বিজ্ঞাপন

মিশন ২০৪১: আমিই সল্যুশন— কেমন হবে আগামীর স্মার্ট সরকার?

January 31, 2024 | 8:36 pm

মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন

একজন অস্বচ্ছল নারী। সংসার চালানোর অর্থ জোগান দিতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে সরকারের সামাজিক আর্থিক নিরাপত্তার আওতায় বয়স্ক ভাতা। কিন্তু কীভাবে এই ভাতার জন্য আবেদন করতে হয়, তিনি জানেন না। আবার দুর্ভোগ পোহানোর ভয়ে সরকারি অফিসেও যেতে পারেন না। এমন সময়ে তার জন্য স্মার্ট সমাধান ‘মাইগভ অ্যাপ’ নিয়ে পাশে হাজির হয় তার নাতি। এখানে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দিয়েই অ্যাপেই করা যায় আবেদন। যাচাই-বাছাই শেষে মোবাইল ফোনেই মিলছে ভাতার খবর।

বিজ্ঞাপন

এখন ঘরে শুয়ে-বসেই ভাতার টাকা পেয়ে যাচ্ছেন এমন হাজারও অস্বচ্ছল নারী। যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময়ে কাগজহীন পদ্ধতিতে আবেদন থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ভাতা পাওয়া সবকিছুই হয়ে যাচ্ছে স্মার্ট পদ্ধতিতে। চিন্তা নেই লাইনে দাঁড়ানোর, দৌড়ঝাঁপের। সরকারি সেবা এখন মোবাইলে, আপনার হাতেই।

শুধু ভাতা নয়, নাগরিকের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের সরকারি সেবা প্রদান করবে এমন প্ল্যাটফর্ম। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, পরিবহন, কৃষি, অভিবাসন, রাজস্ব, বিচারব্যবস্থা, সংসদ, স্থানীয় সরকার, কূটনীতি, সরকারি ক্রয়, জননিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ সরকারি সেবার অধীন সবকিছুই হবে স্মার্ট। এটি কোনো স্বপ্ন নয়। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশে সরকারি সেবা ব্যক্তির চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাবে। কেননা তখন বাংলাদেশের সরকার হবে স্মার্ট সরকার।

ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি পরিচালিত ব্যক্তি-চাহিদা অনুযায়ী সরকারি সেবা প্রদানের এই কাজগুলো করে দেবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সিস্টেমই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেবাগ্রহীতার কাছে সেবাকে পৌঁছে দেবে। পরম বন্ধুর মতো প্রতিটি ধাপে সহায়তা করবে। সেবা নেওয়ার পর নাগরিকরা সেবাগ্রহণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ প্রদান করতে পারবেন। সে অনুযায়ী সেবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাবে। এভাবেই তখনকার সরকার হবে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। কাগজবিহীন, উপাত্তনির্ভর, আন্তঃসংযুক্ত, সমন্বিত ও স্বয়ংক্রিয় সরকারব্যবস্থাই স্মার্ট সরকার। তবে এর জন্য আমাদের ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। সরকারি সব সেবা এক প্ল্যাটফর্মে আনার অঙ্গীকার নিয়ে ‘আমার সরকার বা মাইগভ’ প্ল্যাটফর্ম কাজ করছে।

বিজ্ঞাপন

এরই মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে গেছে। সরকারি সেবা ডিজিটাল করার কারণে জনগণের দুর্ভোগ অনেকটা অংশে কমে এসেছে। এটুআইয়ের টিসিবি বিষয়ক সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, উদ্ভাবনী ধারণা প্রয়োগ করে সেবা সহজিকরণ বা সেবা ডিজিটাইজেশনের কারণে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে সেবাগ্রহীতাদের গড়ে প্রায় ৮২ শতাংশ সময়, ৭৮ শতাংশ খরচ ও ৮৫ শতাংশ ভিজিট সাশ্রয় হয়েছে।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা অফিসে কাজের গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে ই-নথি মাধ্যমে কাজ শুরু হয়েছে। এটি প্রচলিত নথি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে নথি নিষ্পত্তির কাগজবিহীন অনলাইন অফিস ব্যবস্থাপনা। এর মধ্যে ভূমি অফিসের কথা না বললেই নয়। ভূমি ব্যবস্থাপনা সহজ, স্বচ্ছ ও নাগরিক-বান্ধব করতে ই-নামজারি চালু করা হয়েছে। এতে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ মামলা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরিচালনা করা যাবে। একদিকে যেমন সময়, খরচ ও যাতায়াত হ্রাস পাবে অন্যদিকে এ খাতে দুর্নীতি ও হয়রানি লাঘব হবে। পাশাপাশি মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যাও কমে আসবে।

স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, উদ্ভাবনী ও জনমুখী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতসহ বিচার বিভাগের সব তথ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিচার বিভাগীয় তথ্য বাতায়ন। বর্তমানে ৬৪টি জেলা আদালতে, পাঁচটি দায়রা আদালতে ও আটটি ট্রাইব্যুনালে বিচার বিভাগীয় বাতায়ন সক্রিয় রয়েছে। এই ব্যবস্থায় আদালত ও নাগরিকের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে। ই-মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা খুব সহজে ও দ্রুততার সঙ্গে অনলাইনে ও প্রয়োজনে অফলাইনে অভিযোগনামা দায়ের, অভিযোগ গঠন, জব্দতালিকা প্রস্তুত, জবানবন্দি গ্রহণ ও আদেশ প্রদান করতে পারেন। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের জটিলতা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়ার চিন্তা থেকেই তৈরি করা হয়েছে উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর অ্যাপ।

বিজ্ঞাপন

এমন আরও বেশকিছু নাগরিক-বান্ধব সরকারি সেবার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)। সরকারি সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরের জন্য একটি সমন্বিত ডিজিটাল সার্ভিস ডিজাইন ল্যাব তৈরি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৯টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অধীন সব দফতর বা সংস্থার জনবান্ধব সব সেবাকে ডিজিটাল সেবায় রূপান্তরের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত এক হাজার ৮৪৪টি সেবা ডিজিটাল ব্যবস্থায় রূপান্তরের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪২৭টি সেবা ডিজিটাল করা হয়েছে।

জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার ও সরকারি দফতর থেকে প্রদেয় সেবাগুলো প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ, অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়সহ ৫২ হাজার দুই শরও অধিক সরকারি দফতরের ওয়েবসাইটের একটি সমন্বিত রূপ বা ওয়েব পোর্টাল হচ্ছে জাতীয় তথ্য বাতায়ন। এই পোর্টালে এ পর্যন্ত সরকারি দফতরের ৮১৩টি ই-সেবা এবং এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট যুক্ত করা হয়েছে।

পাশাপাশি জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের সব নাগরিক সেবা ও তথ্যের জন্য জাতীয় হেল্পলাইনে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করতে পারেন নাগরিকেরা। পাশাপাশি জানাতে পারেন বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের অভিযোগ। জানাতে পারেন সরকারি সেবা সম্পর্কিত নিজস্ব মতামতও। জেনে নিতে পারেন বিভিন্ন নাগরিক তথ্য ও সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান সম্পর্কে। দুর্গমতা, প্রান্তিকতা, প্রচলিত ৯-৫টা অফিস সময়সূচি ও প্রথাগত তুলনামূলক ধীর প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে জনগণের যেকোনো সামাজিক সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রের নিরলস প্রচেষ্টার স্মার্ট সল্যুশন এই জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩।

এর সবই কিন্তু ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট সরকার বাস্তবায়নে নেওয়া উদ্যোগেরই অংশ। স্মার্ট সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় ও ডিজিটালাইজ করে নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করা, সরকারের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সরকারের গৃহীত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে কাগজবিহীন, সহজ ও নাগরিকবান্ধব সেবা নিশ্চিতকরণ, ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ সেবা কাগজবিহীন ও পারসোনালাইজ করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি পরিচালিত ব্যক্তি-চাহিদা অনুযায়ী (পারসোনালাইজড) সেবা দেওয়া। এ জন্য একটি সমন্বিত তথ্যপ্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে বিভিন্ন সরকারি সেবাকে একত্রিত করা হবে। এই স্মার্ট বাংলাদেশ স্ট্যাক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের ঘরে বসেই বিভিন্ন সরকারি সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।

বিজ্ঞাপন

স্মার্ট সরকার পরিচালিত হবে ই-গভর্নেন্স পদ্ধতিতে। সরকারের সকল সেবা, কার্যক্রম ও বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অবস্থা পর্যবেক্ষণে থাকবে ট্র্যাকার। যেমন— ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জনে তথ্যভিত্তিক অনলাইন ডাটাবেজ নিশ্চিতে তৈরি হয়েছে এসডিজি ট্র্যাকার। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে রাখার ফলে সব প্রতিষ্ঠান নিজেদের ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে পারছে। এর ফলে বাস্তবসম্মত নতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে সুবিধা হচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলোর।

স্মার্ট সরকারের নাগরিকবান্ধব সেবাগুলো বাস্তব রূপ লাভ করতে শুরু করেছে। আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশের সরকার হবে স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, কাগজবিহীন, তথ্যনির্ভর, একীভূত, সমন্বিত, স্বয়ংক্রিয় এবং সর্বোপরি স্মার্ট। সেবা পাওয়া যাবে ঝটপট, ঠিক যেন মোবাইলের একটা ক্লিকে! নাগরিকের প্রয়োজনই হবে সরকারি সেবার মূলমন্ত্র, আর সে অনুযায়ী সেবা পৌঁছে যাবে তার হাতে। সরকারি সেবা থেকে বাদ যাবেন না কোনো নাগরিক।

লেখক: প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট (একসেবা ইমপ্লিমেন্টেশন), অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন