বিজ্ঞাপন

ওবায়দুরের ঈগলের চাপে দারার নৌকা

January 4, 2024 | 1:34 pm

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৫ আসন। এই আসনটি আগে ছিল রাজশাহী-৪। ২০০৮ সালের আসন ভাগাভাগিতে রাজশাহী-৫ ও জাতীয় সংসদের নম্বর ৫৬ আসন হয় এটি। ২০০৮ সালে বিএনপি নেতা নজরুল ইসলামকে হারিয়ে জয় তুলে নেন আবদুল ওয়াদুদ দারা। পর পর দুইবার এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন চিকিৎসক মনসুর রহমান। তিনি বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে হারিয়ে জয়লাভ করেন। ফের এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবদুল ওয়াদুদ দারা। মনসুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন তুললেও তা পরে প্রত্যাহার করে নেন। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ওবায়দুর রহমান। নৌকার প্রার্থী দারাকে ছাড় দিতে নারাজ ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ওবায়দুর রহমান।

বিজ্ঞাপন

প্রতীক বারাদ্দের পর রাজশাহী-৫ আসনে প্রথম দিকে প্রার্থীদের মধ্যে কিছুটা নিষ্ক্রিয়ভাব দেখা গেলে বর্তমানে মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠ গরম করে রেখেছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নিয়েই চলছে বেশি আলোচনা। এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ছয় প্রার্থী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারা নৌকা, ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমান, জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী আবুল হোসেন লাঙ্গল, গণফ্রন্ট মনোনীত মখলেসুর রহমান মাছ, বিএনএম মনোনীত শরিফুল ইসলাম নোঙ্গর ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির আলতাফ হোসেন মোল্লা একতারা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

রাজশাহীর সবচেয়ে জটিল আসন এটি। একাদশ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এ আসনে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে গৃহদাহ হলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তার উল্টো চিত্র দেখা যায়। নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের পাশাপাশি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও লড়াইয়ে আছেন। প্রার্থীরা এখন এলাকায় গণসংযোগ, উঠান বৈঠকসহ নির্বাচনি নানা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সাধ্যমত তৃণমূল ভোটারদের সাহায্য-সহযোগিতায় পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করছেন তারা।

রাজশাহী-৫ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি বলা হলেও স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ। এখানে ১৯৮৬ সালের ৩য় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রয়াত মুহাম্মদ আয়েন উদ্দীন। আর জাতীয় পার্টির অধ্যাপক আবুল হোসেন চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ৫ম জাতীয় সংসদের ফলাফলে বিএনপি সরকার গঠন করলেও এ আসন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ পর্যন্ত চার বার এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

রাজনৈতিক নানা সমীকরণের ফলে বর্তমানে এখানে নির্বাচনে জেতার মতো অস্তিত্ব নেই জাতীয় পার্টির। কিন্তু এলাকায় প্রচার আছে, সারাদেশের মধ্যে যে কয়েকটি আসন দাবি করেছে পার্টির চেয়ারম্যান তার মধ্যে রাজশাহী-৫ অন্যতম। অধ্যাপক আবুল হোসেন ইতোমধ্যে তৃণমূল ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলেছেন। তবে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মনোনীত পার্টি আব্দুল ওয়াদুদ দারার জনপ্রিয়তার কাছে পিছিয়ে রয়েছে স্বতন্ত্রসহ অন্যান্য দলেরর প্রার্থীরা।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, এই আসনে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে ঈগল। ঈগলের প্রার্থীর পক্ষে নেমেছে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এছাড়াও আছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। কেউ গোপনে, কেউ নেমেছে প্রকাশ্যে ঈগল প্রতীকের পক্ষ নিয়ে। প্রথম দিকে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমানও নিষ্ক্রিয়তার পরিচয় দেন। কিন্তু সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ওবায়দুর রহমানও সতেজ হয়ে ওঠেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ আসনের প্রবীণ রাজনীবিদ থেকে শুরু করে নবীনরাও নৌকা ছেড়ে এখন ঈগলের ডানায় ভর করেছেন।

পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার রহিম কনক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় আমরা ঈগলের পক্ষে কাজ করছি। কারণ, নেতাকর্মীরা যার কাছে মূল্যায়ন পাবে সেখানেই যাবে- এটাই স্বাভাবিক।’

বিজ্ঞাপন

দুর্গাপুর পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসারসারাবাংলাকে বলেন, ‘সাবেক এমপি দারা মনোনয়ন পেয়েছেন এটাই অনেক। তার ভোটের দরকার নাই। তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে দলের লোকজনদের মারপিট ও নির্যাতন করছেন। এখনই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পরে কি হতে পারে? যার কারণে পৌর যুবলীগের সকল নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছি। তবে এ আসনটিতে নৌকা জয়ী হতে হলে প্রেক্ষপট পরিবর্তন করতে হবে।’

স্বতন্ত্র প্রার্থী ওবায়দুর রহমান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি প্রচারে গিয়ে প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছি। আমার সমর্থকরা বিভিন্ন মারও খাচ্ছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কর্মী নামানোও অনেক দুষ্কর। তবে আমার জন্য দলের নিবেদিতপ্রাণরা কাজ করছেন। বলতে গেলে এখন সবাইকে পাশে পাচ্ছি। আমাকে জয়ী করার জন্য সমর্থকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। আমি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।’

এদিকে, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবদুল ওয়াদুদ দারা নির্বাচনে তার শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেখছেন না। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি এই আসনের এমপি ছিলাম। এখানকার মানুষগুলো আমার পরিচিত। তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেছি। এমপি হয়ে ফের তাদের জন্য কাজ করব। আমরা শান্তি প্রিয় মানুষ, পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষ বরাবরই শান্তি প্রিয়। এখানে কেউ যদি কোনো শান্তি বিনষ্টের চেষ্টা করে জনগণ তাকে প্রতিহত করবে। এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনি পরিবেশ বজায় আছে।’

জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক আবুল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। এই এলাকার মানুষজন পরিবর্তন চায়। আমি চাই এখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। গ্রামে-গঞ্জে লাঙ্গলের ভালো প্রভাব আছে। পল্লিবন্ধু এরশাদকে সবাই মনে রেখেছেন। সাধারণ মানুষরা চায় জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করুক। এই নির্বাচনে সাধারণ মানুষ যদি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে ভোট দেয় তাহলে জাতীয় পার্টি জিতে যাবে।’

বিজ্ঞাপন

পুঠিয়া উপজেলার প্রাণকেন্দ্র ত্রিমোহনী বাজার। বাজারের এক ব্যবসায়ী সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন যে সরকারের অধীনেই হোক না কেন আমরা চাই নির্বাচনের আগে পরে কোনো ঝামেলা যেন না হয়। আর যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন আমরা চাই, পুঠিয়াবাসী যাতে সুন্দরভাবে থাকতে পারে, এই এলাকার যেন উন্নয়ন হয়।’

বানেশ্বর বাজারের চায়ের দোকানি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আসনের নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী ওবায়দুর ভাই দাঁড়িয়েছে। তিনি মানুষ হিসেবে খারাপ না। আমরা আশা করছি নির্বাচনে জিতে যাবে। সে নির্বাচনে জিতলে এই এলাকার মানুষের কোনো লোকসান নেই। গরিবের সঙ্গেও তারা যেমন ব্যবহার বড় লোকদের সঙ্গেও সেরকম। এমনকি তার কর্মীরাও চাঁদাবাজি বা কারও সঙ্গে ঝামেলা করে না। আমরা মোটামুটি শান্তিতেই ব্যবসা করতে পারি। তবে ভোটে জেতার পরে কী হবে সেটা জানি না।’

রাজশাহী কলেজপড়ুয়া নিলয় দাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই সরকার অনেক উন্নয়ন করছে, কিন্তু বেকারদের জন্য কিছু করছে না। আমাদের একটাই চাওয়া, সরকার এবার ক্ষমতায় এসে যেন বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। শুধু সরকারি চাকরি নয়, আমাদের উদ্যোক্তা হতেও যেন সহায়তা করে।’

দুর্গাপুর উপজেলার ভ্যানচালক আবদুল খালেক সারাবংলাকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমাদের আর কী চাওয়া থাকবে। সবকিছুর দাম বেশি। সরকার যদি সবকিছুর দাম স্বাভাবিক করে নিয়ে আসে তাহলে আমরা ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারব। আমরা চাই সবকিছুর দাম কমুক।’

এলাকার ভোটাররা বলছেন, এখানে সংঘর্ষের কোনো আশঙ্কা নেই। সবাই সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করছেন। এটা যেন বজায় থাকে। ভোটের পরে সব প্রার্থীই যেন একে অপরের সঙ্গে আন্তরিকতা দেখান। ভোটের পরেও আমরা আমরা সংঘর্ষ চাই না। এলাকায় শান্তিতে থাকতে চাই।

উল্লেখ্য, দুটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে রাজশাহী-৫ আসন। এই আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার আছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৩১ জন। নারী ভোটার আছেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৩ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন চার জন।

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন