বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অনন্য ভূমিকা

February 21, 2024 | 2:40 pm

নৃপেন রায়

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রজীবনেই তিনি সম্পৃক্ত হন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে (স্নাতকোত্তর) ভর্তি হন। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস থেকে। ১১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ডাকা ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। ১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনকে সমর্থন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন। যদিও মুচলেকা ও জরিমানা দিয়ে যারা বহিষ্কৃত ছিল তারা ছাত্রত্ব ফিরে পায় কিন্তু শেখ মুজিব তা করেননি। তাই বহিষ্কারাদেশ বহাল থাকে।

বিজ্ঞাপন

সমালোচকরা বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলবন্দি হয়ে ফরিদপুরে ছিলেন। ফলে, এই আন্দোলনে তার অংশ নেয়া সম্ভব ছিল না। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান একুশের ঘটনা স্মরণ করে জেলখানায় বসে লিখেছেন: ‘মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হল মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেফতার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। ’

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এভাবেই একুশের রক্তদান এবং এই রক্তদানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জেলে বসে (১৯৬৬) সেই আন্দোলনের পরিণাম নিয়ে রাজনৈতিক গ্রন্থ রচনাও কম সাহসের কথা নয়।

ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার ধারাবাহিকতা আছে। ১৯৫২-এর আন্দোলনের পর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে এর ২১৪ নং অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাঙালির জন্য বিলম্বে হলেও এটি একটি বিজয়। কিন্তু এতেও তুষ্ট ছিলেন না তিনি। ‘কারাগারের রোজনামচায়’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি (বঙ্গবন্ধু) আর কি দিতে পারি!

বিজ্ঞাপন

আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে। ’

১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলন। সেখানে ভাষা-বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক লিখেছেন, ‘সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ’

কী ছিল সেই প্রস্তাবে? গাজীউল হক বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত প্রস্তাবনা উল্লেখ করে লিখেছেন: ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক। ’ এই দাবি থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। সেই প্রস্তাবই সরকারের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে, ১৯৪৮ সাল। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতি। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য [তখন ‘জাতীয় কংগ্রেস’ নামে রাজনৈতিক দল ছিল; তিনি সেই দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। ] বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। ’

বিজ্ঞাপন

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সংসদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল ধীরেন্দ্রনাথকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ও তার পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দৌহিত্রী আরমা দত্ত লিখেছেন, ‘একদিন দাদু [ধীরেন্দ্রনাথ] আর দিলীপ কাকুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের জীবনে সে এক অমাবস্যার কাল।

[…] পরবর্তীকালে ময়নামতি সেনানিবাসের তৎকালীন বেসামরিক কর্মচারী রমণীমোহন শীলসহ অন্যদের স্মৃতিচারণা থেকে জেনেছি, কী নির্মম নির্যাতন চলেছে তখন দাদুর ওপর। দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাকু দিলীপ দত্তের লাশ আমরা পাইনি। ’ এভাবেই পাকিস্তানিরা তাদের শত্রুকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনও তার একটি। মূলত ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছড়িয়ে পড়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি এবং সে-সূত্রেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে।

তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় এই পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলের এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিতকুমার গুহ প্রমুখ। সভায় পূর্বাপর ঘটনাসমূহ আলোচনা করে গণপরিষদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়।

আন্দোলনের স্বার্থেই গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। গণতান্ত্রিক যুবলীগ, গণআজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাস বা হোস্টেলগুলোর সংসদ ইত্যাদি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুদূরপ্রসারী। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ ঢাকা শহরে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঐ দিন পূর্ববাংলায় সফল হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটাই ছিল প্রথম হরতল। হরতালে বিক্ষোভ দেখানোর সময় সচিবালয়ের প্রথম প্রবেশদ্বারে পিকেটিঙে অংশ নেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ, দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারে অন্যরা। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সূচনা করতে গিয়ে পুলিশ ও শাসক দলের ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতে বহু আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা আহত এবং অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন চরমে ওঠে। ফলে ১৫ই মার্চও হরতাল পালিত হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বিবেচনা করে ঐ দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কমরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে তিনি বাধ্য হন।

বিজ্ঞাপন

এই চুক্তির আটটি শর্ত ছিল। এই চুক্তিপত্র যখন তৈরি হয় তখন শেখ মুজিবুর রহমানসহ ছাত্রনেতারা জেলে। সে কারণে চুক্তিপত্রের খসড়া জেলখানাতে নিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনের অনুমোদন করিয়ে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকে এতোটাই প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন যে, জেলে থাকলেও তাকে না দেখিয়ে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে ছাত্রনেতারা একমত হতেন না। এই চুক্তির কারণেই ১৫ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ১১ই মার্চ তাদের জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে মিছিলসহ তাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বন্দি ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং জেল থেকে মুক্তি পাবার পর দিনই বঙ্গবন্ধু এই বিক্ষোভে সামিল হন। শুধু সামিল নয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সমাবেশে তাকে সভাপতিত্ব করতে হয়। এই সভাপতিত্বের ব্যাপারটি পূর্বনির্ধারিত ছিল না। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় কোনো সভাতে সভাপতিত্বও করেননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ সে সময় বঙ্গবন্ধুর ওপরই নেতৃত্ব প্রদান করে। তাই ১৬ই মার্চ অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সমাবেশ সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি আন্দোলনের জন্য কিছু দিকনির্দেশনাও ঘোষণা দেন। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে গমন এবং সেখানে দাবিনামা উত্থাপন করে আবার ফেরে আসা এই ছিল বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং বঙ্গবন্ধুও কাঁদানে গ্যাসের শিকার হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন ঢাকা থেকে সারা দেশে তখনই ছড়িয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা এই আন্দোলনকে হিন্দু, কমিউনিস্ট ও ভারতের আন্দোলন বলে প্রপাগান্ডা চালায়। তারা বলে, ভারত থেকে হিন্দু ও কমিউনিস্টরা পাকিস্তানে এসে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এই আন্দোলন করছিল।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পাকিস্তানিদের কূটচাল। বাংলা কেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজস্ব ভাবনা ব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। তার বক্তব্য: ‘বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচ ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না। ’ তারপরও বঙ্গবন্ধু বাংলার একক মর্যাদা দাবি করেননি, করেছেন উর্দুর সঙ্গে সমমর্যাদায়।

১৯৪৮ সালের ১৭ই মার্চ পূর্বদিনের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভাতেও ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ ও বক্তব্য প্রদান করেন। তবে এই অভূতপূর্ব ধর্মঘট পালনের জন্য নেতাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতার কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন সমগ্র পূর্ববাংলা বাঙালির আত্মার আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সারা দেশ কেঁপে ওঠে; রাস্তা, দেয়াল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পোস্টারে ছেয়ে যায়। তাতে লেখা থাকে: ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। এই দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যায় এবং এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্রনেতার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বাগ্রে। তার ভূমিকা ও সাহস ছিল স্মরণে রাখার মতো।

১৯শে মার্চ মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেয়া এক ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুসহ চার-পাঁচশ ছাত্র সেই সমাবেশে একত্রে বসেছিলেন। ছাত্ররা ধ্বনি ও হাত তুলে জিন্নাহর এই ঘোষণার বিপক্ষে ‘মানি না’ বলে স্লোগান দেন। এরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সময় জিন্নাহর বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা। ২১শে মার্চের প্রতিবাদ থেকেই ২৪শে মার্চের প্রতিবাদের সাহস সঞ্চয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের ভীত তৈরিতে এভাবেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।

মোহম্মদ আলি জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেয়ার কারণে অনেক বাঙালি ছাত্রনেতা পর্যন্ত দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এখানেই আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। ছাত্রসমাজের এই দ্বিধাকালে দ্ব্যর্থহীনভাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, নেতা অন্যায় করলেও ন্যায়ের স্বার্থে তার প্রতিবাদ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লেখেন: “আজও আমার একটা কথা মনে অছে। আমি বলেছিলাম, ‘কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন, হজরত ওমর (রা.)- কে সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি। ’ সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না। ” ছাত্রসভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর দ্ব্যর্থহীন অবস্থানের কারণে ছাত্রসমাজের দ্বিধা কেটে যায়। ফলে সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়া ছাত্রসংগঠনের অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়ে। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধু সঠিক পথ নির্দেশ করতে পেরেছিলেন বলেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে গণআন্দোলনে রূপলাভ করে। আসলে বলা চলে, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়।

১৯৫১ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হত্যা-পাল্টা হত্যার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন পূর্ববাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি তিনি ঢাকার পল্টন ময়দানে দেয়া বক্তৃতায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। অথচ, তিনিই ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ছাত্রদের সঙ্গে যে আট দফা চুক্তি করেছিলেন, তাতে বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদা প্রদান করা হবে বলে অঙ্গীকার ছিল।

ভাষাসৈনিক গাজিউল হক এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। ’

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারির পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয়। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টন-ঘোষণার পর জেল-হাসপাতালে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন: যে ঢাকায় বসে খাজা নাজিমুদ্দিন ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই উল্টো বললেন। জেল-হাসপাতালে সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলে, তারাসহ বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের আরো নেতা নিয়ে রাত একটায় জেল-হাসপাতালের গোপনীয় স্থানে সভা করেন। এই সভা করাটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, পুলিশ সদস্য আর সাধারণ ডাক্তার-নার্সদের চোখ এড়িয়ে মধ্যরাতের এই সভাটি আহ্বান করা একজন বন্দির জন্য স্বাভাবিককর্ম ছিল না। বঙ্গবন্ধু সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সে রাতের অনানুষ্ঠানিক সভায় যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল সেই পরিকল্পনা অনুসারেই পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ সূচিত হয়েছে। এই সভা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: “বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও (গণতান্ত্রিক যুবলীগ) রাজি হবে।

আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতু নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছে। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস। ’ আরো দুএকজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি [বঙ্গবন্ধু] আরও বললাম, ‘আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। ”

বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনা অনুসারে তার সুপরিচিত কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক মনোনীত করে ৩১শে জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে যে আন্দোলন শুধু ছাত্ররা করে আসছিল তাতে সর্বমহল যুক্ত হয়, এতে রাজনীতিবিদগণ আসার সুযোগ পান। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় পূর্ববাংলা আইনসভার অধিবেশন আহ্বানের দিন অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে এই আন্দোলনের ডাকের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পায় অনেক গুণে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা অনুসারে জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন যে, তাকে বিনাবিচারে আটক রাখা হয়েছে। হয় তাকে মুক্তি দেয়া হবে, তা না হলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনশনের মাধ্যমে দেহত্যাগ করে জেলমুক্ত হবেন। এই গোপন সভার সংবাদ নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে এবং সে কারণেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর জেলে দ্রুত স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা থেকে ফরিদপুরে আসার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি হোটেলে আবার গোপন রাজনৈতিক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের নেতাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘আমরা আস্তে আস্তে খাওয়া-দাওয়া করলাম, আলাপ-আলোচনা করলাম। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললাম। খবরের কাগজে যদি দিতে পারে চেষ্টা করব। বললাম, সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’তো আছেই। আমরা যে আগামীকাল থেকে অনশন শুরু করব, সেকথাও তাদের বললাম, যদিও তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিল। […] তারা আমাকে বলল, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব। ” (রহমান, ২০১২ : ২০০) এভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠিত ও বিভিন্ন স্থানে বিস্তারে বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকার পরও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ফরিদপুর জেলে এসে বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমেদ পূর্বসিদ্ধান্ত অনুসারে অনশন আরম্ভ করেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা শারীরিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু অনশনরত অবস্থায় জেলে বসেই কর্তব্যরত পুলিশদের কাছে সংবাদ পান ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছে, ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গুলি হয়েছে, ছাত্ররা শহিদ হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে ফরিদপুরে মিছিল হয়েছে ইত্যাদি। এই সংবাদ শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে ছাত্র-হত্যার ব্যাপারটি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেফতার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। ’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকলেও তার মন ছিল আন্দোলনে, তার চিন্তা ছিল আন্দোলনকারীদের ঘিরে। অনশন করার কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল বঙ্গবন্ধু এরই মধ্যে প্রত্যয় গ্রহণ করেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে ঘরে ফেরার আর উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে: ‘গুলি হল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেফতার করলেই তো চলত। আমি [বঙ্গবন্ধু] ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। ’ অনশনে বঙ্গবন্ধুর শরীরের এমন অবনতি হয়েছিল যে, ডাক্তারেরা পর্যন্ত আতঙ্কিত হয়েছিলেন। অবশেষে ২৮শে ফেব্রুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে বের হন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অব্যবহতি পরে বঙ্গবন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির সমর্থন আদায় ও তা প্রকাশ-প্রচার করা। ইতঃপূর্বে সোহরাওয়ার্দির নামে মুসলিম লীগ সরকার পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশ করিয়েছে যে, সোহরাওয়ার্দি উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। এ সময় সোহরাওয়ার্দি দীর্ঘদিন করাচিতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাই করাচিতে যান এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সোহরাওয়ার্দি উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে এই বার্তাটি যে বিপুল সংখ্যক বাঙালি সোহরাওয়ার্দিকে অন্ধভাবে সমর্থন করতো তাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়।

বঙ্গবন্ধুর করাচি সফরের কারণে সোহরাওয়ার্দির মত সর্বাংশে বাংলা ও উর্দুর দিকে আসে এবং বাঙালির সংগ্রাম অনুকূল বাতাস পায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু রচিত গ্রন্থে আছে: “আমি [বঙ্গবন্ধু] আর একটা অনুরোধ করলাম, তাকে [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি] লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগান্ডা করছেন তার [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি] বিরুদ্ধে। তিনি [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি] বললেন, ‘নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বাস। ’ তিনি লিখে দিলেন। ” (রহমান, ২০১২ : ২১৬) এই বক্তব্যটি পরে পূর্ববাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠী সেসময় মিথ্যে প্রচার করেছিল যে, বাঙালিরা শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে আন্দোলন করছে। করাচিতেই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মারফত বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে সত্য তুলে ধরেন। এটি যে শাসকদের মিথ্যে প্রচারণা সে কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু। এই সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘খাজা সাহেব ও লাহোরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপিপি’র প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাদের ছিল না। তাদের বলা হয়েছে, শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা। ’ বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফরের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সঠিক গতিপ্রাপ্ত হয়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে চীন দেশে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের ৩০ প্রতিনিধির একজন হিসেবে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেন। পূর্ববাংলা থেকে গিয়েছিলেন পাঁচজন। কিন্তু একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বাংলায় বক্তৃতা করার সাহস দেখান। এতে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়ে এবং এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। কারণ, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশে গিয়ে বাংলার অস্তিত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, কম কথা নয়!

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্ততা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্ততা করলেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্ততা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। ’ বাংলায় বক্ততা দেওয়াটা তার পূর্বপরিকল্পিত বলেই এ ব্যাপারে তিনি আতাউর রহমান খান, তফাজ্জাল হোসেন ও খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সঙ্গে কী বলবেন তা আলাপ করে নিয়েছিলেন।

‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্ততাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্ততা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্ততা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি। ’ এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী পালনের সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকাতেই থাকতেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে প্রভাতফেরি বের করা হয়; কালো পতাকা বহন করা হয়; ঢাকা শহর প্রদক্ষিণও করা হয়। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর্মানিটোলা মাঠে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। এভাবেই একুশের চেতনার ধারাবাহিকতায় আন্দোলনে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে বার বার জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে তিনি জেল থেকেই স্মরণ করেছেন বায়ান্নের বীর শহিদদের এবং ‘কারাগারের রোজনামচায়’ লিখেছেন, ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি তিনি জেলে ছিলেন। তিনি লিখেছেন,‘১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও নেতৃত্বদানের পর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব যদি কারাগারের বাইরে থাকতেন, তা হলে সেদিন (২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে) সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর হতো না বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ’ অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতাদের মধ্যে যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু জেলে না থাকলে তার সঠিক নেতৃত্বে এই বিরোধ সৃষ্টির অবকাশ হতো না বলেই গাজিউল হক মনে করেন।

তবে, এম আর আখতার মুকুলের এই কথাই শেষ অবধি সত্য: ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এর পরবর্তী অধ্যায়ে শুরু হলো বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ আন্দোলন। প্রায় একই সময়ে দ্রুত গড়ে উঠলো স্বায়ত্তশাসন, ৬ দফা ও স্বাধিকরের আন্দোলন এবং চরম পর্যায়ে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সবই একসূত্রে গাঁথা। কিন্তু সর্বত্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় সংগঠিত জাতীয়তাবাদীদের হাতে। ’

সিক্রেটস ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্যা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ভলিউম-২) ২৩০পুষ্ঠায় উল্লেখ আছে, লাহোর ১৫ইজুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মুজিবুর রহমান গত শনিবার সাংবাদিকদের বলেন যে, নিরাপত্তা আইনানুসারে বিভিন্ন বিরোধী দলের প্রায় এক হাজার নেতা ও কর্মীকে আটক করা হইছে। তিনি বলেন যে, আটক বন্দীদের মুক্তি দিয়া ব্যক্তি স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার না করিলে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বিপজ্জনক হইয়া উঠিবে। মুজিবুর রহমান বলেন, সম্প্রতি খুলনায় দুর্ভিক্ষ ২০ হাজার লোক মরিয়াছে। বরিশাল ও অন্যান্য জেলার অধিকাংশ লোক দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হইয়াছে। এখনই প্রতীকারের ব্যবস্থা না করিয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। মি. রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গণ্য করার দাবী জানান। তিনি বলেন, বর্তমানে পূর্ববঙ্গে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ইসলাম ও পাকিস্তানের প্রতি চ্যালেঞ্জেরই ইঙ্গিত। খাদ্যশস্যের মূল্য ক্রমশঃ বাড়িতেছে। অতিরিক্ত কর ভারে জনসাধারণ জর্জরিত। ”

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন