ডা. রুস্তম আলী ফরাজী। ভোটের ফলে শেষ পর্যন্ত জাপার প্রার্থীকে ছাড়িয়ে এই দুজনের মধ্যেই লড়াই জমে উঠবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

বিজ্ঞাপন

গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই এই আসনের প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন প্রচারে। উত্তুরে হাওয়ার বয়ে আনা কনকনে শীতের পাশাপাশি ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করেই একদম সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচার। প্রতিদিন রাত ১১টা পর্যন্ত চলছে বিভিন্ন ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে উঠান বৈঠক। পাশাপাশি চলছে গণসংযোগ, লিফলেট বিলি। দেয়ালে আর অলিগলিতে পোস্টার তো আছেই। সঙ্গে রয়েছে মাইকিং করে ভোট প্রার্থনা। প্রচারের এই লড়াইয়ে আপাতত সমঝোতায় পাওয়া আসনেও পিছিয়ে রয়েছেন জাপা প্রার্থী। সে তুলনায় স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীই রয়েছেন এগিয়ে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-৩ আসনটি। এই আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল আশরাফুল ইসলামকে। পরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে দরকষাকষিতে আসনটি তাদের ছেড়ে দিতে হয়। আশরাফুল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে টিকে যান মো. মাশরেকুল আজম রবি। তবে আশরাফুলের বড় ভাই শামীম শাহনেওয়াজ এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

এদিকে আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এই আসনে বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়ে এমপি হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ার হোসেনের কাছে। পরে ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সেই আনোয়ারকে হারিয়েই আবার এমপি হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার জাতীয় পার্টি থেকে এমপি হন তিনি। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী তিনি।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা বলছেন, ভোটের মাঠে রুস্তম আলী ফরাজী এবং শামীম শাহনেওয়াজ সমানতালে পাল্লা দিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। আওয়ামী লীগ এই আসনে প্রার্থী সরিয়ে জাপাকে সমর্থন জানালেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ এককভাবে কোনো প্রার্থীর পক্ষেই নেই। অল্প কিছু নেতাকর্মী কেন্দ্রের সমর্থনের সূত্র ধরে জাপা প্রার্থী মাশরেকুলের পক্ষে কাজ করলেও বেশির ভাগই কাজ করছেন দলের মনোনয়ন পেয়েও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া আশরাফুলের বড় ভাই শাহনেওয়াজের জন্য। আবার খুব সামান্য একটি অংশ বর্তমান এমপি রুস্তম ফরাজীর পক্ষে কাজ করছে।

তবে আওয়ামী লীগ এবং নিজ দল জাতীয় পার্টি থেকে খুব একটা সমর্থন না পেলেও বিএনপি ও জামায়াতের একটি অংশ রুস্তম ফরাজীর পক্ষে সক্রিয় বলে তথ্য মিলেছে। তারা সাধারণত প্রকাশ্যে না এলেও মঠবাড়িয়া বিএনপির নারী কর্মীদের অনেককে রুস্তমের পক্ষে লিফলেট বিতরণ করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ‘জ’ অদ্যাক্ষরের এক নারী কর্মী এই প্রতিবেদককে বলেন, স্থানীয় নেতাদের অনুমতি নিয়ে লিফলেট বিলি করছেন তিনি এবং তার মতো আরও অনেকেই। বিনিময়ে প্রতিদিন পাচ্ছেন ৩০০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা বলেন, কেবল নারী নয়, বিএনপির পুরুষ কর্মীরাও রুস্তুম ফরাজীর পক্ষে গোপনে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তার দাবি, মূলত আর্থিক সুবিধার জন্যই তারা এভাবে কাজ করছেন। অন্যদিকে জামায়াতের নেতাকর্মীরাও নিজ নিজ এলাকায় গোপনে রুস্তম ফরাজীর পক্ষে কাজ করছেন। ওই নেতা বলেন, ‘নির্বাচনি প্রচারের কাজে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এই নির্দেশনা আমরা হোয়াটসঅ্যাপে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি।’

এ পরিস্থিতিতে আলোচিত তিন প্রার্থীর মধ্যে ‘সমঝোতার প্রার্থী’ জাপার মাশরেকুলের অবস্থানই সবচেয়ে নাজুক। এলাকাবাসীর মতে, রুস্তম ফরাজী আর শাহনেওয়াজের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। তবে গতকাল শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) বরিশালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জনসভার পর রুস্তমের মাঠ কিছুটা হলেও টলে গিয়েছে। জনসভায় শেখ হাসিনা নৌকা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের জন্য ভোট চেয়েছেন।

অথচ এতদিন রুস্তম ফরাজী নিজেকে শেখ হাসিনার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের সূত্রে নিকটজন বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশের সমর্থন তার প্রতি থাকায় রুস্তমের সে দাবি অনেকেই অগ্রাহ্য করতে পারেননি। তবে বরিশালের জনসভায় শেখ হাসিনা উন্মুক্তভাবে ভোট দেওয়ার কথা না বলে নৌকা বা আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের ভোট দেওয়ার কথা বলায় রুস্তমের পক্ষে আওয়ামী লীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে। তার প্রচার শিবিরে কিছুটা হতাশাও ভর করেছে বলে জানা গেছে।

এদিকে রুস্তম ফরাজীর বিরুদ্ধে গত দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকাকালে টিআর, কাবিখা ও বিশেষ বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ বা নিজস্ব লোকজনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ তুলছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা। পানির ট্যাংক বিতরণে অনিয়ম, মঠবাড়িয়া ডায়াবেটিস সমিতির কার্যালয় দখল করে মেয়ের নামে লিজ নেওয়া, প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করে টাকা তুলে নেওয়ার মতো অভিযোগও করছেন তারা। জানান, এসব অভিযোগ লিখিত আকারে দাখিল করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।

বিজ্ঞাপন

বেতমোড় ইউনিয়নের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধ বাদশা বলেন, ‘রুস্তুম আলী ফরাজী একজন মামলাবাজ। তিনি গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিধন করেছেন। তার হাত থেকে আমিও রক্ষা পাইনি। দুদক বা অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা তদন্ত করলে তার সব অপকর্মের তথ্যপ্রমাণ বেরিয়ে আসবে। নির্বাচনি প্রতিটি সভায় এসব কথা তুলে ধরা হচ্ছে।’

এ বিষয় জানতে ডা. রুস্তম আলীর মোবাইল ফোনে কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি। তবে তার নির্বাচনি প্রচার কমিটির আহ্বায়ক আরিফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সমর্থন দিয়েছে জনগণ। নির্দিষ্টভাবে বিএনপি বা জামায়াত ইসলাম বলতে কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন করেছে, বিষয়টি এমন না। জনগণ আমাদের পক্ষে আছে, এটিই সবচেয়ে বড় কথা।’

মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধ ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ফারুকুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যে অংশ রুস্তম ফরাজীর পক্ষে আছে, দুয়েকদিনের মধ্যে বৈঠক করে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। তারা যদি ফিরে না আসে, তাহলে আমরা কেন্দ্রকে জানাব। কারণ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশলের জনসভায় আওয়ামী লীগের শক্তির পক্ষে থাকা এবং সেই শক্তিকে নির্বাচনে জয়লাভ করানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর জন্য এই নির্দেশ শিরোধার্য। আশা করি এই নির্দেশের বাইরে কেউ যাবে না।’

অন্যদিকে মঠবাড়িয়া পরিসংখ্যান কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ বছর এই আসনে নতুন ভোটার প্রায় ২০ হাজার। তরুণ এই ভোটারদের সিংহভাগই স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম শাহনেওয়াজের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারে সরব।

মঠবাড়ীয়া উপজেলার বড়মাছুয়া ইউনিয়নের নিজামীয়া ওয়ার্ডে নতুন ভোটার হওয়া আরিফের সঙ্গে প্রায় ৭০ জনের একটি দল মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাতে। এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আরিফ বলেন, ‘এবার নতুন ভোটার হেয়ছি। আমাদের এখানকার নতুন ভোটারদের মোটামুটি একত্রিত করেছি। আমরা একসঙ্গেই ভোট দেবো।’ আরিফ জানালেন, তার সঙ্গীরাও সবাই মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। তারা সবাই শাহনেওয়াজের পক্ষেই কাজ করছেন।

শামীম শাহনেওয়াজের নির্বাচনি পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টা হারুন অর রশিদ পঞ্চাইত সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বর্জন করেছে। অথচ তারা এই নির্বাচনে রুস্তম আলী ফরাজীকে সমর্থন দিয়েছে। তাদের এই দুমুখী আচরণেই স্পষ্ট, তারা দেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করতে চাইছে। তাদের আচরণে আরও বেঝা যায়, তারা স্বাধীনতার বিরোধীপক্ষের প্রেসক্রিপশনে বা তাদের খুশি করতে অগ্নিসন্ত্রাসসহ নানা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে ফয়দা লুটতে চাইছে। কিন্তু সচেতন মানুষ সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, উন্নয়নের পক্ষে। তারা ভোট দিয়ে শামীম শাহনেওয়াজকে বিজয়ী করবে।’

পিরোজপুরের এই আসন থেকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. আমির হোসেন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতি মুক্তিজোটের মো. জাসেম মিয়া, তরিকত ফেডারেশনের মো. শহিদুল ইসলাম, কল্যাণ পার্টির মো. শহিদুল ইসলাম স্বপন ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের হোসাইন মোশারফ সাকু। তবে স্থানীয়রা এবং ভোটাররা জানালেন, এসব প্রার্থীর কেউই ভোটের মাঠে নেই।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন