বিজ্ঞাপন

‘রবীন্দ্রনাথের গানের গল্প, গল্পের গান’ নিয়ে রয় অঞ্জন

December 30, 2023 | 2:52 pm

সাহিত্য ডেস্ক

লেখক রয় অঞ্জন। গল্পকার, কথাসাহিত্যিক এবং গবেষক। লেখালেখির হাতেখড়িটা হয়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখে। প্রথম বই, ‘রবি বাউলের শান্তিনিকেতন’। মাঝখানে আরও ২টা কাজ আছে- একটি ভ্রমণ বিষয়ক ‘পথিক পরান’ এবং দ্বিতীয়টি দলিত শ্রেণী নাপিত সম্প্রদায়কে নিয়ে ‘খেউরি ঘর’ নামে একটি উপন্যাস।

আবারও কাজ করলেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই। রবীন্দ্রনাথের লেখকসত্ত্বার প্রতি তীব্র আকর্ষণ তাকে বারবারই কবিগুরুকে নিয়ে কাজ করায় অনুপ্রেরণা যোগায় বলে বিশ্বাস তার। এবারের বই রবীন্দ্রনাথের গানের গল্প ও গল্পের গান নিয়ে। গানের পেছনের বা গান সৃষ্টির গল্প, গান নিয়ে কবির ভাবনা, কিছু গান আছে- সেগুলি প্রকাশিত বা প্রচারিত হওয়ার পরে মানুষের যে প্রতিক্রিয়াটা হয়েছিল, এইসব কিছু বিষয় নিয়েই এই গ্রন্থ, “রবীন্দ্রনাথের গানের গল্প, গল্পের গান”।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখালেখির ভুবন সম্পর্কে সারাবাংলা কথা বলেছিল কথাসাহিত্যিক রয় অঞ্জনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে থাকছে কথোপকথনের কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ —

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: আবারও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ। কী আছে এই বইয়ে?

রয় অঞ্জন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে বিশাল রত্নভান্ডার- তারমধ্যে যেখানে তিনি সবচেয়ে উন্মুক্ত, যেখানে তিনি নিজেকে একটুও ঢেকে রাখেননি, তা হচ্ছে গান। সেই গান নিয়ে বা গানের এমন একটা প্রেক্ষাপট নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্র তো বিশাল, বিস্তর। আমি বলবো অসীম। কিন্তু গানের তথ্য নিয়ে বিশদ কাজ করা কারোরই এক জীবনে শেষ করা সম্ভব নয়। তবুও রবীন্দ্রসংগীতপ্রেমীদের তৃষ্ণার কথা ভেবে এবং বইয়ের অবয়বের কথা মনে রেখে সর্বোপরি পাঠকের ক্রয় ক্ষমতার কথা ভেবে এই বইতে বহুশ্রুত ১০১টি গানের গল্প রেখেছি বর্ণানুক্রমে। রবীন্দ্রনাথের গান যেভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত নাম পেলো তার কালানুক্রমিক পরিবর্তনের গল্পটা আছে। বাংলাদেশ, ভারত এবং শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীত রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানের কথা আছে এই বইয়ে। আরো রেখেছি তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার পরিচালিত বিভিন্ন সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহার, রবীন্দ্রনাথের গানে বিদেশী সুরের প্রভাব এবং শান্তিনিকেতনের একজন নিভৃতচারী রবীন্দ্র সঙ্গীত গবেষক কর্তৃক অনুবাদকৃত কিছু সাঁওতালি গান, যা আজ পর্যন্ত কোথাও প্রকাশিত হয়নি, আলোতে আসেনি। সব মিলিয়ে ১৪৩খানা গান ও গানের গল্প নিয়ে আমার এবারের প্রচেষ্টা।

সারাবাংলা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণার আগ্রহ তো আপনার বহুদিনের এবার কেন শুধু তার গানকেই বিষয়বস্তু করলেন?

বিজ্ঞাপন

রয় অঞ্জন: দেখুন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি জগতের যতগুলি কর্ম আছে, তার মধ্যে আমার মনে হয় তিনি গানেই সবচেয়ে বেশি উন্মুক্ত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গান সব সময়েই আধুনিক। জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নাই, যেখানে আমরা কবিগুরুর গানকে পাই না। সুখ, শোক, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা এমনকি উল্লাসে- উচ্ছ্বাসে সবখানেই তার গানকে পাই, গানের সামিয়ানার তলায় আশ্রয় নিতে পারি অনায়াসে। তাছাড়া বাঙ্গালী মাত্রই রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনি, অনেকে গান গেয়েও থাকেন। আমার উপলব্ধিটা ঠিক এখানেই। আমি ভেবেছি অনেক রবীন্দ্র প্রেমী বা সংগীতপ্রেমী, যারা গান শোনেন, গুণগুণ করেন গান গেয়ে থাকেন গানের বাণীতে বিভোর হয়ে, তাদের হয়তো মনেহয়- আহ্, এমন সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব! আমি নিজেও বারবার বিস্ময়াভিভূত হই গান শুনে। সেই তাগিদ থেকেই গানের গল্পের অন্বেষণে ডুবে যাই। একসময় মনে হলো এই আমাদের মতো সংগীত পিয়াসীদের মনের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য কিছু করা যায় কিনা৷ আর যারা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে থাকেন, অন্তরে ধারণ করেন তাদের জন্য ভেবেছি – কণ্ঠে তুলে নেওয়া গানটির ভেতরের কথা শিল্পীরাই তো সবচেয়ে বেশি করে অনুভব করতে পারেন! গুরুদেব কোন প্রেক্ষাপটে কোন গান রচনা করেছিলেন কিংবা গেয়েছিলেন, তা জানলে তাদের ভালোলাগা হবে সীমাহীন এবং তৃপ্তির। জানি অনেকেই হয়তো জানেন অনেককিছুই। আবার অনেকে আছেন জানতে আগ্রহী, আমি সেইসব সংগীতপ্রেমীদের জন্যই রবীন্দ্রনাথের গানকে বেছে নিয়েছি, সর্বপরি নিজের ভালোলাগা তো আছেই। আমার এই প্রয়াস রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনের আশ মেটাতে পারে যদি, তাহলেই আমার এই চেষ্টা সার্থক হবে।

সারাবাংলা: রবীন্দ্রনাথের চেতনার জগত উন্মোচনে কোন বিষয়টি আপনাকে অনুপ্রেরণা যোগায়?

রয় অঞ্জন: খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। কিন্তু আমি বলতে চাই রবীন্দ্রনাথ একটা বিশাল আকাশের সমান। তাকে আত্মিককরণ সম্ভব না হলেও নিরালায় থেকে রবীন্দ্রনাথের সাথে আত্মীয়তা করা সম্ভব। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ আমার রবীন্দ্রনাথ না হলেও তিনি আমার আত্মার আত্মীয়। তাই তাকে কখনও ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ ভাবার স্পর্ধা দেখাতে না পারলেও তিনি যে ‘আমারও রবীন্দ্রনাথ‘ কিংবা ‘আমি রবীন্দ্রনাথের’ তা ভাবলে পুলকিত হই! এককথায় বলতে গেলে, আমি নিজেকে রবীন্দ্র আশ্রয়ী বলতে পারি।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কী আপনার জীবনে এসেছে কখনও?

রয় অঞ্জন: অসংখ্যবার। একবারের কথা বলছি। ঘটনাটির মধ্যে আমার সাথে গুরুদেবের একটা অদ্ভুত সাজুস্য পেয়েছি। সেটা হলো আপনজনের মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার মধ্যে গুরুদেব নিজের ছায়া দেখতে পেতেন। পুত্রকে স্নেহ করে সমু বা সমী বলে ডাকতেন। সেই সমু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় মারা গেলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যুর মিছিলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা। পুত্রশোকে বিহ্বল পিতা রবীন্দ্রনাথ তখনো স্বাভাবিক ছিলেন। সমী সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি নির্লিপ্তভাবে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলেছিলেন, “সমীকে রেখে এসেছি”!

গতবছর তেমনই একটা ঘটনা ঘটেছে আমার বেলায়ও। তখন ঢাকায় অমর একুশে বইমেলা চলছে। স্টলে তখন আমার ‘খেউরি ঘর’। আমার জেঠতুতো ভাই বিজিতদা বইমেলার অদূরের হাসপাতালে, ডাক্তার শেষ কথা জানিয়ে দিয়েছেন। সেদিন বিকেলেই বিজিদতাকে আইসিউ এম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়ি রওয়ানা করে দিলাম। তার সারা শরীর জীবনরক্ষাকারী মেশিনপত্রে মোড়ানো। আমরা জানতাম, মেশিন খুলে দিলেই বিজিত দা শেষ এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ‘শেষ’ হয়েও গেলেন। সেই সময়েই আমার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ভর করলেন। আমি সব ভাবনা ঝেড়ে চলে এলাম বইমেলায়, যেন কিছুই হয়নি, কিছুই ঘটেনি। তখন মনে হচ্ছিল, মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আমিও রবীন্দ্রনাথ!

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: এই বিষবস্তু নিয়ে লেখার অনুপ্রেরণার কথা যদি জানতে চাই, কী বলবেন?

রয় অঞ্জন: অনুপ্রেরণার কথা বলতে গেলে শব্দটাকে ২ টা ভাগে ভাগ করেই বলব। প্রেরণা এবং অনুপ্রেরণা। গান নিয়ে লেখার প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, তার সৃষ্টি, সৃষ্টির মহিমা আর আমার গানপ্রিয় মন। আর অনুপ্রেরণা, সেটা পেয়েছি বইটা যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই নিয়ে একটু বিশদভাবে বলতে চাই। ঢাকার বইমেলায় একবার দেখা হলো পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ডঃ রতন সিদ্দিকী স্যারের সাথে। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যার অগাধ জ্ঞান। তিনি সেদিন একটা কথা বলেছিলেন, “ অঞ্জন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করতে হলে ধ্যানের মতো করতে হয়, চৌদিকে মন দিলে অন্তত রবীন্দ্রনাথকে ধরা যায় না। ” সেই থেকে শুরু। আরও আছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক শ্রদ্ধ্বেয় অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়, ব্রাহ্মনবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানবর্দ্ধ্বন পাল মহাশয়ের সরাসরি অভিভাবকত্ব। এই তিনজন মানুষ আমার প্রণম্য। তাদের কাছে যা পেয়েছি তা অমূল্য। সর্বশেষে পেলাম অধ্যাপক যতীন সরকার মহোদয়কে। নেত্রকোণার এই প্রাজ্ঞজন। যাকে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি , যিনি একদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষক, অন্যদিকে অনেক লেখকেরও শিক্ষাগুরু। তাদের অনুপ্রেরণাই এবং ঐকান্তিক সহযোগীতায়ই সৃষ্টি হলো ‘রবীন্দ্রনাথ এর গানের গল্প-গল্পের গান’ গ্রন্থটি।

সারাবাংলা: আপনার ভাবনা এবং বইতে যা রেখেছেন, এখানে কী কোন অপূর্নতা আছে মনে করেন? মানে আরো কিছু রাখতে চাইছিলেন, অথচ রাখেননি বা পারেন নি?

রয় অঞ্জন: সে তো অনেকই আছে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে লেখায় সবসময়ই এবং সকলেরই অপূর্ণতা থাকে, আমার বেলায়ও একই। অনেক কিছু রাখতে চেয়েছিলাম, যেমন ইচ্ছে ছিল প্রতিটি গান সম্পূর্ণভাবে রাখতে, কিন্তু বইয়ের অবয়ব বা পরিসরের কথা চিন্তা করে এবং পাঠকগনের ক্রয় ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে সেদিকে যাইনি। তবে একটা কথা ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি যে, এখন মুঠোফোনের যুগ। কোন পাঠক যদি তার পছন্দের গানটি দেখতে চান, তবে তার মুঠো ফোনে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন।

সারাবাংলা: বইটির প্রচ্ছদ ও প্রচ্ছদ ভাবনা নিয়ে কিছু বলেন?

রয় অঞ্জন: আমার চারটি বইয়েরই প্রচ্ছদ শিল্পী হলেন আমারই বন্ধু, খ্যাতনামা চারুশিল্পী বিপুল শাহ। বিপুল শাহ এর একটা বড় গুন আমাকে খুবই আকৃষ্ট করে। তিনি পলকেই আমার মনের ভাষাকে পড়তে পারেন। প্রতিবারই এমনটা হয়েছে। এবারে যখন প্রচ্ছদ নিয়ে কথা বলতে তার কাছে গেলাম, বললাম সবকিছু। তখন বিপুল শাহ এমন একটা কাজ করলেন, যা আমি কোনদিনও ভুলবো না। আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগে কোন এক ২৫শে বৈশাখে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ছবি একেছিলেন, যা কখনও- কোথাও প্রকাশ করেননি। দিব্য রবীন্দ্রনাথ যেন। যার অবয়বে আভিজাত্য, এক চোখে স্বপ্ন অন্য চোখে বেদনা প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। চিরদিনের নতুন এবং সবুজ রবীন্দ্রনাথকে আঁকতে গিয়ে সবুজের ছোঁয়া রাখতেও ভোলেননি। সেই রবীন্দ্রনাথকেই তিনি প্রথম আমার বইতে সোৎসাহে তুলে দিলেন!

তখনকার অনুভূতির কথা যদি বলি, তাহলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই বলতে হয়, এ যেন সেই “দিব্য- প্রজ্ঞা স্বরস্বতীর” মতো , যা তিনি আঁকতে বলেছিলেন মুকুল চন্দ্র দে’কে। বিপুল শাহ তা ই আঁকলেন এখানে।

সারাবাংলা: আগামীতেও কী রবীন্দ্রনাথে থাকতে চান?

রয় অঞ্জন: দেখুন, লেখালেখিতে আমি এখনো যথেষ্ট নবীন। তবে যেহেতু আমার ভাবনায়, চেতনায় রবীন্দ্রনাথ আছেন মহীরুহ হয়ে, যতদিন পারি তারই ছায়াতলে থাকতে চাই।

সারাবাংলা: বইয়ের প্রকাশ ও প্রকাশককে নিয়ে কিছু বলুন।

রয় অঞ্জন: আমার আগের বইগুলির মতো এবারে বইটিও প্রকাশ করছে দেশের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ভাষাচিত্র’। ভীষণ স্বপ্নবাজ মানুষ হলেন খন্দকার সোহেল, যিনি ভাষাচিত্রের কর্নধার। অত্যন্ত প্রগতিশীল এই মানুষটিকে একটি কারণে আমার বিশেষ পছন্দ। তিনি বই প্রকাশ এবং বইয়ের নানামুখীতার বিষয়ে খুবই যত্নশীল। যেমন, আমার এবারের বইটি তিনি প্রথম প্রকাশ করবেন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়, যা জানুয়ারিতে হতে যাচ্ছে, এরপরে আসবে ঢাকার অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এজন্য ভাষাচিত্রের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন