বিজ্ঞাপন

কেন্দ্র গেলে জরিমানা ১০ হাজার টাকা, আতঙ্কে ভোটাররা

January 6, 2024 | 9:20 am

জসিম মজুমদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

খাগড়াছড়ি: জেলার পানছড়ি উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ধুদুকছড়া এলাকার সাধারণ কৃষক বিনোদ ত্রিপুরা (ছদ্মনাম)। আট সদস্যের পরিবারের কর্তা তিনি। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জমিতে চাষাবাদ করেই কোনোরকমে সংসার চালান। এর বাইরে রাজনীতি নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই তার। তবে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিগত প্রতিটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বিনোদ।

বিজ্ঞাপন

তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ নেই বলে জানান বিনোদ ত্রিপুরা। কারণ, প্রভাবশালী একটি আঞ্চলিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। সংগঠনটির নাম প্রকাশ না করলেও তিনি জানান, যারাই ভোটকেন্দ্রে যাবেন তাদের প্রত্যেককেই ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হবে বলে হুমকি দিয়েছে সংগঠনটি। এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন এলাকার ভোটাররা।

পানছড়ির চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়কলক, তারাবন ছড়া, মণিপুর এবং লোগাং ইউনিয়নের ধুদুকছড়া ও মারমাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি দুর্গম এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদেরও ভোটকেন্দ্রে না যেতে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এদিকে এবারই নতুন ভোটার হয়েছেন লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অলক চাকমা (ছদ্মনাম)। জীবনে প্রথমবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলেও ভোটকেন্দ্রে যাবেন না তিনি। এর দুটো কারণ জানালেন এই তরুণ ভোটার। প্রথমত, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী একটি আঞ্চলিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও এলাকার সবাইকে ভোট দিতে না যেতে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছে। আর কেউ সেই নিষেধ উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে গেলে তাকে চড়া মাশুল গুনতে হবে।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, রামগড় ও দীঘিনালা উপজেলার দুর্গম এলাকাগুলোর চিত্রও প্রায় একইরকম। এসব উপজেলাতেও ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত থাকতে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং এখানকার ভোটের সমীকরণ সমতলের অন্যান্য সংসদীয় আসনের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। যদিও এসব সংগঠনগুলোর কোনো নিবন্ধন নেই।

খাগড়াছড়ি জেলায় বর্তমানে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস সংস্কার) এই চারটি গ্রুপের সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তবে এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের। ভোটের মাঠেও বরাবরই প্রভাব বিস্তার করে এই সংগঠনটি। বিগত সকল স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রার্থী দেওয়া হলেও এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে সংগঠনটি।

শুধু তাই নয়, এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ ও যানবাহন ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে পানছড়ি উপজেলায় সন্ধ্যা ৬টার পর যানবাহন চলাচল না করতে অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে সংগঠনটি।

এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মোটরসাইকেল চালানোর অপরাধে গত শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পানছড়ি উপজেলার হারুবিল এলাকায় দুই নির্মাণ শ্রমিকের ওপর ব্রাশফায়ার করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ওই দুই শ্রমিক।

সেদিন দুপুর ২টার দিকে পানছড়ি উপজেলার ধুদুকছড়া এলাকায় নির্বাচনি প্রচার করতে গিয়ে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী উশ্যেপ্রু মারমা ও তার কর্মী-সমর্থকরা হামলার শিকার হয়েছেন। ওই হামলায় আহত হয়েছেন প্রার্থী উশ্যেপ্রু মারমা নিজেও। ভাঙচুর করা হয়েছে তার নির্বাচনি প্রচারে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসসহ ১২টি মোটরসাইকেল। আর ওই ঘটনায় প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ’কে দায়ী করা হলেও অভিযোগটি প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া গত মঙ্গলবার সকালে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়নের বৈদ্যপাড়া ও বটথলীপাড়ায় ভোটের প্রচার চালাতে গিয়ে হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নৌকা প্রতীকের মোটরসাইকেল বহর লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ, ইট-পাটকেল ও গুলতি নিক্ষেপ করেছে সন্ত্রাসীরা। তাদের অতর্কিত লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন আওয়ামী লীগের অন্তত ২০ জন নেতাকর্মী। হামলার পর ১০-১২ জনকে তাদের আস্তানায় ধরে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। পরে নির্বাচনি প্রচার না করার শর্তে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায় তারা। ওই ঘটনাতেও প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’কে দায়ী করা হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তবে সবকটি অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইউপিডিএফ।

ভোটারদের হুমকি প্রদান প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার (এসপি) মুক্তা ধর বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। তাছাড়া নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে পুলিশ। পাশাপাশি দুই প্লাটুন র‌্যাব সদস্য সার্বক্ষণিক নজরদারী করছে এখানে। নির্বিঘ্নে ভোট প্রদানে কেউ বাধা দিলে তাদের শক্ত হাতে মোকাবেলা করা হবে।’

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ’কে লক্ষ্য করে বলেন- ভোটার ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দিলে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। তিনি সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

প্রসঙ্গত, এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ নং খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসনে মোট চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন গত দুই মেয়াদে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। এছাড়া তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে রয়েছেন জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকে একমাত্র নারী প্রার্থী মিথিলা রোয়াজা, তৃণমূল বিএনপি মনোনীত সোনালী আঁশ প্রতীকে উশ্যেপ্রু মারমা ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি মনোনীত আম প্রতীকে মো. মোস্তফা আল-ইহযায।

খাগড়াছড়ি আসনের ৯টি উপজেলা, ৩টি পৌরসভা এবং ৩৮টি ইউনিয়নে মোট ১৯৬টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এরমধ্যে সাধারণ ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র ৮২টি, অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র ৮৫টি। আর মাটিরাঙ্গা উপজেলার ৩২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩১টি কেন্দ্রই অতি ঝুঁকিপূর্ণ। লক্ষ্মীছড়ি ও দীঘিনালা উপজেলার ৩টি কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে হেলিকপ্টার।

এ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১৫ হাজার ৩৪৬ জন। এর মধ্যে তরুণ ভোটার ৭০ হাজার। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুইজন।

সারাবাংলা/জেএম/এনএস

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন