বিজ্ঞাপন

পরাধীন মিরপুরে বিহারীদের বর্বর পৈশাচিকতা

January 31, 2024 | 4:26 pm

রহমান রা’দ

সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম! আমার যদি চেতনা না থাকতো! এর চেয়ে যদি হতাম কোন জড় পদার্থ! তাহলে শিয়াল বাড়ির ঐ বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানূষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতোতা নীচ ধারণা হবার দুর্ভাগ্য হত না। যত নীচই হোক মানুষ, তবু ওদের সম্পর্কে যে সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল, তা এমনভাবে উবে যেতো না। আর মানুষ কেন, কোন প্রাণীই কি পারে এতোটা নির্মম, এতোটা বর্বর হতে, এতোটা বোধহীন হতে?

বিজ্ঞাপন

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার প্রতিনিধি আনিসুর রহমান মিরপুরের শিয়ালবাড়ী ঘুরে এসে এভাবেই শুরু করেছিলেন তার প্রতিবেদন। যার ছত্রে ছত্রে ছিল একাত্তরের ৯টি মাস জুড়ে ঢাকার দুর্গম অঞ্চল মিরপুরের বাঙ্গালীদের উপর বিহারী নরপিশাচদের ঘটানো অচিন্তনীয় জেনোসাইডের সামান্য ধারণা, এক অভূতপূর্ব ভয়ংকর বর্বরতার আখ্যান। চলুন তার রিপোর্টের বাকি অংশ পড়ে আসা যাকঃ

“অথবা যদি না যেতাম সেই শিয়ালবাড়িতে! তাহলে দেখতে হত না ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়কে। অনুসন্ধিৎসু হিসেবেও যা দেখা উচিত হবে না কোন মানুষের। ওখানে না গেলে গায়ে ধরতো না এমন দহনজ্বালা। সহ্য করতে হত না ভয়-ক্রোধ আর ঘৃণার মিশ্রণে এমন তীব্র অনুভূতি। সে অনুভূতি বলে বোঝানো অসম্ভব। প্রতিমুহুর্তেই মনে হচ্ছিল ভয়ে হার্টফেল করবো, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অগণিত লাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে অজান্তেই বারবার চোখ বুজতে হয়েছে। না না, এ সত্যি নয়, এ কোন দুঃস্বপ্ন। বলে দৃষ্টি আকাশের দিকে তুলতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর দেখতে পারছি না বলে মাটি- ভুল বললাম মাটি নয়, মানুষের হাড়ের উপর বসে পড়তে হয়েছে। সারা এলাকায় মানুষের হাড় ছাড়া শুধু মাটি কোথায়!”

একাত্তরের পুরো সময় জুড়ে সারা বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী এদেশীয় দোসর আলবদর-আলশামস এবং বিহারীরা। কিন্তু রাজধানী ঢাকার মিরপুর অঞ্চলে যে সুচিন্তিত সংঘবদ্ধ ধারাবাহিক পৈশাচিকতা দেখিয়েছিল বিহারীরা, তা আসলে কোন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। শহরের শেষ সীমায় হওয়ায় এবং জনবসতি একেবারেই কম থাকায় মিরপুর ছিল বাঙ্গালীদের হত্যার জন্য সবচেয়ে মোক্ষম স্থান। ফলে ঢাকায় ৭০টির মতন চিহ্নিত বধ্যভূমির মধ্যে ২৩টিই ছিল মিরপুরে।

বিজ্ঞাপন

এগুলো হলো ১. জল্লাদখানা, ২. মুসলিম বাজার, ৩. মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন পানির ট্যাঙ্ক, ৪. মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন ওয়াপদা বিল্ডিং, ৫. মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশন, ৬. মিরপুর ১০/সি লাইন ১৪ নম্বর সেকশন, ৭. মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশন, ৮. মিরপুর ১৪ নম্বর কবরস্থান, ৯. সিরামিক ফ্যাক্টরি, ১০. শিয়ালবাড়ি, ১১. হরিরামপুর, ১২. মিরপুর ব্রিজ, ১৩. ১২ নম্বর সেকশনের কালাপানির ঢাল, ১৪. রাইনখোলা বধ্যভূমি, ১৫. মিরপুরের দারুল রশিদ মাদ্রাসা, ১৬. মিরপুরের বায়তুল আজমত জামে মসজিদ, ১৭. আলোকদি, ১৮. বাংলা কলেজ, ১৯. বাংলা কলেজের কাছে আমবাগান, ২০. ১ নম্বর সেকশনের সারেংবাড়ি, ২১. চিড়িয়াখানার কাছে সিন্নিরটেক, ২২. গোলারটেক, ২৩. কল্যাণপুর বাসডিপো।

এগুলোর মধ্যে বড় ও প্রধানতম বধ্যভূমিগুলো ছিল জল্লাদখানা, মিরপুর ব্রিজ, শিয়ালবাড়ি, মুসলিম বাজার, রাইনখোলা, বাংলা কলেজ, বাংলা কলেজের পেছনে আমবাগান, মিরপুর সিরামিকস, আলোকদি, সিন্নিরটেক, গোলারটেক প্রভৃতি। ফিরে যাই আনিসুর রহমানের সেই প্রতিবেদনেঃ

“ক’হাজার লোককে সেখানে হত্যা করা হয়েছে? যদি বলি দশ হাজার, যদি বলি বিশ হাজার, কি পচিশ হাজার তাহলে কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তৃণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির উপর পা ফেলতে পারিনি। (ক্ষমা কর শহীদ ভাই বোনেরা, দেশের জন্য আত্মদান করার পরেও তোমাদের হাড় মাড়িয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। কেউ আজ পর্যন্ত তোমাদের সৎকারে এগিয়ে এলো না।) দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়। মাংসহীন পায়ের হাড়ে এখনো লেগে আছে জুতো। কোমরের হাড়ের সঙ্গে লেগে রয়েছে জাঙ্গিয়াসহ টেট্রনের প্যান্ট। কঙ্কালের পাশে পাশেই পড়ে আছে আমার সতীসাধ্বী মায়ের বরখাটি পর্যন্ত।“

বিজ্ঞাপন

মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনের সিরামিকস ফ্যাক্টরীর পাশ দিয়ে বর্তমান সাগুফতা হাউজিং যাবার সড়কটির ঠিক মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু কলেজের পূর্বপাশ্বে ছিল কালাপানি বধ্যভূমির অবস্থান। স্থানীয় বাসিন্দা জনাব মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন ভূঁইয়া (৭১) ছিলেন একাত্তরে নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের ছাত্র, স্বচক্ষে দেখেছেন বিহারীদের বীভৎসতার নমুনা। যে পরিমাণ লাশ ও দেহাবশেষ উদ্ধার হয়েছিল এই কালাপানি বধ্যভূমি থেকে, তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে লাশ চিরতরে হারিয়ে গেছে। বৃহত্তর মিরপুর ও হরিরামপুরের চেয়ারম্যান, আওয়ামীলীগ নেতা ও মিরপুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিতকরণের জন্য গঠিত কোলাবরেটর কোর্টের চেয়ারম্যান ফকির শফিরউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে হারুণ মোল্লা, আবদুল মালেক, ডাঃ মনসুর, ডাঃ মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা কামালউদ্দিন ও মিরপুর থানার ওসি ইকবালের তৎপরতায় উদ্ধার করা হয় ৮১ বস্তারও বেশি দেহাবশেষ। তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলের জামায়াত নেতা এ জি খান এবং বিহারী কসাই আখতার গুন্ডা, সরফু গুন্ডা ও মাস্তানা ছিল নয় মাস ব্যাপী বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞের অন্যতম প্রধান হোতা। ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা কাদের মোল্লা ছিল মিরপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গণহত্যার প্রধান সমন্বয়কারী ও তত্ত্বাবধায়ক।

বিহারি অধ্যুষিত এলাকার বধ্যভূমিগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো- কুয়ো, ম্যানহোল ও সেপটিক ট্যাঙ্ক ও ছোট জলাশয়গুলোকে বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার। যেহেতু মেরে ফেলার পর লাশের ব্যবস্থা একটা সমস্যা, সুতরাং সামগ্রিকভাবে ৭০ ভাগেরও বেশি বধ্যভূমি ছিল বিভিন্ন জলাশয় ও প্রবাহমান নদী-খালের ধারে, যেন হত্যা করে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যায় প্রবাহমান জলে, ভেসে যায় লাশ। পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে এই বিহারিরা বাঙালিকে হত্যা করার সময় যে পদ্ধতি ব্যবহার করে তার মধ্যে অন্যতম হলো- তলোয়ার দিয়ে মাথা ছিন্ন করা, ছুরি দিয়ে জবাই করা, ভারী ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে সমগ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে টুকরো টুকরো করা। এককথায় বীভৎসভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করা। শত্রুদেহকে মিউটিলিশন করার ব্যাপারে এই বিহারিরা সিদ্ধহস্ত ছিল।

ফিরে যাই আনিসুর রহমানের প্রতিবেদনে, যেখানে তিনি শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে ঘটা জেনোসাইডের রোমহর্ষক বর্নণা তুলে ধরেছেনঃ

“ইতিহাসে পৈশাচিকভাবে হত্যা করার অনেক কাহিনী পড়েছি। কিন্তু শিয়ালবাড়িতে ঐ পিশাচেরা যা করেছে এমন নির্মমতার কথা কি কেউ পড়েছেন, শুনেছেন বা দেখেছেন? কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোশত কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে দেখলাম কিমা করা হয়েছে হাড়। একটা মানুষকে দু’টুকরা করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়। কিন্তু তাকে কিমা করা কেমন পাশবিক উল্লাস? লাশের পাশে দেখেছি বর-কনের গলায় পরার মালা। এ থেকে এবং স্থানীয় লোকদের তথ্যাবলীতে মনে হয়েছে হত্যার আগে পিশাচেরা অনেককে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে নওশা দুলহার মত সাজিয়ে এনেছে। আয়োজন করে গুছিয়ে এনে তারপরে ভয়ংকর আক্রোশে নৃশংসভাবে মেরেছে। সম্ভবত এতে পিশাচদের পৈশাচিক আনন্দ বাড়ে। হয়তো সেই হতভাগ্যরা ছিল সাধারণের চাইতে একটু উপরে। হয়তো বুদ্ধিজীবী, হয়তো রাজনীতিক। তাই তাদের হত্যাও করা হয়েছে বাকিদের চেয়ে আলাদারকম পাশবিকতায়।”

বিজ্ঞাপন

পুরো শিয়ালবাড়ি একাত্তরে পরিণত হয়েছিল বীভৎস মৃত্যুপুরীতে। চেয়ারম্যান ফকির শফিরউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, এখানে-ওখানে, ঝোপ-ঝাড়ে, ডোবায়, কুয়ায়, নির্জন মাঠে, বৃক্ষঘেরা নির্জন ভিটায় সর্বত্র শুধুই লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ তারা পেয়েছেন শিয়ালবাড়ি থেকেই। প্রশিকা ভবন থেকে কমার্স কলেজ যেতে যে কালভার্টটি পড়ে, তার পাশের উত্তরদিকের দোকান দুটোর নীচে এখনো মাটি চাপা পড়ে আছে আনুমানিক ৩৫০টিরও বেশি মাথার খুলি। এছাড়া সৈয়দ আলী জামে মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যে পরিত্যক্ত ঢেকে যাওয়া কুয়াটি ছিল, সেটি পরিপূর্ণ ছিল মানুষের লাশে। ৬ নং রোডের ( গণকবরের উত্তর দিকের রাস্তা) শেষের দিকে একটা মাঠ ছিল, সেই মাঠের তেঁতুল গাছের নীচে স্তুপাকৃতি হয়ে পড়ে ছিল আনুমানিক দুইশ’র বেশি লাশ। প্রত্যক্ষদর্শী নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, কালভার্টের পাশে প্রায় ৬০ বস্তা মাথার খুলি পেয়েছিলাম আমরা, যেগুলো পরবর্তীতে মাটিচাপা দিয়েছিলাম নীচু জমিতে। সেখানেই এখন দুটো দোকান আছে। একটা মুদি দোকান আরেকটা ভাঙ্গারি দোকান। (প্লট দুটির ঠিকানা, ব্লক-বি, লাইন-২, প্লট, এস-১ ও এস-২, মিরপুর-২)

এতো পরিমাণে লাশ শেষপর্যন্ত আর কোন উপায় না দেখে দশ কাঠা জায়গা জুড়ে বিশাল গণকবর তৈরি করে সেখানে কবর দেয়া হয়। আফসোস, শহীদদের দেহাবশেষ থাকা সেই জমিন দখল হতে হতে আর মাত্র ২ কাঠ জমি বাকি আছে। একাত্তরের শুরুতে যেখানে দুই-আড়াই হাজারের বসতি ছিল, সেখানে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে যখন মিরপুর মুক্ত হয়, তখন স্রেফ ৫০-৬০ ঘর লোক ছিল। বেশিরভাগ পরিবারের সবাইকেই বিহারীরা মেরে ফেলেছিল। যেসব পরিবার তখন ছিল শিয়ালবাড়িতে, আপনজনদের হারিয়ে তারা ছিল জীবন্মৃতের মতন।

প্রায় ২০ হাজার সুপ্রশিক্ষিত বিহারীর বিশাল এক বাহিনী একাত্তরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর দখলে রেখেছিল। একাতত্র জুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো এই পিশাচদের নির্মূলে একাত্তরের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থানার গেরিলা কমান্ডার শহীদুল হক (মামা) নেতৃত্বে মামা গ্রুপ, বাবর গ্রুপ, তৈয়বুর গ্রুপ, হানিফ গ্রুপ ও বিএলএফের মুক্তিযোদ্ধারা ইপিআর জোয়ানদের সাথে মিলে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু বিহারী ও পালিয়ে যাওয়া পাকিস্তানী সেনাদের হাতে থাকা প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদের সাথে পেরে ওঠেননি মুক্তিযোদ্ধারা, তৈয়বুর গ্রুপের রফিকসহ নাম না জানা বেস কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। পরদিন ৩০ জানুয়ারি সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশের চৌকস এক দল, কিন্তু আচমকা বিহারিদের এক অ্যাম্বুশে পড়ে নিহত হন ৪১ জন সেনাসদস্য ও ৮০ জন পুলিশ, বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট সেলিম, পুলিশ এসপি জিয়াউল হক লোদী এবং ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানসহ আরো অনেকে। তাদের অসামান্য আত্মত্যাগে পরদিন ৩১ জানুয়ারি মুক্ত হয় মিরপুর!

তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ

১। মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুর/জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যভেদ/জুলফিকার আলী মানিক

২। মিরপুরের দশ বধ্যভূমি/ মিরাজ মিজু

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন