বিজ্ঞাপন

একুশের প্রভাতফেরি: বিজয় মরণের স্মৃতির গানে হৃদয়ের অর্ঘ্য

February 21, 2024 | 1:13 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: মায়ের ভাষায় কথা বলাতে যারা হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের বিজয় মরণের স্মৃতি নিয়ে গান গেয়ে শহিদ মিনারে সমবেত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের আপামর মানুষ। ফুল দিয়ে হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন শহিদ স্মৃতির চরণে। একইসঙ্গে শহিদ বেদি ছুঁয়ে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির সংস্কৃতিসহ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে সাম্প্রদায়িক-ধর্মান্ধ অপশক্তির কাছে পরাস্ত হতে না দেওয়ার দৃপ্ত শপথ নিয়েছেন হাজারও মানুষ।

বিজ্ঞাপন

‘সাংস্কৃতিক বলয়’ প্রকল্পের আওতায় নগরীর কেসি দে রোডে নির্মিত ‘কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার’ নিয়ে আপত্তি থাকায় এবারও সংস্কৃতিকর্মীসহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ সেখানে ফুল দেননি। বাধ্য হয়ে এবারও সিটি করপোরেশন মিউনিসিপ্যাল মডেল উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে নির্মিত অস্থায়ী শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে। নগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী ও সাংবাদিক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী কর্মসূচির ধারাভাষ্যে ছিলেন।

মঙ্গলবার রাতে একুশের প্রথম প্রহরে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং নগর আওয়ামী লীগসহ বেশকিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে রাতেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

তবে রাষ্ট্রীয় আয়োজন যা-ই হোক, বাঙালির একুশের ভোরে প্রভাতফেরির যে রীতি, তা-ই মেনেছে চট্টগ্রামের অধিকাংশ সংগঠন। তাই তো, বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর হতেই মানুষ নগ্ন পায়ে, হাতে ফুল নিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গান গেয়ে ছুটেছে শহিদ মিনারের দিকে। কারও কণ্ঠে একুশের কালজয়ী গান, আবার কারও কণ্ঠে স্লোগান। কারও হাতে ব্যানার, কারও হাতে বর্ণমালা, কেউ বা নিয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা, ভাষার জন্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে পতাকা পেয়েছে বাঙালি।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া নবনির্মিত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন আপামর সংস্কৃতিকর্মীরা। চট্টগ্রামের মানুষের দাবি মেনে শহিদ মিনারকে দৃশ্যমান করে দ্রুত খুলে দেওয়ার দাবি তাদের।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে এবার ব্যতিক্রমী আয়োজন হয়েছে নগরীর ফুলকি বিদ্যালয়ে। শত, শত ক্ষুদে শিক্ষার্থী নিজেরাই বাসা থেকে প্লাস্টিক, ককশিট দিয়ে শহিদ মিনার তৈরি করে নিয়ে যান বিদ্যালয়ে। সকালে দিবসের নানা আয়োজনের পাশাপাশি শহিদ মিনারগুলো প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। এ সময় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিজ্ঞাপন

এদিকে বুধবার সকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাই কমিশনার রাজীব রঞ্জন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, মহানগর যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন সকালে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় জেলার সভাপতি অশোক সাহা, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য উত্তম চৌধুরী, সহকারি সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া, সদস্য রেখা চৌধুরী, সিতারা শামীম, ফরিদুল আলম, অজয় সেন, অমিতাভ সেন উপস্থিত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

জেলা যুব ইউনিয়নের সভাপতি মো. শাহআলম এবং সাধারণ সম্পাদক জাবেদ চৌধুরীর নেতৃত্ব নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় কেন্দ্রীয় সদস্য অ্যানি সেন, জেলার সভাপতি ইমরান চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক টিকলু কুমার দে ছিলেন।

ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণমুক্তি ইউনিয়ন, গণসংহতি আন্দোলন জাসদ, ন্যাপ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহবায়ক শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারে ফুল দিয়েছেন।

সাংস্কৃতিক গণসংগঠন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের পক্ষ থেকে শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ সময় উদীচী চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশ, সহ সভাপতি প্রবাল দে, তপন শীল, সহ সম্পাদক জয় সেন, ভাস্কর রায় ও মনীষ মিত্র চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ বাবলা চৌধুরীসহ শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বীরদের শ্রদ্ধা জানিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।

কলরব সংঘ, সৃজামি, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, জেলা আইনজীবী সমিতি, হকার্স সমিতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি গেরিলা বাহিনীসহ আরও বিভিন্ন সংগঠন শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির উদ্যোগে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। কমিটির সভাপতি ডেইজি মওদুদ, সাধারণ সম্পাদক লতিফা আনসারি রুনা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক ফেরদৌস লিপি এসময় উপস্থিত ছিলেন।

ভাষা শহিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সকালে চবি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিভিন্ন বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষক সমিতি এবং ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে উপাচার্য ছাড়াও এসময় রেজিস্ট্রার কেএম নূর আহমদ, প্রক্টর ড. নুরুল আজিম শিকদার উপস্থিত ছিলেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ফুয়াদ মন্ডল সারাবাংলাকে বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনা। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।’

সমাজতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সোহেল রানা সারা বাংলাকে বলেন, ‘১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি মায়ের ভাষা। পৃথিবীতে ভাষার জন্য একমাত্র এ জাতি জীবন বিসর্জন দিয়েছে। সকল ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছি।’

বেসরকারি প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতেও গভীর শ্রদ্ধায় একুশের শহিদদের স্মরণ করা হয়েছে। সকালে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য জনাব বোরহানুল হাসান চৌধুরীসহ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিরা এবং বিভিন্ন বিভাগের পক্ষে আলাদাভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পুষ্পমাল্য অর্পণের আগে ‘হেই সামালো’ গানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নাচ ভিন্ন আবহ তৈরি করে।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য প্রফেসর কাজী শামীম সুলতানা, ট্রেজারার এবং প্রকৌশল ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন তৌফিক সাঈদ, রেজিস্ট্রার খুরশিদুর রহমান, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অমল ভূষণ নাগ, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন মোহীত উল আলম, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের মিহির কুমার রায়, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সহকারি ডিন এম মঈনুল হক, স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান সোহেল এম শাকুর, গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইফতেখার মনির, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান টুটন চন্দ্র মল্লিক, কম্পিউটার সাইয়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগর চেয়ারম্যান সাহীদ মো. আসিফ ইকবাল, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাদাত জামান খান, আইন বিভাগের চেয়ারম্যান তানজিনা আলম চৌধুরী, অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ফারজানা ইয়াসমিন চৌধুরী, পাবলিক হেলথ বিভাগের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম, ফ্যাশন ডিজাইন এন্ড টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার দাশ ও ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান কাউছার আলম।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর উপাচার্য অনুপম সেন সমবেতদের উদ্দেশে বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙালিই বিশ্ব-ইতিহাসে প্রথম ভাষার জন্য রক্তদান করে। এর আগে ভাষার জন্য রক্তদানের কোনো ইতিহাস নেই। বাঙালির ভাষার জন্য এই রক্তদান ভাষাকে সর্বমানবের ভাষার অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে বিশ্বের প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপর থেকে এইদিনে বাঙালির সঙ্গে সারা বিশ্বেই দিনটি উদযাপিত হচ্ছে। একারণে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে একটি অনন্য দিন হলেও, এখন বিশ্বের ইতিহাসেও অনন্য ও অসাধারণ দিন।’

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) শহীদ দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, ‘একুশ আমাদের শক্তি, আমাদের গৌরবের চেতনা। ভাষা আন্দোলন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল সূতিকাগার। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যাদের হাতে আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, তাদের নিজেদের মাতৃভাষা ও দেশের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে।’

চুয়েটের শহীদ মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় উপ-উপাচার্য জামাল উদ্দীন আহাম্মদ, পুরকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক সুদীপ কুমার পাল, তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশল অনুষদের ডিন মোহাম্মদ সামসুল আরেফিন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন এ এইচ রাশেদুল হোসেন, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বক্তব্য দেন।

সভার আগে সকালে চুয়েট ক্যাম্পাসের আবাসিক উত্তর গোলচত্বর থেকে প্রভাতফেরি বের হয়।

বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দেন।

ছবি: শ্যামল নন্দী, ফটোকরেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা।

সারাবাংলা/আরডি/ইআ

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন