বিজ্ঞাপন

প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরী

February 10, 2024 | 2:55 pm

মো. আরিফুর রহমান আরিফ

উন্নয়নশীল ও জনবহুল দেশে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে টেকসই উন্নয়ন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আর বাংলাদেশ বর্তমানে তেমনই এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। উন্নয়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে; প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তার মধ্যে অন্যতম। কারণ প্লাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের মোট ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৭৯ শতাংশ মাটিতে, ১২ শতাংশ পুড়িয়ে এবং মাত্র ৯ শতাংশ পূনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যই দীর্ঘদিন মাটি ও পানিতে তথা পরিবেশে থেকে যায়। এইসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে মিনারেল ওয়াটার, জুস, কোমল পানীয় বোতল, প্লাস্টিকের পলিব্যাগ ও প্লাস্টিকের চালের বস্তা। অন্যসব দেশের মত উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় বাংলাদেশে পরিবেশগত মারাত্মক হুমকি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা জনবহুল হওয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে দৈনিক ৬৪৬ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন, ৩২৮টি পৌরসভায় বর্জ্য উৎপাদনের হার বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮, ২১,২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে কেবল ৫, ২৭,৪২৫ টন প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়। বাকিগুলো পড়ে থাকে সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনায়। বাংলাদেশে প্রায় ৩ শতাধিক প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা থাকলেও দেশজুড়ে উৎপন্ন প্লাস্টিক বর্জ্যের কেবল অর্ধেক পরিশোধিত হচ্ছে। সম্প্রতি রিসার্চগেটের একটি স্টাডি জানিয়েছে বিশ্বের প্লাস্টিক বর্জ্যের ২.৪ ভাগের জন্যেই দায়ি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা।
প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বর্জ্যগুলো মাটি ও পানির সাথে মিশে মাটির গুনাগুন নষ্টের সঙ্গে সঙ্গে পানিতে থাকা জীববৈচিত্রের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে। খাল, নদী ও সাগরে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিনের পরিমান বেড়েই চলছে। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ভাসছে, যা প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সমুদ্রে যে হারে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বাড়ছে এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতের জন্য পৃথিবী মারাত্মকভাবে ভয়ানক হয়ে উঠবে। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির পর দ্বিতীয় বড় হুমকিটি প্লাস্টিক বর্জ্য। ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা ও রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য অন্যতম। মাটির স্তরে-স্তরে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বর্জ্য বাড়ার ফলে ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলোর পরিপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না।

যেভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে

২০০১ সালে বাংলাদেশে সকল ধরনের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু আইন করা হলেও সুষ্ঠু তদারকি ও সদিচ্ছার অভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা পলিথিনের ব্যাগ বানাচ্ছে, বাজারজাত করছে আর আমরা সেই পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে নিত্যদিনের বাজার বহন করছি। অর্থাৎ ১০ টাকার কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে ১০-১৫ কেজি চালও পলিথিনের ব্যাগে বহন করি। বিনিময়ে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে দূষিত পরিবেশের মাঝে ঠেলে দিচ্ছি। আমরা দোকান থেকে পানি, জুস, কোমল পানীয় কিনে পান করার পর বোতলের মুখ না লাগিয়ে ফেলছি নদী-নালা, রাস্তা-ঘাট ও খোলা ড্রেনে। বোতলের মুখ না লাগানোর ফলে বোতলটি ডুবে যাচ্ছে পানির নিচে অথবা মাটি চাপা পড়ছে। যার কারনে সৃষ্ট হচ্ছে জলাবদ্ধতা, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং নদ-নদী ও সমুদ্রের তলদেশে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্য। এই প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বর্জ্য খেয়ে কত বিশাল আকৃতির নীল তিমি, হাঙ্গর ও ডলফিন পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। তাহলে ভাবুন ক্ষুদ্রাকৃতির অন্যান্য জলজ প্রানীর অবস্থা কি হচ্ছে! আমরা অবাক হই তখন, যখন দেখি ঢাকাতে ড্রেন, সুয়ারেজ ও ম্যানহোলের পানির স্বাভাবিক চলাচলে পরিস্কার অভিযান পরিচালনা করা হয় তখন প্লাস্টিকের বোতল আর পলিথিনের বিশাল পাহাড়ের মত স্তুপ দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

আমাদের মত অসচেতন মানুষের কারনেই আজ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে হচ্ছে। প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন নির্দিষ্ট স্থানে ফেললে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য উভয়ই ভাল থাকবে। আমরা যদি ব্যবহৃত বোতলের মুখ বন্ধ করে সঠিক স্থানে ফেলি তাতে উভয়েরই লাভ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কর্মীরা এই ওয়ানটাইম প্লাস্টিক বোতলগুলো বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে, আমরাও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়ে পরিবেশে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য দূষণ রোধে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে পারি।

প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ রোধে নতুন করে ভাবতে হবে

সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডের এক গবেষক দল নতুন ডিজাইনের পানির বোতল বাজারে এনেছে। বিভিন্ন গবেষনায় জানা যায় যে, সারাবিশ্বের সমুদ্রতীরে জমা হওয়া প্রধান পাঁচ দূষণকারী উপাদানের একটি হলো প্লাস্টিক বোতলের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মুখ। কারণ ক্ষুদ্রাকৃতির এই প্লাস্টিক পণ্য সহজেই বোতল থেকে খুলে আলাদা করে ফেলে দেওয়া হয়। প্লাস্টিক বোতলের মুখের মাধ্যমে সৃষ্ট দূষণ রোধ করতে নতুন নকশার বোতল বাজারে এনেছে আয়ারল্যান্ডভিত্তিক স্পিং ওয়াটার কোম্পানী (ইশকা)। অর্থাৎ তাদের নকশায় বোতলের সাথে মুখ আটকানো অবস্থায় থাকবে, বোতলের মুখ খোলার পরও তা বোতল থেকে আলাদা করা যাবে না। ফলে বোতলের মুখ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে দূষণের আশঙ্কাও কমবে। উক্ত বোতল ও মুখ এক সাথেই রিসাইক্লিং করা যাবে। আইরিশ কোম্পানীর উক্ত নকশার বোতল বাংলাদেশেও তৈরী ও বাজারজাত করা যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

ই-বর্জ্য ও বাংলাদেশের ই-বর্জ্য পরিস্থিতি

ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম (টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার ও ব্যাটারি) যন্ত্রপাতিকে বোঝায়। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২২ প্রতিবেদনে বলা হয় প্রতি বছর দেশে ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ পূনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ হয়। বাকি ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় দেশের নদী-নালা ও ভাগাড়গুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত প্লাস্টিকজাত ফেলে পৃথিবীতে ই-বর্জ্য দূষণের সুনামি চলছে। ই-বর্জ্যর মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দূষণের মাধ্যমে সুপেয় পানির প্রাপ্যতাকে কঠিন করে তোলা হচ্ছে। এর প্রভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও প্রাণীকূলের বংশবিস্তারে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং খাতে ৮৩% শিশু-কিশোর জড়িত। যাদের অধিকাংশ ফুসফুস বিকল, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক বিষন্নতা, নার্ভ সিস্টেমের দূর্বলতা ও শ্রবনশক্তি হ্রাসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

ই-বর্জ্যের ঝুঁকি প্রতিহতের উপায়

১. ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রচারনা, সচেতনতা ও জনমত তৈরীতে উদ্যোগ নিতে হবে।
২. ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো রিসাইক্লিং বা পূনঃচক্রায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলায় উদ্ধুদ্ধ করতে হবে।
৩. পরিবেশসম্মত ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে।
৪. দীর্ঘদিন ব্যবহার উপযোগী ইলেকট্রনিক্স পণ্য ক্রয় করতে হবে।
৫. ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং খাতে ব্যাংক ঋণের সহজলভ্যতা করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সম্ভাবনাময় প্লাস্টিক শিল্প

গৃহস্থালি পুরানো ফেলনা প্লাস্টিক সামগ্রী, কাটিং পাইপ ও খালি বোতল এখন আর ফেলনা নয়! শুধু প্রয়োজনে যথাযথ ব্যবহার উপযোগী করে তোলা। একজন হকার বাড়ি-বাড়ি গিয়ে আলু, পেঁয়াজ এর পরিবর্তে প্লাস্টিক পণ্য ও টাকা দিয়ে প্লাস্টিক ক্রয় করে নিয়ে পাইকারি বিক্রয় করছে। এতে প্রায় ২ হাজার প্লাস্টিক শিল্প-কলকারখানার চাকা ঘুরছে। উক্ত ফেলনা প্লাস্টিক দিয়েই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক শিল্পে রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে তৈরী হচ্ছে ঘর সাজানো বাহারি রকমের নতুন পণ্য সামগ্রী। যেমন ঝুড়ি, হ্যাঙ্গার, টেবিল, চেয়ার, চামচ, বালতি, মগ, জগ, প্লেট, গাড়ি, পুতুল, বোতাম, ক্লিপ, পোল্টি ও মৎস্য খাতের বিভিন্ন পণ্য, সাইকেলের যন্ত্রাংশ, ফুলের টব, বলপেন, স্কেল ইত্যাদি। আর এ কাজের জন্যই বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ফেরিওয়ালারা ব্যবহৃত পুরাতন প্লাস্টিক পণ্য কম দামে সংগ্রহ করে বেশি দামে বিক্রি করতে পারছে। ফলে তাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। হতদরিদ্র কিংবা ছিন্নমূল মানুষ ও পথশিশুরা রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা পুরানো প্লাস্টিক পন্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। এই প্লাস্টিক স্থানীয় ভাঙ্গারী ব্যবসায়িরা কেজি হিসেবে কিনে পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করছে। পাইকারি বিক্রেতারা সেগুলো কেনার পর বোতল থেকে লেভেল ছাড়িয়ে আলাদা করার পর ছোট-ছোট টুকরা করে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ ও লালবাগে রিসাইক্লিং কারখানায় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। পরিশেষে দেশের পরিবেশ রক্ষায় সুষ্ঠু প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অবশ্যই আইন প্রণয়ন করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সঠিক নিয়মে বর্জ্য সংগ্রহের হার বৃদ্ধি উপযোগী ও উন্নত বর্জ্য পরিবহন পদ্ধতি, সঠিক স্থানে ড্যাম্পিং এবং জনস্বাস্থের প্রতি হুমকি সৃষ্টি না হয় এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি কাজে লাগানো। অতএব পরিবেশ রক্ষায় টেকসহ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন