বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পানির তীব্র সংকট, গোসল নেই ৫-১০ দিনেও

May 23, 2018 | 10:10 am

।। জান্নাতুল ফেরদৌসী ও জাকিয়া আহমেদ ।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার থেকে: কুতুপালং-বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরে মাটির প্রলেপ দিচ্ছিলেন জোহরা খাতুন। সেনাবাহিনীর গুলিতে স্বামীকে হারিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব এই রোহিঙ্গা নারী এসে আশ্রয় নিয়েছেন এই ক্যাম্পে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তীব্র পানির সংকটে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। যে কারণে গোসলের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। জোহরা খাতুনের কথায়, ‘খাবার আর ওজুর পানি জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছি। গোসলের কথা তো ভাবাই যায় না। গেল ১০ দিন হয় গোসল হয়নি!’ ছয় হাজার একরের ওপর গড়ে ওঠা কুতুপালং-বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্প বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের পরিচিতি পেয়েছে।

মঙ্গলবার (২২ মে) সরেজমিনে এই ক্যাম্পে গিয়েই দেখা জোহরা খাতুনের সঙ্গে। বললেন, ছোট ছোট সন্তান আর দরজাহীন ঘর ফেলে কোথাও যেতে পারেন না বলে ত্রাণেই সামগ্রীই ভরসা তার। ছয় সন্তানের খাবারের জোগানই এখন তার মূল দুশ্চিন্তা।

আরও পড়ুন: শত প্রতিকূলতা, তবু অমলিন রোহিঙ্গা শিশুদের হাসি

বিজ্ঞাপন

রোজার প্রসঙ্গ তুলতেই জোহরা বলেন, ‘রোজা তো রাখছিই। কিন্তু ইফতারে জোটে কেবল পানি, আর সেহেরিতে নুন ভাত বা শাকভাত। মাছ-মাংসের স্বাদ তো ভুলেই গেছি। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা পানির।’

পানির সমস্যা কেন— জানতে চাইলে জোহরা বলেন, ‘আমার ঘর বালুখালি শিবিরে পাহাড়ের উঁচু ধাপে। নলকূপ তো অনেক দূরে। জারে করে পানি আনতে আধাঘণ্টা সময় লাগে। তাই গত ১০ দিন গোসল হয়নি।’

পানির সমস্যার কথা বললেন ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা রশীদাও। গোসল করেননি গত পাঁচ দিন, ভুগছেন খাবারের কষ্টেও।

বিজ্ঞাপন

বালুখালি শিবিরে সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়ের ওপরের ঘরগুলোতে নলকূপের পানি সরবরাহ ও টয়লেট ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। কেউ কেউ নিজ ব্যবস্থাপনায় নারীদের গোসলের জন্য পলিথিন দিয়ে অস্থায়ী জায়গা তৈরি করেছেন। তবে পাহাড়ি পথ বেয়ে খাবারের পানি জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

পথে যেতে যেতেই নজরে পড়ে ত্রাণের বস্তা মাথায় পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠছেন এক নারী। কপালে বেয়ে ঘাম ঝড়ছে, হাঁপাচ্ছেন । কথা বলতে চাইলে মাথা থেকে বস্তা নামিয়ে বসে পড়েন মাটিতেই। নাম তাহেরা (২৫)। স্বামীকে রাখাইন সেনারা মেরে ফেলেছে। ঘরে দিয়েছে আগুন। ছোট্ট দুই সন্তানের হাত ধরে প্রতিবেশীদের সাথে পাড়ি জমান এ দেশে। সবই এখন পুরোনো স্মৃতি। মোটা কালো বোরখার হাত খানিকটা তুলে বারবার চুলকাচ্ছেন। ফোসকা ঘায়ের মতো কেন— জানতে চাইলে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক পরপর গোসল করি। পানি নাই, গোসলখানা নাই। হবেই তো।’

আরও পড়ুন: নদীর ওপারে ঘন কুয়াশা

বিজ্ঞাপন

তাহেরা জানান, বড় ছেলে আবদুল্লাহর বয়স ৮, ছোট ছেলের ৫। খুব বায়না করে মাছ খাওয়ার। ত্রাণের দুই লিটার তেল বেঁচে একদিন ছেলেদের শুঁটকি মাছ খাইয়েছেন। কথা বলতে বলতে ছলছল চোখ দু’টো তাহেরা বারবারই ঢাকার করছিলেন ঠোঁটের শুকনো হাসি দিয়ে।

জোহরা, রশিদা আর তাহেরার কথার প্রতিধ্বনি পুরো রোহিঙ্গা শিবিরজুড়ে। রোহিঙ্গা শিবিরের সার্বিক বিষয় সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারসেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) তথ্য অনুযায়ী, কতুপালং-বালুখালি ক্যাম্পের সম্প্রসারিত এলাকায় বসবাসকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ৫ লাখ ৮৯ হাজার। এর বড় অংশই নারী আর শিশু।

বালুখালি ক্যাম্প ৮ ডব্লিউ (জোন আরআর) এ সিক্সটির মাঝি (ক্যাম্পের দলনেতা) মো. একরাম সারাবংলাকে বলেন, শুরু থেকেই এখানে পানির সমস্যা। তার ব্লকে মাত্র দু’টি নলকূপ রয়েছে, সেখানে পানিও আসে কম। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে এ সমস্যার কথা জানানো হলেও কোনো সমাধান হয়নি।

পাহাড়ি এলাকাতে এই পানির সমস্যা বহুদিনের জানিয়ে আরেকটি ব্লকের স্বেচ্ছাসেবক বদি রহমান জানান, তার ব্লকের ১২৪টি ঘরের জন্য টয়লেট রয়েছে চারটি, টিউবওয়েল মাত্র একটি। গোসলখানা একেবারেই নেই। তাই নারীরা রাতের বেলাতে ঘরের আশেপাশেই গোসল আর টয়লেট সারেন।

বালুখালির এই ক্যাম্পেই দেখা হয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি পরিদর্শক দলের সঙ্গে। দলটির দলনেতা প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর মাহবুবুল আলম বলেন, এই ক্যাম্পের ওয়াটার স্যানিটেশন ও হাইজিন নিয়ে আমরা মাঠ পর্যায়ে গবেষণা ও জরিপ করছি।

এখানে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করলেও সেটি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে জানিয়ে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘কেবল একটি জোনে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা পেয়েছি যেখানে পানিতে ক্লোরিন ট্যাবলেট দেওয়া হচ্ছে। তবে অন্য জোনে আবার অনিরাপদ পানির সরবরাহ দেখেছি। বেসরকারি অক্সফামের তত্ত্বাবধায়নে এসব রিপোর্ট আমরা স্টেক হোল্ডারদের জানাব। তবে সেটি শেষ করতে আরও দুই মাস সময় লাগবে।’ আগামী ৩১ জুলাইয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলেও জানান আইসিডিডিআরবি’র এই গবেষক।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার মাহবুবুল আলম কবীর জানান, গত আগস্ট মাস থেকে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ১ হাজার ৫৭৪টি নলকূপ বসানো হয়েছে। এ ছাড়া, কার্যকর রয়েছে ১৩ হাজার ৬৩০টি টয়লেট।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ/টিআর

অারও পড়ুন : 

রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে প্রিয়াঙ্কার আহ্বান

শরণার্থী শিবিরে প্রিয়াঙ্কার দ্বিতীয় দিন

ক্যাম্প ঘুরে রোহিঙ্গা শিশুদের খবর নিলেন প্রিয়াঙ্কা

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন