বিজ্ঞাপন

জাতীয় পার্টি ‘ক্রাইসিস’ পার্টি, জনসমর্থন তলানিতে!

January 14, 2024 | 8:00 am

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করসপেন্ডন্ট

ঢাকা: জন্ম থেকে জ্বলছে জাতীয় পার্টি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জনরোষে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে দলটির মধ্যে ক্ষমতার লড়াইসহ পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। ফলে দলটি কয়েকবার ভাঙনের মুখে পড়ে। এমনকি এখন প্রত্যক্ষ ভাঙন না থাকলেও ভেতরে ভেতরে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিভক্তি মোটামুটি সবাই জানে। নেতা-কর্মীদের মতে, জাতীয় পার্টি ক্রাইসিস পার্টিতে পরিণত হয়েছে। বছর জুড়েই দলটিতে ক্রাইসিস লেগে থাকে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনেও দলটির ভরাডুবি দেখতে হচ্ছে। সর্বশেষ গত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলটির জনপ্রিয়তা তলানিতে পৌঁছেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

জরিপ বলছে, ৯১ সালের নির্বাচনে জাপার ভোটের হার ছিল ১৫ শতাংশ, ৯৬ সালে গিয়ে তা ১৬ শতাংশে ঠেকে। কিন্তু ২০০০ সাল থেকে এই হার কমতে থাকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের ভোটের হার ছিল ৯ শতাংশ, ২০০৮ সালে কমে ৭ শতাংশ হয়। ২০১৪ সালে ভোটের শতকরা হার একই থাকে। কিন্তু ২০১৮ সালে ফের কমে ৬ শতাংশে নামে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোটের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশ।

২০০৮ সালে ঢাকা-১৭ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। গতবছর এই আসনের সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। গত বছরের ১৭ জুলাই আসনটিতে উপনির্বাচন হয়। সেই উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিকদার আনিসুর রহমান পান মাত্র ১ হাজার ৩২৮ ভোট। এমনকি তার জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়। গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে জাপার এমন পরাজয়ের কারণে দলীয়নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ওই সময় মেজর (অব.) সিকদার আনিসুর রহমানকে জিএম কাদের এককভাবে মনোনয়ন দেন। জিএম কাদের দলটির পাঁচ কো-চেয়ারম্যানের পরামর্শও শোনেননি।

দলের অপর একটি সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির নেতারা বলছিলেন, সারাদেশে তাদের ভোটব্যাংক অক্ষত আছে। কিন্তু পরের নির্বাচনগুলোতে আর এ অবস্থা দেখা যায়নি। সম্প্রতি পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাপার ভোটের সংখ্যা ছিল হতাশাজনক।

বিজ্ঞাপন

জাপা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাপা প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন পেয়েছেন মাত্র ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট। একই বছরের ১২ জুন বরিশালে দলটির মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস পান ৬ হাজার ৬৬৫ ভোট। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মধু পান ১৮ হাজার ৭৪ ভোট। ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুল পান ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। আর রাজশাহীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন পান ১০ হাজার ২৭২ ভোট। এছাড়া গত ৫ বছরে দেশের বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচন হয়। প্রায় সব উপনির্বাচনেই জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। কিন্তু নির্বাচনগুলোতে তাদের ফলাফল ছিল হতাশাজনক। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের ফলাফলে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, নির্বাচনে ভরাডুবির কারণে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর পদত্যাগের দাবি তুলেছে দলের তৃণমুল নেতা থেকে শুরু করে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা। এ পরিপ্রেক্ষতে রোববার (১৪ জানুয়ারি) ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে সভা ডেকেছে তারা। এদের মধ্যে সমঝোতার ১৫টি আসনে যারা পরাজিত হয়েছে তারা কৌশলী হয়ে সামনে এগোতে চাইছে। ১০ জানুয়ারি জাপার নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথের দিন বনানী অফিসের সামনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, জহিরুল হক রুবেল, সুনীল শুভ রায়সহ অনেক নেতা বিক্ষোভ করে জিএম কাদেরের পদত্যাগ দাবি করেন। কিন্তু তারা বর্তমানে চুপ রয়েছেন। ১১ জানুয়ারি দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বেশ কয়েকজন নেতাকে তার বাসভবনে ডাকেন। এর পর পরই তারা চুপ হয়ে যান বলে দলের ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা তার স্ত্রীকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি করার কৌশল হিসেবে নির্বাচনে হেরে গিয়েও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বাসায় ধর্না দিচ্ছেন। আর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ চাইছেন তার মেয়েকে সংরক্ষিত আসনে এমপি করতে। ফলে এখন তারা চুপচাপ। যদিও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভরাডুবির কারণ জানতে গিয়ে অব্যাহতি পেয়েছেন ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়। অব্যাহতি পাওয়ার পর ফিরোজ রশীদ কোনো মন্তব্য করতে না চাইলেও সুনীল শুভ রায় বলেছেন, ‘তাদের অব্যাহতিপত্র আমি সানন্দে গ্রহণ করেছি।’

বিজ্ঞাপন

প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১১টি আসনে জয়লাভ করেছে। সেই হিসাবে জাতীয় পার্টির ২টি সংরক্ষিত মহিলা আসন পাওয়ার কথা। এই দুইটির একটিতে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এবং অন্যটি দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী শরীফা কাদেরকে দেওয়ার কথা রয়েছে।

দলটির নেতা-কর্মী এবং পরাজিত প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনের পর এরশাদের পরিবারের সঙ্গে জিএম কাদেরের দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে। আগে যদিও মুখ দেখাদেখি হতো এখন সেটিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ পরিবারের সঙ্গে জিএম কাদেরের পরিবারের বিভক্তিও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

জানা গেছে, জাতীয় পার্টির জন্ম সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল থেকে নেতাদের ভাগিয়ে গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি (জাপা)। সেই জাতীয় পার্টি এখন পাঁচ ভাগে বিভক্ত। এ অবস্থার মধ্যেই এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এখন সবচেয়ে বড়ধরনের ভাঙনের মুখে পড়েছে। জাতীয় পার্টি নামে এখন মাঠে সক্রিয় দল আছে পাঁচটি দল। এর মধ্যে চারটির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে।

এরশাদের পতনের পর থেকে বেশ কয়েকবার ভাঙন ধরে দলে। এর মধ্যে তিনটি ভাঙন ছিল বড় ধরনের। তারা দল থেকে বেরিয়ে একই নামে আবার দল করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দলটির আরও কিছু নেতা দলছুট হয়েছেন। বড় ভাঙনগুলো হয়েছিল মূলত বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে। কখনও আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে, আবার কখনও ভেঙেছে মন্ত্রী হওয়া নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

এরশাদের জাতীয় পার্টিতে প্রথম বড় ধরনের ভাঙন ধরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বের হয়ে আলাদা জাতীয় পার্টির ঘোষণা দিলে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের সময় জাতীয় পার্টি প্রথমে তাদের সমর্থন দিলেও পরে চারদলীয় জোটে চলে যায়। সে সময় যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে যায়। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে আছেন আন্দালিব রহমান। এই অংশটির ভেতরও আরেকটি ভাঙন আছে। মন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলার এক পর্যায়ে এম এ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। এক এগারোর সময়ও জাতীয় পার্টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল। পরে অবশ্য এ দুটি অংশই এরশাদের নেতৃত্বে এক হয়ে যায়।

সর্বশেষ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরান তার পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি-জোটে। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে দলের বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন জাতীয় পার্টির ঘোষণা দেন কাজী জাফর। সেইসঙ্গে তিনি এরশাদকে বহিষ্কারেরও ঘোষণা দেন।

এদিকে, ১৪ জানুয়ারি কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে জাপার বিক্ষুব্ধ অংশের সভা ডাকা নিয়ে কথা বলেছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল হক রুবেল। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনে জাপার ভরাডুবির কারণে নেতা-কর্মীরা হতাশ। দলটি টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে এই দলটির যারা জয়ী হন তারা নিজেদের জন্য এমপি হন। এমপি হয়ে দলের জন্য কোনো কাজ করেন না। কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ১০ বছর ধরে এমপি ছিলেন। দলের জন্য তাদের কী ভুমিকা রয়েছে?’ অপর এক নেতা সারাবাংলাকে জানান, সৈয়দ আবু হেসেন বাবলা তার স্ত্রীকে এমপি করার জন্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বাসায় ধর্না দিয়েছে।

অপরদিকে, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন করতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি। দলটির মধ্যে বছর জুড়ে ক্রাইসিস লেগেই থাকে। আর এ কারণেই বারবার ভরাডুবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা এখন দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগ দাবি করছেন তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের একটি বীজ যুক্ত হয়েছে। আমরা যারা সমঝোতার আসনে থেকেও হেরে গেছি, তার কারণ জানতে দলের নীতি নির্ধারকদের কাছে নিয়মমাফিক কৈফিয়ৎ চাইতে পারি। তার মানে এই নয় যে, নিয়ম-নীতি ভেঙে তাদের পদত্যাগ চাইব।’

সারাবাংরা/এএইচএইচ/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন