বিজ্ঞাপন

৮ হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি রতনের সাজাভোগ শুরু

January 16, 2024 | 6:41 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রায় আট হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের একাধিক মামলায় গ্রেফতার শিল্পপতি জহির আহমদ রতনের সাজাভোগ শুরু হয়েছে। ১৭টি মামলায় অর্থঋণ আদালতে দেওয়া রায় অনুযায়ী তাকে মোট সাত বছর এক মাস জেল খাটতে হবে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের বিচারক যুগ্ম জেলা জজ মুজাহিদুর রহমানের আদালত সাজামূলে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা ১৭টি মামলায় জহির আহমদ রতনের মোট সাত বছর এক মাসের কারাদণ্ড হয়। পলাতক থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেছিলেন। গ্রেফতারের পর রতনকে মঙ্গলবার সাজা পরোয়ানা মূলে অর্থঋণ আদালতে হাজির করা হয়।

রতনের পক্ষে তার আইনজীবী সব মামলায় দেওয়া সাজা একসঙ্গে কার্যকরের আবেদন করেন। আদালত আবেদন নামঞ্জুর করে প্রতিটি মামলায় দেওয়া সাজা একটির পর আরেকটি কার্যকরের আদেশ দেন।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রতনকে ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে নগরীর কোতোয়ালী থানা পুলিশ। পরদিন তাকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।

জানা গেছে, রতনের বিরুদ্ধে খেলাপি ঋণের মোট ৬১টি মামলা আছে। এর মধ্যে ২৬টি মামলায় তার সাজা হয়েছে। ২৬টির মধ্যে ১৭টি মামলার সাজা হয় অর্থঋণ আদালত থেকে। আরও ৩৫টি মামলা বিচারাধীন আছে।

‘টাকা পাচার করিনি, করলে বিদেশে থাকতাম’

বিজ্ঞাপন

রতনকে মঙ্গলবার আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হলে বিচারক তার উদ্দেশে বলেন, ‘এ আদালতে আপনার প্রতিষ্ঠানের যত মামলা আছে তাতে ব্যাংকগুলোর দাবি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আপনি হয়তো বলবেন সেটা আরও কম। এখানে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের চারটি মামলায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬টি মামলায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের চারটি মামলার মধ্যে তিনটির রায় হয়েছে- এগুলোতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের দুটি মামলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, আরও আছে। জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের গুলোতে কোনো মর্টগেজও নেই…।’

বিচারক বলেন, ‘এ আদালতে ইতোপূর্বে মামলায় আপনার ও পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইমিগ্রেশন পু্লিশ জানায়, আপনার স্ত্রী কানাডা। আপনি হয়তো দেশেই ছিলেন। পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গত দুই বছরে সেভাবে আইনজীবীর মাধ্যমেও আদালতে আপনার উপস্থিতি ছিল না। আপনি কি বলতে চান। কোনো প্রপার্টি আছে এখন?’

তখন রতনের আইনজীবী নুকবাতুল জুমার বলেন, ‘প্রপার্টি যা আছে সব মর্টগেজ।’

এসময় রতন বলেন, ‘আমি একসময় হাজার কোটি টাকা বছরে ট্যাক্স দিয়েছি। ব্যবসা করেছি, দেশের কাজ করেছি। ওয়ান ইলেভেনের সময় কী পরিস্থিতি ছিল আপনারা জানেন। আমাকে একজন কর্মকর্তা ডেকে নেন। পরে আরও একজন কর্মকর্তাসহ সে সময়ের সেনাপ্রধানের কাছে নিয়ে যান। আমরা নাকি দেশের ভোগপণ্যের বাজার নষ্ট করেছি।’

বিজ্ঞাপন

‘তারপর জোর করে আমাকে দিয়ে লাখ লাখ টন তেল প্রডাকশন করিয়েছে। ২ মাসের ভেতর। ১ হাজার ২৭০ ডলারের মাল কিনে এনেছি। ২-৩ মাসের ভিতর দেশের বাজারে দাম ৫০০ ডলার হয়ে যায়। ১ লাখ টনের উপর মাল ছিল। শুধু আমি না, তখন সবাই লস করেছে। লস কভার করতে আবার এলসি করেছি। ব্যাংক তখনো এলসি করতে দিয়েছে।’

রতন বলেন, ‘তখন হয়তো ব্যাংক আগের এলসির টাকা ফেরত চাইলে আমি এ পথে আগাতাম না। আগের ও পরের সুদ মিলে বড় অংক হয়ে গেছে। তারপর ডলার ক্রাইসিসের কারণে এক ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আরেক ব্যাংককে দিতে হয়েছে। নতুনগুলো আপনারা দেখছেন। পুরনোগুলো দেখছেন না।’

এসময় বিচারক বলেন, ‘এখানে যত ডকুমেন্ট এসেছে মামলায় সব ২০১১ সালের ও তার পরের। আপনার যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ, দেশের শীর্ষ ৫ ঋণ খেলাপির মধ্যে আপনার নাম থাকার কথা। বড় খেলাপিদের কথা বিবেচনায় নিয়ে রি-শিডিউল করতে ২-৩ শতাংশ দিয়ে ১০ বছরের সময় দেওয়া হয়েছে। সেখানেও প্রবেশ করেননি। আপনার বিরুদ্ধে অনেক চেকের মামলাও আছে।’

এরপর রতন বলেন, ‘আমার দুর্বলতা ছিল, সেটার সুযোগ অনেকে নিয়েছে। আমি কোনো টাকা পাচার করিনি। টাকা পাচার করলে দেশে থাকতাম না আজ। দেশের জন্য কাজ করেছি। নাম বলছি না এখানে, কয়েকটি ব্যাংক বেঈমানি করেছে।’

‘গত ১০-১২ বছরে মামলার জ্বালায় কোনো ব্যবসা করতে পারিনি। কিন্তু কর্মচারীদের বেতন ঠিক রেখেছি। নিজে খাওয়ার পয়সা ছিল না। আইনজীবী ছিল হয়তো, সঠিক জায়গায় নজর দিতে পারিনি। অর্থ পাচার করিনি স্যার। এলসি করেছি। শোধ করতে পারিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্তে তখন লোকাল এলসি ছিল। সবাই করেছে। এরকম একটা এলসির জন্যও মামলা করেছে। আমি একা না। ইলিয়াস ব্রাদার্সেরও একই দশা। সবাই কি চোর?’

বিচারক বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। অনেক আদেশ দিয়েছি। কোর্টে কোনো প্রতিনিধি দেখিনি। এখানে যত মামলা আছে। সবচেয়ে বেশি দায় আপনার।’

সবশেষে বিচারক বলেন, ‘আপনার যেসব সাজা পরোয়ানা আছে তা একের পর এক বলবৎ হবে। একসঙ্গে নয়। আর যেগুলোতে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে সেগুলো জারি হবে।’

পরে রতনের আইনজীবী নুকবাতুল জুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওনার অনুপস্থিতিতে মামলায় সাজা হয়েছিল। আজ (মঙ্গলবার) আদালত ওনার (রতন) বক্তব্য জানতে চেয়েছেন। তিনি আদালতে বলেছেন ব্যবসা সংকটের কারণে ঋণ শোধ করতে পারেননি। কিছু মানুষের তৈরি করা সংকট ছিল, কিছু সেসময়ে রাষ্ট্রের ওয়েদারের কারণে হয়তো হয়েছে। তবে তিনি কোনো টাকা পাচার করেননি। পাচার করলে এতগুলো মামলার ইনভেস্টিগেশনে আদালতের নথিতে তা আসত।’

‘এতদিন তিনি হয়তো লুকিয়ে ছিলেন। এখন যেহেতু আছেন কোর্টে নিয়মিত বাকি মামলাগুলোতে আসবেন। তখন ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন কি প্রক্রিয়া সেটার বিষয়ে।’

জনতা ব্যাংকের আইনজীবী ড. শফিকুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের সুষ্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা তিনি আদালতকে জানাতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া রি-শিডিউল সুবিধাও তিনি নেননি। বরং তিনি আদালতের কাছে সব সাজা একসঙ্গে ভোগের আবেদন করেছেন। যাতে তিনি সাজা ভোগের পর মুক্তি পেয়ে যান। সেটা আদালত এলাউ করেনি। ওনার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও আদালতের ডিক্রি আছে। তিনি কানাডায় আছেন। সদিচ্ছা থাকলে তিনি (রতন) ডাউন পেমেন্ট দিয়েও সল্যুশন করতে পারতেন।’

অগ্রণী ব্যাংকের আইন কর্মকর্তা নুরুল আমীন বলেন, ‘আমাদের চারটি মামলা ২ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকার। ১০-১২ বছরে রি-শিডিউল করার চেষ্টাও করেননি। তিনি জাতীয় সংসদে ঘোষিত তালিকার একজন শীর্ষ ঋণ খেলাপি। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।’

উল্লেখ্য, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ পায় নুরজাহান গ্রুপ। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

অভিযোগ আছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দায় পরিশোধ করে না করে নুরজাহান গ্রুপ বিভিন্ন কারখানা স্থাপন, জমি কেনা এবং বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে পাচার করেছেন। ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে নুরজাহান গ্রুপের পরিচালক ও জহির আহমেদ রতনের ছোট ভাই টিপু সুলতানকে গ্রেফতার করেছিল চট্টগ্রামের খুলশী থানা পুলিশ।

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/এনএস

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন