বিজ্ঞাপন

মসিক নির্বাচন: এবার বিনা বাধায় পার পাচ্ছেন না টিটু

February 12, 2024 | 8:44 pm

কাজী মোহাম্মদ মোস্তফা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

ময়মনসিংহ: ঘনিয়ে আসা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ময়মনসিংহের অলিগলিতে ছড়াচ্ছে রাজনৈতিক উত্তাপ। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা স্বপ্নের ঝাঁপি মেলে ধরছেন নগরবাসীর কাছে। অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে পোস্টার-লিফলেটে ছড়িয়ে দিচ্ছেন উন্নয়ন-প্রতিশ্রুতির কথা।

বিজ্ঞাপন

এই সিটির প্রথম নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু। তবে এবারে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সুযোগ দেখছেন না স্থানীয়রা। তারা বলছেন, যিনিই মেয়র হোন না কেন, তাকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে এবার।

কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমান মেয়র টিটু ছাড়াও আওয়ামী লীগেরই অন্তত আরও চারজন এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। সেক্ষেত্রে দলের মনোনয়ন না পেলেও জাতীয় নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও কেউ কেউ স্বতন্ত্র হিসেবে দলীয় প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে পারেন।

ময়মনসিংহকে দেশের অষ্টম বিভাগ ঘোষণার পরপরই গঠিত হয় ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন (মসিক)। ওই সময় ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. ইকরামুল হক টিটু। মসিক গঠনের পরপরই তিনি করপোরেশনের প্রশাসক নিযুক্ত হন। পরে এই সিটি করপোরেশন প্রথম নির্বাচন হয় ২০১৯ সালের ৫ মে। প্রশাসক পদে থেকেই মেয়র নির্বাচন করেন টিটু।

বিজ্ঞাপন

ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। জাতীয় পার্টির একজন প্রার্থী হলেও পরে দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. ইকরামুল হক টিটু। এবারও তিনি প্রার্থী হতে চাচ্ছেন। তবে এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং ‘টিটু ঠেকাও’ আওয়াজ বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে ময়মনসিংহের রাজনৈতিক অঙ্গনে।

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) দ্বিতীয় নির্বাচন হবে আগামী ৯ মার্চ। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সিটি নির্বাচন নিয়ে সরব নগরবাসী। সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থিতার জানান দিচ্ছেন।

স্থানীয় রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী পাঁচজন। জাতীয় পার্টি প্রার্থী রাখছে একজনকেই। জাতীয় নির্বাচনের মতো বিএনপি এই নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে জাতীয় পার্টি কিংবা বিএনপির অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, সিটির দ্বিতীয় এই নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উত্তেজনা-উৎকণ্ঠার কমতি নেই।

বিজ্ঞাপন

ময়মনসিংহ সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু ছাড়াও নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে জেলা কমিটির সভাপতি এহতেশামুল আলম, সাবেক উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সাদেক খান মিল্কি টজু, মহানগরের সহসভাপতি অধ্যাপক গোলম ফেরদৌস জিলু এবং মহানগর সদস্য ও প্রয়াত পৌর মেয়র মাহমুদ আল নূর তারেকের ছেলে ফারমার্জ আল নূর রাজীব।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ছেলে মোহিত উর রহমান শান্ত। তার বিপক্ষে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন সিটি মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটুর বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. আমিনুল হক শামীম।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের ধারণা, সিটি নির্বাচনে সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্তও তার সমর্থনপুষ্ট কাউকে টিটুর বিরুদ্ধে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সর্মথন দেবেন। আর এই মেরুকরণের কারণেই বর্তমান মেয়র দলীয় মনোনয়ন পেলেও তাকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে।

এ বিষয়টি নিয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি দায়িত্বশীল কেউ। তারা মুখে মুখে বলছেন, দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করবেন। তবে জাতীয় নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও দলীয় নেতাদের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থিতা উন্মুক্ত থাকলে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করার কথা জানিয়েছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

যা বলছেন আ.লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা

প্রথম মেয়র হিসেবে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন বলে দাবি বর্তমান মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটুর। ফের নির্বাচিত হলে অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার অঙ্গীকার তার।

টিটু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বড় পরিকল্পনা নিয়ে নগরবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু বৈশ্বিক সংকট আর করোনা মহামারির কারণে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়। তারপরও নগরের বিভিন্ন সড়ক-রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ চলমান রয়েছে। আমি আশাবাদী, দল আমাকে ফের মনোনয়ন দেবে। ফের নির্বাচিত হলে অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়ন করে একটি স্মার্ট, সমৃদ্ধ ও আধুনিক ময়মনসিংহ গড়ে তুলব।’

ময়মনসিংহবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে জানিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এহতেশামুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের কাছে আমার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাদের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়ে নগরীর উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ দেবেন বলে আশা করছি।’

এদিকে সাদেক খান মিল্কি টজু মনে করেন, ময়মনসিংহ শহর অপরিচ্ছন্ন ও অপরিকল্পিত। তিনি বলেন, নগরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে শত শত আকাশছোঁয়া ভবন হচ্ছে। কিন্তু সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। যানজটে নাকাল ময়মনসিংহ ধীরগতির শহরে এখন বিশ্ব তালিকায় ৯ নম্বরে রয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। নগরবাসীর ভালোবাসা সর্মথন পেলে শহরকে পরিচ্ছন্ন ও স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়বেন বলে জানান তিনি।

এদিকে বাবার উত্তরাধিকার বহনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ফারমার্জ আল নূর রাজীব। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবা এই পৌরসভায় দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান ও প্রথম মেয়র ছিলেন। মেয়র থাকা অবস্থাতেই ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এই শহর নিয়ে বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাকে আধুনিক ময়মনসিংহের রূপকার বলা হয়ে থাকে। বাবার স্বপ্নপূরণে এই শহর নিয়ে কাজ করতে চাই।’

নাগরিকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে প্রায় পুরো মেযাদ পার করার পথে রয়েছেন ইকরামুল হক টিটু। এই সময়ের মধ্যে তিনি সিটি করপোরেশন বা নগরবাসীর জন্য কী অবদান রেখেছেন, তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে সিটির বাসিন্দাদের মধ্যে। কেউ কেউ তার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানালেও অনেকে একেবারেই সন্তুষ্ট নন।

কালীবাড়ি কবরখানা এলাকার আবুল হাসেম রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নগরবাসী দেখেছে মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটুর উন্নয়ন পরিকল্পনা। বর্তমান মেয়র যেসব উন্নয়ন করেছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি স্বপ্ন দেখেন আধুনিক র্স্মাট নগরী গড়ার। নগরবাসীও চায় তিনিই সিটি মেয়র হবেন।’

বিপরীত অভিমত জানিয়ে নগরীর চামড়া গুদাম এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল গফুর বলেন, ‘যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী কোনো সমাধান আসেনি। সড়ক উন্নয়নের নামে নগরীর কিছু এলাকার বাড়িঘর তলিয়ে যাচ্ছে। নগরবাসী একটু পরিবর্তন চায়।’

পরিবেশ আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট শাহ শিব্বির আহমেদ লিটনও নতুন কাউকে মেয়র চান। তিনি বলেন, এটি দেশের সর্বকনিষ্ঠ সিটি করপোরেশন। এটি হবে আইকনিক বা মডেল। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি গত পাঁচ বছরে। আমরা আশা করি এমন একজন মেয়র আসবেন, যিনি এ নগরীকে পালটে দেবেন। নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হবেন নতুন মেয়র, এটিই প্রত্যাশা করি।

পণ্ডিতপাড়ার রিপন বসাক বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পড়বে না। নগরবাসী যোগ্য ব্যক্তিকেই নির্বাচিত করবেন। যত বেশি প্রার্থী হবেন নগরবাসী তত দ্বিধায় পড়বেন।’

যিনিই মেয়র হোন না কেন, তার কাছেই নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনউদ্যোগের আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম চুন্নু। তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন হয়েছে। আয়তন বেড়েছে, বাজেট বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যয়। উন্নয়ন অনেক হয়েছে। কিন্তু যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে এই ময়মনসিংহ সিটি। বহু বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। সেগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্প সহনশীলতা বা আগুন লাগলে নির্বাপণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আমরা নাগরিক সুবিধার সবটুকুই চাই। চাই জনগণের মতামতের ভিত্তিতে পরিকল্পিত নগরী।’

এদিকে জাতীয় পার্টির দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় শ্রমিক পার্টির জেলা সভাপতি শহিদুল ইসলাম স্বপন মন্ডল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। আর কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি বলে জানিয়েছে মহানগর বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ আমজাদ আলী।

তফসিল অনুযায়ী এই সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে ১৩ ফেব্রুয়ারি। যাচাই-বাছাইয়ের পর বৈধ প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে পারবেন ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে। সিটির মেয়র পদের পাশাপাশি ৩৩ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ১১ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ভোট নেওয়া হবে ৯ মার্চ।

সারাবাংলা/পিটিএম/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন