বিজ্ঞাপন

বই কিনেছেন পৌনে ৪ কোটি টাকার, পড়িয়েছেন ১০ হাজার ছেলেমেয়েকে

February 24, 2024 | 10:36 pm

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: দারিদ্র্যের চাপে পড়ে নিজেকে পড়ালেখা ছাড়তে হয়েছে মাত্র ১১ বছর বয়সে। সেই বেদনার কথা ভুলতে পারেননি কখনো। মনে মনে সংকল্প করেন, নিজের সাধ্যমতো সবাইকে পড়ালেখা করানোর সুযোগ করে দেবেন। সেই সংকল্প অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তার সংস্পর্শে আসা কোনো ছেলেমেয়ের পড়ালেখা অর্থাভাবে বন্ধ হতে দেননি। এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। তাদের পাঠ্যবই দিয়েছেন, দিয়েছেন পড়ালেখার খরচ। শুধু শিক্ষার্থী নয়, আশপাশের সব মানুষের জন্য গড়ে তুলেছেন পাঠাগার, যেখানে এখন সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার বই।

বিজ্ঞাপন

তিনি জিয়াউল হক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক পাওয়ার পর এখন সারাদেশেই পরিচিত নাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের ৯০ বছর বয়সী এই দই বিক্রেতা জানালেন, ১৯৬২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬১ বছরের সব খরচের হিসাব তার কাছে সংরক্ষিত। সেই হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকার বই কিনেছেন তিনি! অর্থাৎ গড়ে বছরে ছয় লাখ টাকারও বেশি বই কিনেছেন জিয়াউল। সে হিসাবে প্রতি মাসে বই কিনতেই তার খরচ ৫০ হাজার টাকার বেশি!

ভোলাহাটের মুসরিভূজা গ্রামে জিয়াউলের বাড়িতে বসেই কথা হয় তার সঙ্গে। বললেন, নিজে না খেয়ে হলেও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছেন। স্কুল-মাদরাসা-মসজিদ গড়ে তুলেছেন। আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়েছেন, দিচ্ছেন। আর সবই করেছেন নিজের দই বিক্রির লাভের টাকা থেকেই। আর সে কারণেই তারও অনেক পরে যারা দই বিক্রির পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন, তারাও অনেক বাড়ি-গাড়ি গড়ে তুলতে পারলেও জিয়াউল এখনো বাস করছেন কোনোমতে টিকে থাকা এক ঘরে।

জিয়াউল হকের বাসায় পাঠাগার। ছবি: সারাবাংলা

বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মুশরিভুজা গ্রামের বাসায় গিয়ে পাওয়া গেল জিয়াউলকে। একুশে পদক পাওয়ার পর তার বাড়িতে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। সবার লক্ষ্য মূলত জিয়াউলের সঙ্গে ছবি তোলা। কারও আবদার রাখতেই কার্পণ্য করছিলেন না জিয়াউল। তবে পাঞ্জাবিতে বেশ অস্বস্তিবোধ করছিলেন, সেটি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

বিজ্ঞাপন

জিয়াউলের বাড়িতে ঢুকতেই হাতের বামে একটি কক্ষে পাঠাগার। সেখানে বড় আকারের পড়ার টেবিল, সঙ্গের দুটি আলমারি আর পাঁচটি শোকেসে সাজানো বই। তাকেও অনেক বই।

বাড়িতে ঢুকতেই এগিয়ে আসেন জিয়াউল হক। হাত বাড়িয়ে দেন করমর্দনের জন্য। জানতে চাইলেন, কোথা থেকে আসা হয়েছে। ‘রাজশাহী থেকে’ শুনেই হাসলেন এক গাল। বললেন, ‘রাজশাহী শহরেও ফেরি করে দই বিক্রি করেছি।’ সঙ্গে প্রশ্নও রাখলেন, ‘তা এত দূর থেকে কী মনে করে?’ তার গল্প শুনতে চাই, সাক্ষাৎকার নিতে চাই— বলতেই আরও একবার হেসে দিলেন। বোঝা গেল, গত কদিন ধরেই এরকম অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত কথা বলতে হচ্ছে তাকে।

এভাবে খালি গায়ে কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন জিয়াউল। ছবি: সারাবাংলা

হাত ধরে পাঠাগারের দিকে নিয়ে গেলেন জিয়াউল। কথা বলতে লাগলেন নিজে থেকেই, ‘একুশে পদক পাব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি যে মানুষকে সহযোগিতা করতাম, তার সবচেয়ে বড় পুরষ্কার পেয়েছি। আমার আর কিছু প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিজ হাতে গলায় মেডেল পরিয়ে দিয়েছেন, আমাকে সম্মানিত করেছেন। এর চেয়ে আর বেশি কিছু আশা করা যায় না।’

বিজ্ঞাপন

জিয়াউল হকের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৬ জুন। সে হিসাবে বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। তৈয়ব আলী ও শারিকুন নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। বাবা ছিলেন গোয়ালা। বিক্রি করতেন দুধসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। ছোট থেকেই বাবাকে সহায়তা করতেন। অভাবের সংসারে মাত্র ১১ বছর বয়সে শিক্ষাজীবনে ইতি টানতে হয়েছে তাকে। এরপর তিনিও গোয়ালা হয়ে উঠেন। বিভিন্ন বাড়িতে দুধ দিয়ে বেড়াতেন। হাটে বিক্রি করতেন দইসহ মিষ্টান্ন খাবার। এখনো দই বিক্রি করে চলেছেন তিনি।

সারাবাংলার সঙ্গে আলাপচারিতায় জিয়াউল হক বলেন, ‘দুই আনার জন্য আমার আব্বা আমাকে পড়ালেখা করাননি। তখনকার শিক্ষাব্যবস্থা এত সহজ ছিল না। ১৯৫৫ সালে এক টাকায় পাঁচ কেজি চাল মিলত। ছয়জনের সংসার চালাতে আব্বাকে হিমশিম খেতে হতো। তাই তিনি আমাকে তার সঙ্গে কাজে নিলেন। তিনি আমাকে দুধ দিতেন, আমি দই বানিয়ে হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতাম।’

বাড়িতে যতটুকু সময় থাকেন, বেশির ভাগ সময়ই যায় গোছগাছ করাসহ বইয়ের যত্ন নিতেই। ছবি: সারাবাংলা

ওই পড়ালেখা না করার আক্ষেপ আর আফসোসই জিয়াউলকে ধাবিত করে অন্যদের সহায়তা করতে। প্রান্তিক এলাকায় তার মতো আরও অনেক কিশোর-কিশোরীকেই প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণি থেকে ঝরে পড়তে হতো। তাদের পড়ালেখা এগিয়ে নিতেই নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন জিয়াউল। দই বিক্রির টাকা থেকে সংসার চালানোর জন্য ন্যূনতম কিছু রেখে বাকি পুরোটাই সঞ্চয় করে অন্যদের সহযোগিতা করতে শুরু করেন।

১৯৬২ সালের কথা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করে দই বিক্রি করা জিয়াউল তখন সঞ্চয় করতে শুরু কছেন। কিছু টাকা জমতেই সিদ্ধান্ত নেন, স্কুলের ঝরে পড়া শিশুদের জন্য কিছু করবেন। তিনি বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে জমিজমা কিনব না, বিলাসিতায় গা ভাসাব না। স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া থেকে রক্ষায় কাজ করব। জমানো টাকা দিয়ে পাঠ্যবই কিনে মুশরিভুজা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করতে শুরু করি।’

বিজ্ঞাপন

প্রথমে প্রাথমিক এবং পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদেরও বই কিনে দিতে থাকেন জিয়াউল। তিনি বলেন, ‘সরকার যখন স্কুলের বই বিনামূল্যে দিতে শুরু করল, তখন আমি কলেজের ছেলেমেয়েদের বই দেওয়ার উদ্যোগ নিই। পরে মনে হলো, শুধু পাঠ্যপুস্তক দিলে তো হবে না, মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সব ধরনের বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে। শুধু স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে নয়, সবার জন্য বইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই সমাজকে বিকশিত করতে গল্প, উপন্যাস, কবিতাসহ সব ধরনের বই কিনে পাঠাগার গড়ে তুলতে শুরু করলাম।’

স্ত্রী ফরিদা হকের সঙ্গে জিয়াউল। ছবি: সারাবাংলা

দই বিক্রির টাকা জমিয়ে একসময় সামাজিক বিভিন্ন কাজেও খরচ করতে থাকেন জিয়াউল। তার এ ধরনের উদ্যোগ সমমনা ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠনগুলোকেও অনুপ্রাণিত করে। অনেকে তাকে অনুদান দিতে এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘যেসব অনুদান পেয়েছি তার সবটুকু দিয়ে আমি আমার কার্যক্রম বাড়িয়েছি। প্রায় ১৭ জন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য টিনের বাড়ি কিনে দিয়েছি। ২০টির মতো নলকূপ স্থাপন করেছি। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়েতেও সহযোগিতা করা হয়েছে।’

জিয়াউল জানাচ্ছেনম, মুশরিভুজা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাতটি মাদরাসা ও তিনটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি বছরে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেন। চক্ষু শিবির করে প্রায় ৭২ জনকে বিনামূল্যে ছানি অপারেশন করিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বই পড়ে প্রায় ৪৫০ শিক্ষার্থী এখন দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি করছে। তারা নিয়মিত আমার খোঁজ-খবর রাখে। টাকা দিয়ে সহায়তাও করে। সব টাকাই এ ধরনের কাজে খরচ করা হয়।’

জিয়াউলের নিজের জন্য কোনো সঞ্চয় না থাকার কারণে ব্যক্তিগতভাবে তার কোনো ‘উন্নতি’ও হয়নি। জিয়াউল হক বলেন, ‘শুরুর দিকে এই এলাকায় অল্প কয়েকজন দই বিক্রি করতেন। আমার বিক্রি ছিল বেশি। দূর-দূরান্তে, এমনকি আশেপাশের জেলা ঘুরে দই বিক্রি করতাম। এ কারণে আমি টাকা জমাতে পারতাম। যারা আমার সঙ্গে দই বিক্রি করত, তারা জমি-জায়গা, বাড়ি-গাড়ি সব করেছে। আমি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে গেছি।’

বাঁধাই করা ছবিটি টাঙানো জিয়াউলের ঘরে। ছবি: সারাবাংলা

একুশে পদক থেকে পাওয়া সম্মানির চার লাখ টাকা খরচের খাতও এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছেন জিয়াউল, ‘একুশে পদকসহ চার লাখ টাকা পেয়েছি। এক লাখ টাকা স্কুলে, এক লাখ টাকা দেবো মাদ্রাসায়। এক লাখ টাকা আমার লাইব্রেরির জন্য রেখেছি। বাকিটা এতিম শিশুদের জন্য দেবো।’

ব্যক্তিভাগে অনেক সম্পদের মালিক না হলেও একুশে পদকই তার সব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক বেশি ভারী বলেই মনে করেন জিয়াউল। তিনি বলেন, ‘একুশে পদক পাওয়ার পর থেকে খুব আনন্দ হচ্ছে। এত আনন্দ আমি ধরে রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। অন্যরা কেউ সেভাবে বলতে পারেনি। তিনি আমাকে আমার প্রতিষ্ঠা করা মুশরিভুজা স্কুল অ্যান্ড কলেজ সরকারিকরণ করে দেবেন জানিয়েছেন। এ ছাড়া আমার লাইব্রেরির জন্য তিনি জায়গা দেবেন বলেও আশ্বস্ত করেছেন।’

১৯৫৮ সালে জিয়াউল হক তার চাচাতো বোন সারাবান তহুরাকে বিয়ে করেন। তাদের দুই মেয়ে। একজনের বয়স ৬০ বছর, আরেকজনের ৫৮ বছর। ২০০৩ সালে অসুস্থ হয়ে মারা যান সারাবান তহুরা। এরপর ২০০৪ সালে বিয়ে করেন ফরিদা হককে। তাদের ঘরের সন্তান মহব্বত হক বাঁধন এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। জিয়াউল হক বলেন, ‘সামাজিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবার ছোট রেখেছি। সমাজসেবার দীর্ঘ পথচলায় অনেক স্মৃতি।’

জিয়াউলের ঘরে আলমারি, দেরাজ সবখানে বই। ছবি: সারাবাংলা

এর আগে ২০০৬ সালে ইউনিলিভার বাংলাদেশ ‘সাদা মনের মানুষ’ উপাধী দিয়েছিল জিয়াউলকে। সমাজসেবার স্বীকৃতি হিসেবে এ পর্যন্ত তার ঝুলিতে আছে প্রায় ৪০টি পদক, যা সাজানো তার হাতে প্রতিষ্ঠা করা লাইব্রেরিতে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা হারিয়েও ফেলেছেন।

একুশে পদক নিয়ে উচ্ছ্বাস-উৎসবের পাশাপাশি আক্ষেপ আর ক্ষোভও আছে জিয়াউলের। একুশে পদকের নাম ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত স্থানীয় সংসদ বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকের কাছ থেকে কল বা সহযোগিতা পাননি তিনি।

জিয়াউল বলেন, ‘আমার এলাকারই কিছু মানুষ আমার ওপর ক্ষুব্ধ। তাদের আশঙ্কা, আমি যদি ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকি, তাহলে তারা তাদের বাড়িতে কাজ করার জন্য গৃহকর্মী পাবে না, ফসলের মাঠে শ্রমিক সংকট দেখা দেবে। তারা আমার বাড়ি ও লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বেশ কয়েকবার। স্থানীয়দের চাপের কারণে চামা মুশরিভুজা থেকে বর্তমান মুশরিভুজা বটতলা এলাকায় নিজের বাড়ি ও গ্রন্থাগার স্থানান্তর করতে হয়েছে।’

ভোলাহাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাশেদুল ইসলাম অবশ্য জিয়াউল হকের পাঠাগার স্থায়ী রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার কথাই বললেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জিয়াউল হক পাঠাগার একটি স্থায়ী রূপ পাবে। আমরা বেশ কয়েকটি জায়গা দেখে রেখেছি। পাঠাগারটি বড় আকারেই করতে চাই। জেলা প্রশাসক মহোদয় যা বলবেন তাই করা হবে। আর স্কুলের বিষয়টি দেখবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এগুলো খুব দ্রুতই বাস্তবায়ন করা হবে।’
সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন