বিজ্ঞাপন

সাড়ে ৫ হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড়, অসহায় বনবিভাগ!

May 24, 2018 | 9:04 am

।। জান্নাতুল ফেরদৌসী ও জাকিয়া আহমেদ।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার থেকে: প্রতিদিন ৭৩০ মেট্রিক টন কাঠ জ্বালানি হিসেবে যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। এ কারণে এরইমধ্যে জেলার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একরের বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে বনভূমি ধ্বংস হতে থাকলে ২০১৯ সালের মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের সব বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই ধ্বংস ঠেকাতে অনেকটাই অসহায় জেলা বনবিভাগ। দফায় দফায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়েও এ বিষয়ে করণীয় কী তার উত্তর পাননি তারা।

সরেজমিনে উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী এলাকায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় সবাই মাথায় কিংবা কাঁধে করে বিভিন্ন সাইজের গাছ, কাঠ নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দূরের বন থেকে বিনা পয়সায় তারা এসব গাছ কেটে আনছেন। কেউ ঘরের খুঁটির জন্য, কেউ ঘরের চালার জন্য আবার কেউ বা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করবেন।

বিজ্ঞাপন

কুতুপালং রাস্তার মাথার বাজার গ্রামের বাসিন্দা শুভধন শর্মা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাছ তো গাছই, গুড়িসহ উপড়ে নিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। আর কক্সবাজারের মাটির ধরন অনুযায়ী, গাছের গুড়ি উপরে নিলে সেখানে আর নতুন করে গাছ জন্মানোর কোনও সুযোগ নেই। তাই কমে যাচ্ছে এলাকার গাছ।’

শুভধনের কথার সত্যতা মেলে এই বাজারের দোকান এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্থানীয় বাজারে। বাজারের দোকানগুলোতে তাজা এবং শুকনো কাঠ সাজিয়ে রাখা হয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য। রাস্তাতেও চোখে পড়ে কাঠ বোঝাই বড় বড় ট্রাক, যাচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসতে থাকে বাংলাদেশ, আশ্রয় নেয় কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়ার পাহাড়গুলোয়। বর্তমানে এ দুই উপজেলার ত্রিশটি ক্যাম্পের বিভিন্ন পাহাড়ে বসবাস করছেন তারা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে কাটতে হয়েছে এখানকার পাহাড়, উজাড় হয়েছে জেলার রির্জাভ ফরেস্ট ও বনভূমি।

জেলা বনবিভাগ থেকে জানা যায়, গত আগস্ট মাস থেকে দিনে ৫০০ একর বনভূমি উজার হয়েছে রোহিঙ্গাদের জ্বালানি কাঠের প্রয়োজনে, যা কিনা বড় চারটি ফুটবল মাঠের সমান। আর প্রথম চার মাসে পাঁচ বর্গকিলোমিটার এলাকার বন উজাড় হয়ে গেছে।

বহু মানুষের রান্নার পাশাপাশি বাতিল জিনিসপত্র ব্যাপক হারে পোড়ানোর কারণে দিনদিন বায়ুদূষণও বাড়ছে বলে জানিয়েছে ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ। সংস্থাটি তাদের ২০১৮ সালের শেষার্ধের পরিকল্পনা-পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনর্বাসন বিষয়ক সুপারিশে লিখেছে, বনভূমি উজার হওয়া ও জ্বালানি কাঠ হ্রাস পাওয়ার মতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগানো, নার্সারি স্থাপন ও চারা উৎপাদনসহ বনভূমি সৃষ্টি ও বন ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করা, জ্বালানিকাঠ সংগ্রহের কারণে বনভূমি উজার হওয়া রোধ ও বিকল্প জ্বালানি উৎসকে জনপ্রিয় করতে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন ‘পরিচ্ছন্ন জ্বালানি কর্মসূচি’ হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে আছে গণ রান্নাঘর ও উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ধানের তুষ দিয়ে তৈরি জ্বালানি সরবরাহ, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন, উন্নত চুলা ও তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস ব্যবহারে উৎসাহিত করা এবং ৬ মাসের প্রকল্পের আওতায় শতকরা ২০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীসহ ২৩ হাজার পরিবারকে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসচালিত স্টোভ ও গ্যাস সিলিন্ডার প্রদান করা।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার জেলার উপ বন সংরক্ষক মো. আলী কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউএনডিপিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রতিদিন ৭৩০ মেট্রিক টন গাছ উজাড় হয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পের জ্বালানি হিসেবে। এর ফলে বড় আকারের চারটি ফুটবল মাঠের সমান বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আগামী বছর নাগাদ এই অঞ্চলের বনভূমি আর থাকবে না।’ গত ১৮ এপ্রিল সর্বশেষ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে বনবিভাগের মালিকানাধীন ৫ হাজার ৫১৩.১০ একর রির্জাভ ও প্রটেক্টেড ফরেস্ট উজাড় হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বন উজাড় হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আপনাদের কোনও উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে মো. আলী কবীর বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রতিমাসেই আমরা প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি, কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে কোনও জবাব কখনোই আমরা পাইনি। আমি রির্পোট করে জানিয়েছি, কিন্তু আমার বাধা দেবার কোনও এখতিয়ার নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই রির্জাভ ফরেস্ট যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও লিখিত ডকুমেন্ট (তথ্য) নেই, তবে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মৌখিক স্বীকৃতি রয়েছে।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত আছেন স্থানীয় যুবক তৌহিদুর রহমান। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একবছরে গাছ বলতে কিছু থাকবে বলে মনে হয় না মন্তব্য করে তৌহিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জ্বালানি হিসেবে গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়া হলেও সেগুলো তারা খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। কিন্তু রান্না তো বন্ধ থাকবে না। তাই রাতের আঁধারে হোক আর সবার চোখের সামনে হোক, গাছ তারা কাটবেই, আমাদের পাহাড় আর বন-সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।’

উখিয়ার মৌরিপালা এলাকার স’ মিল কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, মিলের ভেতরে কাঠের স্তুপ। সেখানে বড় গাছ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ছোট ছোট গাছও। মেশিনে গাছের গুড়ি কাটায় ব্যস্ত শ্রমিকরা। শ্রমিক নূরুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, ক্যাম্পের বড় কর্মকর্তা আর এনজিও স্যারদের অর্ডার পাওয়ার পরই তারা এসব গাছ সাইজ করছে। গত ছয়মাসে কাজের অর্ডার বেশি হওয়াতে এই স’মিলেই শ্রমিকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। যেখানে আগে তারা চারজন কাজ করতেন সেখানে এখন কাজ করছেন নয়জন। রোহিঙ্গারা আসার পরই গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে তাদের কাজের চাপ বেড়েছে বলেও জানান তারা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলছে। সমতল ভূমি থাকতে তারা পাহাড়ে কেন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, পাহাড় গেলে তো আর পাহাড় ফেরত পাবো না। পাহাড় ধ্বংস করে তারা ঘরবাড়ি বানাচ্ছে, বনবিভাগের অনুমতির তোয়াক্কা না করে প্রতিদিন কাটা হচ্ছে পাহাড়, সেখানে স্থায়ীভাবে আবাসন গড়ে তুলছে নানা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ১৫ লাখ মানুষের ভারে আমাদের এই পাহাড়, প্রাণী, জঙ্গল, সবুজ-সব হারিয়ে যাচ্ছে।’

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন