বিজ্ঞাপন

সংঘর্ষে বিএনপি, নেপথ্যে আওয়ামী লীগের ‘কেউ’

January 11, 2024 | 10:29 am

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট নেওয়ার সময় সাতটি ভোটকেন্দ্র ঘিরে বিএনপির নেতাকর্মীদের আকস্মিক মারমুখী আচরণ নিয়ে বিস্মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ধরনের ঘটনায় যেখানে বিএনপি নেতাদের মধ্যে রীতিমতো কৃতিত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে, সেখানে তারাও হতবাক। সংঘাতের মামলায় আসামি হয়েছেন, অথচ সেই বিএনপি নেতারা এখনো জানেন না কার বা কাদের নির্দেশে কিছু ‘মুখচেনা’ কর্মী-সমর্থক এ ঘটনায় জড়ালেন!

বিজ্ঞাপন

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ভোটের দিন ওই সাত কেন্দ্রে বিএনপির সংঘাত-সহিংসতার নেপথ্যে কারও মদত বা ইন্ধন ছিল কি না। এলাকাটি চট্টগ্রাম-৮ আসনের অধীন। এখানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। জিতেছেন কেটলি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুচ ছালাম। হেরেছেন ফুলকপি প্রতীকের বিজয় কুমার চৌধুরী। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীরও ধারণা, সহিংসতায় বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য বিজয় সরাসরি ছালামকে এবং ছালামের অনুসারীরা পরোক্ষভাবে ‘বিজয়ের পক্ষে থাকা’ নেতাদের দায়ী করেছেন।

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘাতে নামানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত— এমন সন্দেহ জোরালো হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট সবাই একবাক্যে বলেছেন, সহিংসতার নেপথ্যে মূল উদ্দেশ্য ছিল ভোটারদের মধ্যে এমনভাবে আতঙ্ক তৈরি করা যেন তারা ভোটকেন্দ্রে না যান অথবা নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু সিএমপি কমিশনারের অনড় অবস্থান এবং মাঠপর্যায়ে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীরের কঠোর ভূমিকার কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়নি এবং হতাহত ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

আরও পড়ুন-

বিজ্ঞাপন

কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বোয়ালখালী উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এবং উত্তরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচটি ওয়ার্ড নিয়ে চট্টগ্রাম-৮ আসন। মোট ভোটার পাঁচ লাখ ৪৩ হাজার ১৪৭। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ ভোটার বোয়ালখালীর, বাকি তিন লাখেরও বেশি ভোটার চসিক এলাকার।

বিজয় কুমার চৌধুরীর বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলায় আর ছালামের বাড়ি নগরীর চান্দগাঁও থানার মোহরা এলাকায়। ছালাম নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, বিজয় একই কমিটির সদস্য। বিজয়ের পক্ষে ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন ও তার অনুসারীরা। আর ছালামের পক্ষে ছিলেন নগর কমিটির আরেকটি অংশ।

বিজ্ঞাপন

শুরু থেকেই এমন আলোচনা ছিল— বিপুলসংখ্যক সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বোয়ালখালীতে বিজয় বড় ব্যবধানে ছালামকে পেছনে ফেলবেন। তার ঘনিষ্ঠরা ভেবেছিলেন, বোয়ালখালীতে একচ্ছত্র ভোট আর শহরে ছালামের ভোটে ‘ভাগ বসিয়ে’ জিতে যাবেন বিজয়। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে, বোয়ালখালীতে বরং বিজয়ের ভোটে ভাগ বসিয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে যান ছালাম। বোয়ালখালীতে ছালাম পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৫৩৮ ভোট আর বিজয় পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫৭০ ভোট।

রোববার (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে এ আসনে ভোট দিয়েছেন এক লাখ ১৫ হাজার ৯১ জন ভোটার। ১৮৪টি ভোটকেন্দ্র মিলিয়ে আবদুচ ছালাম পান ৭৮ হাজার ২৬৬ ভোট, বিজয় কুমার চৌধুরী পান ৪১ হাজার ৫০০ ভোট।

ভোটের দিনের এই সহিংসতা নিয়ে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুচ ছালাম ও বিজয় কুমার চৌধুরীর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

সংঘর্ষের সূত্রপাত মৌলভী পুকুর পাড়ে

ভোটের দিন রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চান্দগাঁও থানার মৌলভী পুকুর পাড় থেকে সিঅ্যান্ডবি মোড় পর্যন্ত এলাকা সংঘর্ষকারীদের দখলে ছিল। মৌলভীপুকুর পাড়ের আশপাশের অন্তত চারটি গলি থেকে শত শত তরুণ-যুবক লাঠিসোঠা নিয়ে বেরিয়ে মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটান এবং রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষের শুরুতে মৌলভীপুকুর পাড়ে ভোটার আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত কেটলি প্রতীকের পোস্টার লাগানো তিনটি ইজিবাইক খালে ফেলে দেওয়া হয়। ওই এলাকায় আল হিকমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল মহিলা ভোটকেন্দ্র ও চান্দগাঁও রিয়াজ উদ্দিন উকিল বাড়ি এলাকায় আয়েশা-মঞ্জু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে হামলা চালানো হয়।

বিজ্ঞাপন

মৌলভীপুকুর পাড় এলাকায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আজগর আলী নামে একজন প্রহরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাতভর এখানে গোলাগুলি হয়েছে। সকালে প্রথমে মৌলভী পুকুর পাড়ে লোকজন জড়ো হয়, তারপর সেখান থেকে হামলা শুরু হয়। প্রথম দিকে পুলিশ ছিল না। আল হিকমাহ স্কুলে যখন ভাঙচুর হচ্ছিল, সেখানে পুলিশ-আনসার যারা ছিল, তারা ভয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। পরে পুলিশ আসে। এখানে যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, সবগুলো মৌলভীপুকুর পাড়েরই ছেলেপেলে।’

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে হামলার শিকার হন চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবীর। সংঘর্ষকারীরা পাঠানিয়া গোদা থেকে মৌলভী পুকুর পাড় পর্যন্ত বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরাও হামলার শিকার হন।

ওসি জাহিদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঠানিয়া গোদা থেকে শরাফত উল্লাহ পেট্রোল পাম্প হয়ে মৌলভীপুকুর পাড় পর্যন্ত এলাকায় সাতটি ভোটকেন্দ্রকে টার্গেট করে হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আমাদের ৩০০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করতে হয়েছে। তবে আমরা কোনো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ হতে দিইনি। একজন ভোটারের ওপরও বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারেনি কেউ।’

বিএনপির ভোট বানচাল কেবল নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকেও এই সংঘাতের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদনে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

মামলা-গ্রেফতার

ভোটকেন্দ্রে হামলা-ভাঙচুর ও পুলিশের সঙ্গে সংর্ঘষের ঘটনায় ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে ১২ জনকে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ান ও নগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এরশাদ উল্লাহর নাম আসামির তালিকায় আছে। ‍তাদের বাড়ি চান্দগাঁওয়ে।

ওসি জাহিদুল কবীর জানিয়েছেন, পলাতক আসামি মোশাররফ হোসেন ওরফে ছোট মোশাররফ এবং নওশাদ আল জাশেদুর রহমান সংঘাতে মূল নেতৃত্বদাতা ছিলেন। সংঘর্ষে জড়িতরা সবাই বিএনপির ওয়ার্ড-ইউনিট পর্যায়ের নেতাকর্মী।

বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনা শুরু সকাল ৯টার দিকে। আমি জেনেছি সকাল ১১টার পর। অথচ আমাকেও আসামি করা হয়েছে। আমার পেট্রোল পাম্পের (শরাফত উল্লাহ পেট্রোল পাম্প) ম্যানেজার জামাল, তিনি বোয়ালখালীতে বাড়িতে ছিলেন। তাকে ২০ নম্বর আসামি করা হয়েছে। ক্যাশিয়ার হারুনকে ২১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। অথচ পেট্রোল পাম্পের ভেতরে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ডিবির গাড়ি ছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে, দেখলে সবকিছু পরিষ্কার হবে। তারপরও এ ধরনের মামলার মানে কী, আমি জানি না।’

নগর বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ইদ্রিস আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুফিয়ান ভাই, এরশাদ উল্লাহ ভাইকে আসামি করা হয়েছে। অথচ উনারা সেখানে ছিলেনই না, ঘটনাও জানতেন না। এ ঘটনায় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সরকার কিংবা সরকারি কোনো সংস্থা এ ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপিয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সংঘাতের পেছনে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের যোগসাজশ রয়েছে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

সংঘাতে বিএনপি, নেপথ্যে আওয়ামী লীগ!

যে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে চট্টগ্রামের এই আসনটিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, তাদের বক্তব্যেই স্পষ্ট— এ ঘটনা নিছক বিএনপির ভোট ঠেকানোর আন্দোলন নয়, এর পেছনে ‘অন্য কিছু’ আছে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিজয় কুমার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেফিনিটলি বিএনপির কর্মীদের ব্যবহার করে উনি (আবদুচ ছালাম) ঘটিয়েছেন, এটা ক্লিয়ার। উনার পক্ষে বিএনপির লোকজন কাজ করেছে। পাঁচলাইশ থানা বিএনপির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আবুল কাশেম উনার পক্ষে নির্বাচনি কাজে যুক্ত থাকায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। না হলে আপনারা চিন্তা করুন, সারাদেশে কোথাও কিছু হলো না, উনার বাড়ির কাছে কেন এ ঘটনা ঘটল?’

‘ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে উনি এটা করেছেন। মোহরায় উনার বাড়ি হলেও এখানে উনার জনপ্রিয়তা বলে কিছু নেই। আপনারা নিজেরাই জরিপ করে দেখুন। ভোট পাবেন না বুঝতে পেরে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছেন। এ ফাঁকে কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোট দিয়ে আমার বিজয় ছিনতাই করেছেন,’— বলেন বিজয় কুমার।

পাল্টা অভিযোগ তুলে আবদুচ ছালামের প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট সৈয়দ নুরুল ইসলাম নুরু সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেটলি প্রতীকের পক্ষে আমাদের নির্বাচন আনচ্যালেঞ্জড ছিল না। আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমরা মনে করি, দুটি পক্ষ সহিংসতায় জড়িত থাকতে পারে। একপক্ষ যারা আমাদের প্রার্থী কিংবা আমাদের চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং এ আসনে আমাদের নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টায় ছিলেন, তাদের উদ্যোগে হতে পারে। অথবা যারা সারা বাংলাদেশে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেছে, তাদের কাজও হতে পারে। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলব, তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।’

সংঘাতের সময় ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনকারী র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত তাদের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও নির্বাচন বানচালের চেষ্টার পাশাপাশি ভোটে অংশ নেওয়া দুই প্রার্থীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের অধিনায়ক কর্নেল এম এ মাহাবুব সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের কোথাও কিছু ঘটেনি, কিন্তু চান্দগাঁওতে ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবে অবাক হয়েছি। এ জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে সেটা আমরা ধারণায় রাখিনি। ঘটনার নেপথ্যে কারও কোন মদত আছে কি না বা প্রকৃত ঘটনা কী, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মৌলভীপুকুর পাড় যখন রণক্ষেত্র এবং ওসি জাহিদুল কবীর যখন হামলাকারীদের ঠেকিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিলেন, তখন একজন সংসদ সদস্য তাকে ফোন করে বারবার সেখান থেকে সরানোর চেষ্টা করেন। ওই সংসদ সদস্য ওসিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কেন্দ্র দখল হওয়ার তথ্য দিয়ে সেখানে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ওসি সেখানে যাননি।

অভিযোগ রয়েছে, সংঘাতের সময় এক প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা আশপাশে থাকলেও তারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরীও ঘটনার সময় নগর পুলিশের একজন উপকমিশনারকে ফোন করে হামলাকারীদের ঠেকানোর বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তবে জানতে চাইলে বিজয় কুমার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা মিথ্যা তথ্য। আমি কোনো ডিসিকে ফোন দিইনি।’

প্রত্যক্ষদর্শী আজগর আলী সারাবাংলাকে জানান, আল হিকমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে যখন হামলা হচ্ছিল, তখন সামনেই ভিক্টোরিয়া পার্ক কমিউনিটি সেন্টারে ফুলকপি প্রতীকের প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরীর পক্ষে নেতাকর্মীদের জন্য ভোজের আয়োজন চলছিল। সেখানে অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত থাকলেও তারা বের হননি।

সংঘর্ষের কারণে ভোটারদের অধিকাংশই আতঙ্কে আর ঘর থেকে বের হননি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এটা ছালাম সাহেবের এরিয়া। এখানে উনার ভোট বেশি। সংঘর্ষ না হলে উনি আরও বেশি ভোট পেতেন।’

আল হিকমা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩৯৫৯ জন। ভোট পড়েছে মাত্র ২৫৩টি। এই কেন্দ্রে ছালাম ১৪১ ও বিজয় ৮৮ ভোট পেয়েছেন।

বোয়ালখালী ‍উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিজয়ের বাড়ি। সেখানেও ভোটের দিন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ সারোয়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকালে ছালামের পক্ষে থাকা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্র কমিটির আহ্বায়ক উত্তম আইচকে ‘হুমকি ও একপর্যায়ে ঘাড় ধাক্কা’ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর ‘জবাবে’ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য সুরেশ কুমার চৌধুরীকে পিটিয়ে আহত করা হয়, যিনি বিজয়ের পক্ষে ছিলেন।

সারোয়াতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকালে কয়েকজন গিয়ে উত্তমকে হুমকি দিয়ে কেন্দ্র থেকে সরে যেতে বলে। উত্তম ভয়ে আর ঘর থেকে বের হয়নি। যারা হুমকি দিয়েছে, তারা শহর থেকে ফুলকপি প্রতীকের প্রার্থীর (বিজয়) পক্ষে গিয়েছিল। তারা বহিরাগত, আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা নন।’

জানতে চাইলে বিজয় কুমার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘উত্তম নিজে কেটলি প্রতীকের কেন্দ্র কমিটির আহ্বায়ক ছিল। শুনেছি, টাকাপয়সা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। এজন্য কেটলি প্রতীকের লোকজনই তাকে হুমকিধমকি দেয়। এখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা কথা বলছে। বরং তার লোকজন সুরেশের ওপর হামলা করে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। এভাবে সারোয়াতলী, পোপাদিয়া, আমুচিয়ায় তারা ভোটারদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়েছে।’

তবে চেয়ারম্যান বেলাল হোসেনের দাবি, ফুলকপি প্রতীকের পক্ষে ভোটারদের টাকা বিলি করতে গেলে সুরেশ মারধরের শিকার হন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চান্দগাঁওয়ে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে ভোটগ্রহণ বন্ধ বা গতি শ্লথ করে দেওয়ার চেষ্টা একটি পক্ষের ছিল। তাদের পরিকল্পনায় ছিল, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে ওই এলাকায় ভোটাররা আর কেন্দ্রে যাবে না। পাশের বোয়ালখালী উপজেলায় বেশি ভোট সংগ্রহ করতে পারলে পাল্টে যাবে ভোটের ফলাফল। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হামলা-সংঘাতের ক্ষেত্রে নেপথ্যের কলকাঠি নাড়া হয় চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে। সেখানকার শীর্ষ এক নেতার পক্ষ থেকেই বিএনপির তিনজন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তাদের অনুসারীদের সংঘাতে ব্যবহার করা হয়েছে।

সহিংসতায় বিএনপির নেতাকর্মীদের কেউ কেউ অংশ নিলেও চট্টগ্রাম বিএনপি বলছে, এটি তাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নয়। তারা নিজেরাও এসব সহিংসতার তদন্ত করবে। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা ছিল। ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারে, সেই চেষ্টা থেকে একটি পক্ষ এ ঘটনা ঘটিয়েছে। মামলা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত করা হচ্ছে। ঘটনা যা-ই ঘটুক, তদন্তে অবশ্যই বের হয়ে আসবে।’

ওসি জাহিদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘নাশকতা যে এলাকায় হয়েছে, সেখানে সাতটি ভোটকেন্দ্রে প্রায় ২১ হাজার ভোটার আছে। কালুরঘাট-মোহরা এলাকার অনেক ভোটার শহরের মূল অংশে বসবাস করেন। নাশকতাটা হয়েছে মূল সড়কে। সংঘর্ষকারীদের ধারণা ছিল, তারা এ এলাকাজুড়ে আনরেস্ট তৈরি করতে পারলে শহরের দিক থেকে ভোটার মোহরার দিকে যাবে না। সেদিকে যেতে না পারলে ভোটের কাস্টিং কম হবে।’

সংঘাতের নেপথ্যে কার উসকানি, তদন্তে বিএনপিও

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি আবু সুফিয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চান্দগাঁওয়ে যা হয়েছে, কেন্দ্র থেকে আমাদের কাছে এমন কোনো নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা আমাদের কোনো সাংগঠনিক সিদ্ধান্তও নয়। বিএনপি কিংবা সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবিতে আছেন, এমন কেউ ঘটনায় জড়িত নন। তবে মুখচেনা কিছু কর্মী-সমর্থককে দেখা গেছে। তারা কেন সেখানে গেল এবং এ ধরনের ঘটনায় কেন জড়িত হলো, সেটি আমরা সাংগঠনিকভাবে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে দেখছি।’

নগর আহবায়ক কমিটির সদস্য এরশাদ উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রের নির্দেশনা ছিল— লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে জনগণকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করা। আমরা সেটাই করে যাচ্ছিলাম। ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কোনো কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা কেন্দ্রেরও ছিল না, আমরাও কাউকে এমন কিছু বলিনি। অতি উৎসাহী কিছু ছোট কর্মী সেখানে জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু সেটি আমাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নয়।’

তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন আছে কি না— জানতে চাইলে এরশাদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কেউ কেউ এখানে প্রার্থী ছালাম সাহেবের বিপক্ষে ছিলেন। তারা ইন্ধন দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে শুনেছি। পুলিশকে বলব— অহেতুক মামলার আসামি করে বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি না করে কার ইন্ধন আছে সেটা খুঁজে বের করুন।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন