বিজ্ঞাপন

‘মাইর খাইয়া জ্ঞান হারাইতাম, জ্ঞান ফিরলে আবার মারত’

May 22, 2018 | 9:13 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: মুখটাতে রাজ্যের মায়া, সেখানে কিশোরীসুলভ লাবণ্য। বোরকা আর মাল্টিকালারের ওড়না দিয়ে চুল ঢাকা। মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় একটু কথা বলি। আপনি সৌদি থেকে এই ফ্লাইটে ফিরলেন?— জানতে চাইতেই মুখটা ঢেকে ছোট্ট জবাব, ‘ফিরলাম।’ আপনিও কী সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন— প্রশ্ন করতেই চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেল। চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘মাইর খাইয়া জ্ঞান হারাইতাম, জ্ঞান ফিরলে আবার মারত।’

কথা হচ্ছিল সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা ফাতেমার সঙ্গে। শনিবার (১৯ মে) এক ফ্লাইটে যে ৬৫ জন নারী সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন, তাদেরই একজন এই ফাতেমা। তারা সবাই সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে নারী গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে নিজের আর পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

বিমানবন্দরে কথা হয় ফাতেমার সঙ্গে। একটু কথা বলেই যেন হাঁপিয়ে যান, কিছুটা আনমনা হয়ে যান। একটু চুপ থেকে জানালেন, তার বয়স ৩৫। দুই মেয়ে, এক ছেলের মা। বড় মেয়ের বয়স ৯ বছর, ছোট মেয়ের সাত বছর। আর ছেলেটার বয়স ১৬ মাস। স্বামী নরসিংদীতে সিএনজি চালাত। সংসারে আরও আছেন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ননদ। সিএনজি ভাড়া দিয়ে ফাতেমার সংসার চলত না। তাই ১৬ মাসের দুধের বাচ্চাকে রেখে সৌদি আরব গিয়েছিলেন সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে। ‘এখন স্বচ্ছলতা দূরে থাক, আমার জন্য সেই সিএনজিটাও বিক্রি করতে হয়েছে।’— বলতে বলতে গলা ধরে আসে ফাতেমার।

বিজ্ঞাপন

ফাতেমা বলেন, ‘দুধের ছেলেটাকে দাদির কাছে রেখে, মেয়ে দুইটাকে কোনো রকমে বুঝিয়ে নিজের সংসার ছেড়ে বাসার কাজের মানুষ হিসেবে ভিনদেশে গেছিলাম। কিন্তু সেইখানে এই দোজখ দেখতে হবে, সেইটা বুঝলে কি আর দেশ ছাড়তাম! এইসব জানলে কেউ দেশ ছাড়ব না।’

কবে সৌদি আরব গেলেন— জানতে চাইলে ফাতেমা বলেন, ‘গত মাসের ২৫ তারিখ সৌদি যাই। কিন্তু যাওয়ার পর কিছু থেকে কিছু হইলেই মারত সেখানে। মদীনাতে ছিলাম, কিন্তু একদম সঠিক ঠিকানাটা জানি না।’
ফাতেমার কাছে জানতে চাই, কোন এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলেন। জবাবে বলেন, ‘নাম তো জানি না। কিন্তু অফিস বাংলামোটর, আর যার সাথে সবসময় কথা হইত, তার নাম লালন। আর কিছু কইতে পারি না।’
কথা বলতে বলতে ফাতেমা তুলে ধরলেন সৌদি আরবে তাকে কেমন অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, তার কথা। বলেন, ‘বাসাতেও অত্যাচার করত, আবার আমরা কিছু বললে অফিসে যেতে বলত। সেখানে গেলেও মারধার করত। মনসুরের অফিস নামেই সবাই চেনে ওখানে। সেখানে গেলে মনসুর মারে, মনসুরের ভাই মারে; আবার রহিম নামে একজন আছে, সেও মারে।’ রহিম কে— জানতে চাইলে ফাতেমা বলেন, সৌদি আরবের লোকের আরবি ভাষা আর আমাদের ভাষা তো ভিন্ন। কেউ কারো ভাষা বুঝি না। কথা বুঝায়ে দিত রহিম। তার বাড়ি সিলেটে।

ফাতেমা বলতে থাকেন, ‘ওইখানে মাইর খাইয়া জ্ঞান হারাইতাম। জ্ঞান ফিরলে আবার মারত। সে কয়টা দিন গেছে আমার— প্রত্যেকটা দিন একেক জনে তিন, চারবার করে মারত। তবে আমি তো অল্প কয়দিন থাকছি, দিনের পর দিন ওইখানে বাংলাদেশের মেয়েরা অত্যাচারিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে।’ বলতে বলতে শিউরে ওঠেন ফাতেমা, যেন সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এমন নির্যাতন সহ্য করার পর ফিরে আসার পথটাও সহজ ছিল না ফাতেমার। যাওয়ার সময় মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ হলেও ফেরার সময় দালালের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এ ছাড়া দেশে ফেরার অন্য কোনো উপায় ছিল না বলেই সেই টাকা খরচ করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান ফাতেমা।
বাংলাদেশের দালালের মাধ্যমে মূল দালাল মনসুরের কাছে টাকা পৌঁছানোর পরই মুক্ত হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আমাকে শেষ সময়ের খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠাইছিল। সেইটাও মনসুর রেখে দিয়েছে।’

দেশে ফেরত আসার টাকা জোগাড় করলেন কিভাবে— জানতে চাইলে ফাতেমা বলেন, ‘একদিন এক বাসায় ফোন পাইয়া স্বামীকে সব জানাই। তাকে অত্যাচারের কথা বলি। তারপরই তিনি সংসারের একমাত্র উপার্জনের সেই সিএনজি বিক্রি করে টাকা পাঠায়।’

বলতে বলতে চোখটা ভারী হয়ে যায় ফাতেমার। স্বচ্ছলতার আকাঙ্ক্ষার কিভাবে গোলমাল হয়ে গেল, সেই হিসাবটা যেন মেলাতে পারেন না। শূন্যে তাকিয়ে অনেকটা স্বগোতক্তির মতো করেই বলেন, ‘ভুল হইছে, আর কোনোদিন যামু না। কিন্তু এখন কেমনে চলুম? সংসারটা তো চলত গাড়ি (সিএনজি) দিয়াই! সেই সিএনজিটাও তো এখন নাই। জানি না, ক্যামনে এত বড় সংসার চলবে।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে ৮৩ হজার ৩৫৪, ২০১৬ সালে ৬৮ হাজার নারী, ২০১৫ সালে ২০ হাজার ৯৫২ জন এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ১০২ জন নারী সৌদি আরব গিয়েছেন গৃহকর্মীর কাজে।

বিজ্ঞাপন

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রকল্পের প্রধান শরীফুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন— যত ধরনের নির্যাতন করা সম্ভব, সব হচ্ছে বাংলাদেশের নারীদের সঙ্গে। কিন্তু এর জন্য দায়ীদের কোনো বিচার হয় না।’

‘যারা নির্যাতন করে তাদের বিচার করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে— এটি আমাদের সুনির্দিষ্ট দাবি। তা না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’— বলেন শরীফুল।

এ বিষয়ে দূতাবাসকে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের যেসব মেয়ে দূতাবাসের সেফ হাউজে আশ্রয় নেয় বা অত্যাচারিত হয়ে ফিরে আসে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দেশটিতে কীভাবে নারীদের নির্যাতন করা হয়, কারা নির্যাতন করে, বাড়িতে নিয়োগকর্তা কারা, বাড়িতে কয়জন এবং কারা ছিলেন— সব শুনতে হবে বাংলাদেশ দূতবাসকে।’

বাংলাদেশের মেয়েরা ‘মিসকিন’ না— এটা তাদেরকে বোঝাতে হবে মন্তব্য করে তিনি আরও বলে, ‘তাদেরকে অত্যাচার করা হবে কিন্তু বিচার হবে না— এই ধারা থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। যতদিন না এসবের বিচার হবে, ততদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

চলতি বছরে প্রতিমাসে অন্তত গড়ে দুইশ জন করে নারী ফেরত এসছেন এবং দূতাবাসের সেফ হাউজে অন্তত দুইশ জন করে নারী আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান শরীফুল। এর বাইরে হয়তো আরো অসংখ্য নারী নির্যাতিত হচ্ছেন, যার সংখ্যা জানা নেই বলে আশঙ্কার কথা জানান তিনি।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন