বিজ্ঞাপন

বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রথমবার বছরজুড়ে ছাড়াল ১.৫ ডিগ্রির সীমা

February 9, 2024 | 8:31 pm

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারায় নতুন রেকর্ড হয়েছে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বনেতারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১ দশমিক ডিগ্রি বেশির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা এবং ২ ডিগ্রি বেশির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করেছিলেন। এরপর এই প্রথমবারের মতো টানা এক বছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করেছে।

বিজ্ঞাপন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জলবায়ু কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পুরো এক বছরেই তাপমাত্রা ছিল কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বেশি। এতে প্যারিস চুক্তির অঙ্গীকার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম না হলেও তার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বিশ্ব।

বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো গেলে এখনো তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারকে ধীর করা সম্ভব। তার জন্য জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থার সাবেক প্রধান অধ্যাপক স্যার বব ওয়াটসন বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই পরিমাণ গ্রহণযোগ্য যেকোনো মাত্রার চেয়ে বেশি। এই যে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে, তাতেই কিন্তু আমরা বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের দুর্যোগ দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, বেশকিছু দেশে তীব্র খরা দেখা গেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে দাবদাহ ও দাবানলও ছড়িয়ে পড়েছে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে কী হবে, তার আঁচ কিন্তু এ থেকেই পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই খবর এমন একটি সময়ে এলো যখন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি পরিবেশবান্ধব নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে ‘গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’ হিসেবে বছরে ২৮০০ কোটি পাউন্ড খরচের সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টিও বেশকিছু পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।

অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলই পরিবেশবিষয়ক এমন কিছু অঙ্গীকার থেকে পিছু হটেছে, যেগুলো বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। বিজ্ঞানীরাও বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে বাজে প্রভাব এড়াতে চাইলে এ ধরনের উদ্যোগগুলোরই বেশি প্রয়োজন ছিল।

জলবায়ু সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, সমুদ্রতলের গড় তাপমাত্রাও রেকর্ডের চূড়া স্পর্শ করেছে। গত বছরের ২৩ আগস্ট সমুদ্রতলের গড় তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়েছিল ২১ দশমিক ০২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই রেকর্ড ভেঙে গত ৩ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রতলের গড় তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয় ২১ দশমিক ০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ৪৫ বছরে আর কখনো সমুদ্রতলের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেনি। এর পেছনেও বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ডেরই প্রভাব দেখছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞাপন

বৈশ্বিক তাপমাত্রা ঠিক কতটুকু বেড়েছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত— আধুনিক যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে উষ্ণতম সময় অতিক্রম করছে বিশ্ব। আর এই উষ্ণতম সময়ের মেয়াদ দীর্ঘতর হবে বলেই আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা পরিবেশ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের অভিমত, বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে এই সীমার মধ্যে রাখা গেলে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলাসহ পরিবেশগত অনেক কিছুই সহজ হবে। জাতিসংঘের ২০১৮ সালের এক মাইলফলক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে দাবদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অন্যান্য যেসব ঝুঁকি, সেই ঝুঁকিই কয়েক গুণ বেড়ে যাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, টানা এক বছর ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রমের পেছনে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণই প্রধানত দায়ী। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস নিঃসরণ বেড়েছে, যা উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করছে। সম্প্রতি জলবায়ুজনিত এল নিনোর কারণেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি গতি পেয়েছে। কেবল এল নিনোর কারণেই শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়ে থাকে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

এ পরিস্থিতি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনো কমানো সম্ভব কি না— সেই প্রশ্নও উঠেছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যে হারে কার্বন নিঃসরণ ঘটছে, তাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না। বরং গত টানা এক বছরের মতো আগামী দশকজুড়েই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির সীমা অতিক্রমের ঘটনা হবে নিয়মিত। তাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণও ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়বে।

বিজ্ঞাপন

তীব্র দাবদাহ, খরা, দাবানল, বন্যার মতো যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি আমরা গত এক বছরে হয়েছি, এ অবস্থায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সীমা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির সীমার বদলে ২ ডিগ্রি বেশির সীমা অতিক্রম করলে সেগুলোর তীব্রতা আরও বাড়বে। শুধু তাই নয়, ওই সময় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব এমন একটি স্থানে পৌঁছে যাবে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণের আর কোনো সুযোগ থাকবে না। অনেক বদলই আসবে, যেগুলো অপরিবর্তনীয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকের বরফের চাঁইগুলো যদি একবার গলনাঙ্ক অতিক্রম করে, তা বৈশ্বিকভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বিপর্যয়কর পরিমাণে বাড়িয়ে দেবে, যার জের হয়তো টানতে হবে আরও শত বছর ধরে।

এত কিছুর মধ্যেও বিজ্ঞানী-গবেষকরা বিশ্বাস করেন, মানবজাতির পক্ষে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নবায়নযোগ্য জ্বালানি কিংবা বৈদ্যুতিক যানবাহনের মতো অনেক গ্রিন টেকনোলজি বা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেকেই কাজ করছে। শিল্প কারখানাগুলোকেও পরিবেশবান্ধব করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা বিশ্বনেতারা অব্যাহত রাখবেন এবং কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলেই বিশ্বাস করতে চান তারা। আর সেটি হলে হয়তো উষ্ণায়নের প্রভাব কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বার্কলে আর্থের জলবায়ু বিজ্ঞানী জেক হসফাদার বলেন, একটি সমাজ হিসেবে আমরা কোন পথ বেছে নেব এবং গ্রহ হিসেবে পৃথিবীর জন্য কোন পথ বেছে নেব, তার ওপরই মূলত নির্ভর করবে আমরা উষ্ণায়ন কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। আমাদের সেদিকেই নজর দিতে হবে। ধ্বংসই যে অনিবার্য, বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু সেটি অনিবার্য হয়ে উঠবে কি না, তাও নির্ভর করবে আমাদের ওপরই।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন