বিজ্ঞাপন

পরিবর্তন চায় তানোর-গোদাগাড়ীর মানুষ

December 30, 2023 | 10:28 pm

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী)। স্বাধীনতার পর এই আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকে তিনবার মন্ত্রী হয়েছে। বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি টানা তিন বার এই আসন থেকে জয়লাভ করেছেন। তবে এবার পরিবর্তন চাচ্ছেন সেখানকার ভোটাররা। সেজন্য খুঁজছেন বিকল্প প্রার্থী। এই আসনে এবার ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে কেউ-ই ছাড় দিতে চায় না ওমর ফারুক চৌধুরীকে।এই দুই উপজেলার সাধারণ ভোটাররা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাড়া অন্য প্রার্থীদের সম্ভাবনা দেখছেন না। এই আসনে রয়েছেন চার জন স্বতন্ত্র প্রার্থী, যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে আলোচনায় আছেন চিত্রনায়িকা শারমিন আক্তার নিপা (মাহিয়া মাহি), তানোর উপজেলার সাবেক সভাপতি ও মুণ্ডুমালা সাবেক পৌর মেয়র গোলাম রাব্বানী, আওয়ামী লীগের শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য আয়েশা আক্তার ডালিয়া ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান আক্তার।

বিজ্ঞাপন

তারা নিজ নিজ যায়গা থেকে প্রচার চালাচ্ছেন। এ চার প্রার্থীই বলছেন- টানা ১৫ বছর ওমর ফারুক চৌধুরী নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছেন। সেবক নয়, এলাকায় ‘শাসক’ হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এর প্রতিবাদেই তারা ভোটের মাঠে নেমেছেন। ভোটের মাঠে ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে অগ্নিঝরা বক্তব্য সবচেয়ে বেশি দিচ্ছেন মাহিয়া মাহি।

এলাকার ভোটাররা বলছেন, ওমর ফারুক চৌধুরী শুধু ক্ষমতায় থেকেছেন। এই এলাকায় তার উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। তিনি তার পক্ষে কাজ করতে চাপও সৃষ্টি করছেন। এছাড়াও তার অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড রয়েছে তার। তবে এবার এই আসনে পরিবর্তন দরকার। এমন মানুষ ভোটে জিতে আসুক যিনি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজ শিক্ষক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফারুক চৌধুরী এই এলাকায় জমিদারদের মতো থাকেন। তিনি সাধারণ মানুষের কষ্ট বোঝেন না। সরকারি সব সহায়তা তিনি নিজের নামে প্রচার করেন। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীও আছে। এছাড়াও তার আশেপাশে থাকা মানুষগুলোও অনিয়ম করে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে।’

বিজ্ঞাপন

গোদাগাড়ী এলাকার বিজয়নগর গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘তিনি তিন বারের এমপি। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাকে আমাদের এলাকায় একবারও দেখিনি। তিনি সবসময় তানোরে থাকেন। আমাদের কাছে আসেননি। আমাদের সমস্যাও শোনেননি। আমাদের গ্রামে আসেন তার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন সোহেল। কিন্তু ওমর ফারুককে কোনোদিন আমরা পাইনি।’

তানোর উপজেলার কাশিমবাজার এলাকার ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই বাজারে আমি দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা করছি। এমপি ফারুক চৌধুরী কোনোদিন এই বাজারে নামেননি। তিনি এক কাপও চাও খেয়ে যাননি। ভোটের প্রচারের ১০ দিন হয়ে গেল তাকে এখনও দেখিনি। কিন্তু অন্য প্রার্থীরা এসেছেন এলাকায়। শুধু ফারুক চৌধুরীর কর্মীরা প্রচার করে গেছেন। একজন এমপি হিসেবে অবশ্যই তার এলাকার জনগণের খোঁজখবর রাখা দরকার। কিন্তু তিনি তা করেননি।’

এর আগে, এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে সমালোচিত হন। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে রেষারেষি, নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বিভিন্ন পদে বসানো, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজের আত্মীয় ও অনুসারীদের মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সখ্যতার খবরও মানুষের মুখে মুখে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ এর এক প্রতিবেদনেও মাদকসংশ্লিষ্টায় তার নাম এসেছে।

বিজ্ঞাপন

দুই উপজেলার বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলছেন, হয়তো এবার এই আসনে পরিবর্তন হতে পারে। ভোটাররাও আর চাচ্ছেন না এমপিকে। দলীয় মনোনয়ন পেলেও অনেকে সরে গেছেন তার কাছ থেকে। দীর্ঘ সময় ওমর ফারুক চৌধুরী যেমন জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তেমনি নিজস্ব কিছু কর্মী বাহিনীও তৈরি করেছেন। তাছাড়া তিনি তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে দুই উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন ভাতাভোগীদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন। নৌকায় ভোট দিলে এ ভাতা দ্বিগুণ হবে- এমন কথা তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে ঢুকিয়েছেন। দুই উপজেলার স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সব সময়ই নিজের পক্ষে কাজে লাগান তিনি।

তবে এই এলাকার ভোটার ও রাজনৈতিক কর্মীরা বলছেন, চার স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমঝোতা করতে হবে। না হলে ভোট ভাগ হয়ে যাবে। আর এতে লাভবান হবে ফারুক চৌধুরী। সেক্ষেত্রে তার আবারও বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফারুক চৌধুরীকে ঠেকাতে স্বতন্ত্র চার প্রার্থীর মধ্যে সমঝোতার কথা ভাবছেন দলেরই কেউ কেউ। আওয়ামী লীগেরই এক নেতা এ উদ্যোগ নিচ্ছেন, এমন কথা বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে।

এদিকে, ভোটের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরীকে মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি ধরনেনি। তাই তার কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য আয়েশা আক্তার ডালিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি গোদাগাড়ীর মেয়ে। এখানকার আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছি। তানোর-গোদাগাড়ী উপজেলার মানুষের সুখ-দুঃখও বুঝি। তাদের কাছে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে চাই। তাদের মায়া-মমতা ও ভালোবাসার চাদরে ডেকে রাখব। এজন্য আমাকে নির্বাচিত হতে হবে। এখানকার মানুষও আমাকে চায়। আমি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।’

বিজ্ঞাপন

আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী। তিনি ওমর ফারুক চৌধুরী বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাকে ধরা হচ্ছে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন থেকে তানোর-গোদাগাড়ীবাসী বঞ্চিত। এখানকার এমপি ও তার বাহিনীর শুধু উন্নয়ন হয়েছে, সাধারণ মানুষের হয়নি। আমি এখানকার ইউপি চেয়ারম্যান ও মেয়র ছিলাম। লাঠিয়াল বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে যে ভোট পড়বে, তার ৭০ ভাগ আমি একাই পাব।’

স্বতন্ত্রপ্রার্থী চিত্রনায়িকা শারমিন আক্তার নিপা (মাহিয়া মাহি) আগে এ দুই উপজেলায় তেমন সক্রিয় ছিলেন না। শুধু নিজের নানার বাড়ি তানোরের মুণ্ডুমালা এলাকায় কিছু সামাজিক কাজকর্ম করতেন। তবে প্রচার শুরুর পর থেকে ভোটের মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছেন। হাটে, ঘাটে, মাঠে থেকে শুরু করে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি পর্যন্ত যাচ্ছেন তিনি। সবখানে তিনি ‘চৌধুরীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে’ ভোট করছেন ঘোষণা দিয়ে ভোটারদের সবসময় সম্মান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এছাড়া বছরের পর বছর বরেন্দ্র অঞ্চলে যে পানির সমস্যা, তা নিরসনের কথা বলছেন। ফলে যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই ভালো সাড়া পাচ্ছেন ঢাকাই সিনেমার এ চিত্রনায়িকা। এই কয়েক দিনের প্রচারেই ভোটের মাঠে তিনি অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।

এ আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান আক্তারও নিজের মতো করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনিও বর্তমান এমপি ফারুকের বিরোধী। তাকেও আসনটির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ধরা হচ্ছে। আখতারুজ্জামান গোদাগাড়ীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত বছর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন। দলীয় প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন মাত্র ৩২ ভোটে। আখতারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ছাত্রজীবন থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আসছি। এখনও তাই করি। এলাকার ভোটাররা খুবই ভালোবাসে আমাকে। তারা আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চাচ্ছে। আশা করি, আমি নির্বাচনে জয়লাভ করব।’

তবে কোনো প্রার্থীই নির্বাচনের প্রচারে বাধার মুখে পড়ছেন না বলে জানান তিনি। তবে এক প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকটি গ্রামে ঘুরেছি। একটি বিশেষ দলের প্রার্থীর লোকরা ভোটারদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ওই প্রতীকে ভোট না দিলে বাড়ির বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হবে। সরকারি কোনো সুবিধা দেবে না। ভাতা বন্ধ করে দেবে।’ এছাড়াও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরেক নারী প্রার্থী নুরুন্নেসা। তিনি ন্যাশনাল পিপলস পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নিজে নারী হয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছি। ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য নারীদের আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করছি, শতকরা ৯০ শতাংশ নারী ভোটকেন্দ্রে আসবেন ভোট দিতে। ভোটকেন্দ্রমুখী নারীরা এলে আমার জয় নিশ্চিত।’

বিএনএফ প্রার্থী আল সাআদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। এই এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ জানি। প্রান্তিক পর্যায়ে গিয়ে কাজ করছি আমি। তাদের ভোট দেওয়ার অনুরোধ করছি। ভোটাররাও আশ্বাস দিচ্ছেন আমাকে।’

তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অভিযোগ আছে মুক্তিজোটের প্রার্থী বশির আহমেদের। তিনি সারাবংলাকে বলেন, ‘প্রার্থী হিসেবে ২৫ লাখ খরচ করা যাবে। কিন্তু কিছু প্রার্থী কোটি টাকার উপরে খরচ করছেন। আমার নির্বাচনের বাজেট ২০ লাখ, কিন্তু অন্য প্রার্থীর বাজেট আছে ২০ কোটি টাকা। তাহলে তো এটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো না। প্রার্থীদের ভোটার প্রতি ১০ টাকা খরচ করার নির্দেশ থাকলেও তা অনেক প্রার্থী মানছেন না।’

ভোটের মাঠে নেই তৃণমুল বিএনপির প্রার্থী জামাল খান দুদু। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন ধরে আমি ঠাণ্ডা জ্বরে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য এখন ঢাকায় অবস্থান করছি। এলাকায় প্রচার চলছে, সেইসঙ্গে মাইকিংও। সুস্থ হলে এলাকায় গিয়ে প্রচার চালাব।’

উল্লেখ্য, রাজশাহী-১ জাতীয় সংসদের ৫২তম আসন। এ আসনের তানোর উপজেলায় পুরুষ ভোটার ৯০ হাজার ১৪৩ জন, আর নারী ভোটার ৯০ হাজার ৮৭০ জন। গোদাগাড়ী উপজেলায় পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৪ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৪৮ হাজার ২৭০ জন।

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন