বিজ্ঞাপন

ফুলের রাজ্যে হারিয়ে যেতে নেই মানা…

January 25, 2024 | 7:25 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: তখনও সূয্যি মামা উঁকি দেয়নি। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শীতের তীব্রতাকে আরও গভীর করেছে। কিন্তু এই তীব্রতা হার মেনেছে ছোট্ট মাইশার কাছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে মাইশা এসেছিল ফুলের রাজ্যে। রঙ-বেরঙের ফুলে রূপ, রস, গন্ধ গায়ে মেখে মাইশা ছুটছিল এদিক-সেদিক, পুরো বাগানময়। বাবা-মাও ব্যস্ত তার সঙ্গে, তাকে ফুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের ডিসি পার্কে ফুল উৎসবে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ উৎসবের আয়োজন করেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ডিসি পার্কে যেন লাখ লাখ ফুলের জলসা বসেছে। এত ফুলের সমারোহে যেন হারিয়ে যেতে ভিড় করেছেন শত শত মানুষ। সাধারণত ডিসি পার্কের টিকিটের মূল্য ৩০ টাকা রাখা হলেও ফুল উৎসবের প্রথমদিনের দুপুর পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয় পুরো পার্ক। সে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতেই সকাল থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই ছিল।

বিজ্ঞাপন

বেশির ভাগ দর্শনার্থী ফেসবুক আর ইউটিউবে ফুলের রাজ্য দেখে উৎসবে এসেছেন। আগত অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা হলে তারা সারাবাংলাকে এ কথা বলেছেন।

সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারি থেকে জেরিন চৌধুরী তার চার বান্ধবীসহ ডিসি পার্কে ফুল উৎসব দেখতে এসেছিলেন। এসেই যেন তাদের চক্ষু চড়কগাছ। পার্কে ঢুকতেই এতবড় ফুলের রাজ্য দেখে তারা সবাই অবাক।

জেরিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত বড় পার্ক আমি আগে কখনও দেখিনি। এখানে এসে মন খারাপ থাকলেও সেটা ভালো হয়ে যাবে। ফুল, পুকুর, গাছ, নৌকা সব মিলিয়ে অসাধারণ। আমরা ফেসবুকে দেখে এখানে এসেছি। তবে এটা এত বড় পার্ক সেটা কল্পনাও করিনি।’

বিজ্ঞাপন

আরেক বান্ধবী সেলিনা হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে মনে হয় এটাই সবচেয়ে বড় পার্ক। তবে একটু ভেতরে হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের আসতে কষ্ট হয়। তবুও চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটা অনেক বড় সুযোগ। এখানে ঘোরাফেরার অনেক জায়গা আছে। দিঘীতে চড়ার জন্য নৌকা আছে। বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আছে বেঞ্চ। ৩০ টাকা দিয়ে এর বেশি আর কি পাওয়ার আছে!’

তবে ভিন্ন কথা বলছেন কেউ কেউ। তুনাজ আহমেদ নামে বেসরকারি কলেজের এক শিক্ষক সারাবাংলাকে বলেন, ‘পার্কটি অনেক ভেতরে হওয়ায় যাওয়া-আসা খরচ বেশি হবে। আবার ৩০ টাকা প্রবেশ টিকেট। বোটে ১৫ মিনিট চড়তে জনপ্রতি গুণতে হবে ৫০ টাকা। খাবারের দামও তুলনামূলক বেশি। এত টাকা খরচ করে কক্সবাজার একদিনের ভ্রমণ হয়ে যাবে।’

এদিকে ডিসি পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবেশপথের বামপাশেই শিশুদের জন্য করা হয়েছে আলাদা কিডস জোন। বিশাল দিঘীর জলরাশিতে নৌকা ও প্যাডেলচালিত কায়াকিং এ ব্যস্ত তরুণ-তরুণীরা। অন্য একপাশে ভাসমান কাঠের নির্মিত রাস্তা, উঁচু সেতু নজর কাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

দূরের ঘন কেওড়া বন ও সারি সারি খেঁজুর গাছে আটকানো নলে গড়িয়ে পড়া রস যেন সৌন্দর্যের আরেক মাত্রা নিয়ে এসেছে। দিঘীর পশ্চিম পাড়ে থরে থরে সাজানো টব। বিভিন্ন ফুল দিয়ে পানির ঝর্ণা ও গিটারের আদলে সাজানো হয়েছে।

টবে টবে হলুদ গাঁদার ঝাঁক, চন্দ্রমল্লিকা, টিউলিপ, মনোহর ডালিয়া আর বাহারি গোলাপ আলো ছড়াচ্ছে। যেন রাতভর শিশিরে স্নিগ্ধ হয়ে নিজেদের সৌন্দর্য মেলে ধরেছে যত্ন করে। একপাশে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য বিভিন্ন সময়ের ১৫টি নৌকা দিয়ে করা হয়েছে মিউজিয়াম, যেখানে সেলফি ও ছবি তুলতে ব্যস্ত দেখা গেছে প্রায় সবাইকে।

এছাড়া উৎসবে ১০০’র বেশি গুণী শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফুল উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সচিব মাহবুব হোসেন, বিশেষ অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ও বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমেদ।

উদ্বোধন শেষে মন্ত্রিপরিষদের সচিব মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উৎসবটি দ্বিতীয়বার হলেও আমার জন্য প্রথমবার এরকম একটি ফুল উৎসবে আসা। অসাধারণ একটি উৎসব। দেড়-দুইমাস জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমরা খুব ব্যস্ত ছিলাম। সে ব্যস্ততার জন্য আমাদের মাঝে একটি স্ট্রেসও তৈরি হয়েছিল। আমি কিছুক্ষণ ফুলের সমারোহ দেখলাম। আর সেই স্ট্রেসটা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। স্ট্রেসের চাপটি আমি আর অনুভব করতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ১৯৪ একর এলাকাটি ছিল পুরোপুরি মাদকের আখড়া। আমি খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করছি যে, মাদকের আখড়া আজ ফুলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এ জায়গাটি আজ চট্টগ্রামবাসীর অহংকারের জায়গা হিসেবে তৈরি হচ্ছে। এটা এ শহরের ফুসফুস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পার্ক পর্যটন ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ফুল উৎসবে এসে আমি অনেক বিমোহিত। সারা বাংলাদেশের জন্য একটি উদাহারণ তৈরি করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার। এ উদ্যেগের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে একটি নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে, এখানে স্ট্রেসফুল নাগরিক জীবন থেকে বের হয়ে এসে আবার নিজেকে খুঁজে ফিরে পাওয়া যায়। এখানে একটি স্থায়ী মিউজিয়াম হবে। সাগরের পাড়ে একটি স্ট্রাকচার গড়ে তোলা হবে। এসব কিছু মহাপরিকল্পনা হিসেবে জেলা প্রশাসন আমাদের উপস্থাপন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা চট্টগ্রামের জন্য চমৎকার একটি সংযোজন। এ প্রকল্পটিকে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি ডিপিপি আকারে। আশা করছি অচিরেই চট্টগ্রামবাসী ফের বাংলাদেশের জন্য একটি পথ-পথিকৃৎ হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হবে।’

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের ফৌজদারহাট বন্দর সংযোগ সড়কের পাশে শুকতারা নামে একটি রেস্তোরাঁসহ ১৯৪ একর জায়গার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সেখানে একটি পার্ক গঠন করেছিল জেলা প্রশাসন। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডিসি ফ্লাওয়ার পার্ক’। এখন সেটা পরিচিত ডিসি পার্ক নামে। ওই জায়গায় আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাসব্যাপী ফুল উৎসবের আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন।

ছবি : শ্যামল নন্দী, ফটোকরেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা।

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন