বিজ্ঞাপন

সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন: জটিল সমীকরণে আ.লীগ প্যানেল

February 24, 2024 | 4:05 pm

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে গত তিন মেয়াদের মধ্যে সভাপতি পদে তিন বার এবং সম্পাদক পদে দুই বার আওয়ামী লীগপন্থি প্যানেল বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই মেয়াদে সহজেই জয় পেয়েছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের (সাদা প্যানেল) প্রার্থীরা। তবে এবার জটিল সমীকরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আওয়ামী প্যানেলের। বিশেষ করে সভাপতি ও সম্পাদক পদে কঠিন পরীক্ষায় পড়তে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত সভাপতি-সম্পাদক প্রার্থী।

বিজ্ঞাপন

সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে সভাপতি পদে এম কে রহমান প্রার্থী হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ সালের মার্চে সরকার তাকে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়। এরপর ২০১৪ সালের মে মাসে সরকার আবার তাকে অব্যাহতি দেয়।

সাধারণ আইনজীবীদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে এম কে রহমানের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এ কারণে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে সাদা প্যানেলের ভোট ভাগাভাগি হতে পারে। এরফলে তিনি বার নির্বাচনে পাস না করতে পারলেও সাদা প্যানেলের সভাপতি প্রার্থীর বিজয়ী হওয়া অনেক বেশি কঠিন হবে। কারণ সাদা প্যানেলের বিপরীতে নীল প্যানেল থেকে সভাপতি পদে মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি এর আগে সাত বার বার সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন।

এদিকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি এম কে রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছি। আশা করছি প্রার্থিতা বৈধ ঘোষিত হবে। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি এ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। তবে আমি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করব না।

বিজ্ঞাপন

সভাপতি পদে এ কে রহমান ব্যতিত সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরের অপর প্রার্থী হচ্ছেন ইউনুছ আলী আকন্দ। ভোটের মাঠে তার তেমন একটা প্রভাব নেই। তিনি এবার নিয়ে ১৩ বারের মতো সভাপতি পদে নির্বাচন করছেন। প্রতিবারই তিনি বেশ বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, দলীয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরুপ এই নিয়ে ১৩ বারের মতো নির্বাচন করছি। প্রতিবারই জোর করে আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি আমার ভোট গণনা পর্যন্ত করা হয় না। বারের দুর্নীতি-অন্যায়ের প্রতিবাদে আমি নির্বাচন করে যাব।

বার নির্বাচনে সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন, বারের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যুথি। তিনি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ল অ্যালামনাই অ‌্যাসোসিয়েশনের (রুলা) প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উত্তরবঙ্গ আইনজীবী সমিতির সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ প্যানেল থেকে নির্বাচন করে সুপ্রিম কোর্ট বারে কোষাধ্যক্ষ পদেও নির্বাচিত হয়েছেন। আইনজীবী হিসেবে তারও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ কারণে সাদা প্যানেলের সম্পাদকের পক্ষে নীল প্যানেলের প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজলকে পরাজিত করে বিজয়ী হওয়ার সমীকরণ কঠিন হয়ে পড়েছে।

যদি সম্পাদক পদে যুথি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে না নেয়, তাহলে সাদা প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী শাহ মন্জুরুল হককেও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। কারণ নাহিদ সুলতানা যুথি বিজয়ী হতে না পারলেও দুজন একই ঘরানার হওয়ার কারণে সাদা প্যানেলের ভোট ভাগাভাগি হবে। এতে নীল প্যানেলের প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বহুগুণ। আর নীল প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী এর আগেও দুইবার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। এতে কপাল পুড়তে পারে সাদা প্যানেলের সম্পাদক পদ প্রার্থীর।

এদিকে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি নাহিদ সুলতানা যূথি সাংবাদিকদের বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট বারে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দেখতে চাই। যে নির্বাচনে বারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, কোনো আইনশৃংখলা বাহিনীকে আমরা আমাদের এই নির্বাচনে দেখতে চাই না। এই নির্বাচন কমিশন সুন্দর একটা নির্বাচন উপহার দেবে এমনটাই আমরা চাই। তিনি বলেন, আইনজীবীরা ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। আমি সাধারণ আইনজীবীদের একটি কণ্ঠ, তাদেরই একজন বোন আমি। তারা ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করবে, এই প্রত্যাশা করছি। আমি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করব না। আমি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবো এবং নির্বাচনে লড়ে যাবো।

সম্পাদক পদের অপর প্রার্থী হচ্ছেন ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূইয়া। তবে তিনি ভালো আইনজীবী হলেও ভোটের মাঠে তার তেমন একটা প্রভাব নেই বললেই চলে।

বিজ্ঞাপন

বার নির্বাচন নিয়ে সাদা প্যানেলে প্রার্থী শাহ মন্জুরুল হক সারাবাংলাকে বলেন, বার নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে। আর সেই নির্বাচনে সাদা প্যানেল বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে বলে আমি আশা করছি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হলে এই বার হবে ঐক্যমত্যের বার। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আইনজীবীদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। বিশেষ করে তরুণ আইনজীবীদের বসার ব্যবস্থা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণসহ বার ও বেঞ্চের মধ্যে দৃঢ় সেতুবন্ধন গড়ে তোলা হবে।

তবে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথি সম্পাদক পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে না বলে জানিয়েছেন। যুথির এমন অঙ্গীকার করার কারণে ভোটের মাঠে শাহ মঞ্জুরুল হক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কিনা, জানতে চাইলে শাহ মঞ্জুরুল হক কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নির্বাচনে নীল প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুছ কাজল সারাবাংলাকে বলেন, গত দুটি নির্বাচন জোর-জুলুম করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্মান নষ্ট করে বার জবর দখল করে নেওয়া হয়েছে। যদিও এবারও বিতর্কিত ব্যক্তি নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে রয়েছেন। তারপরও আমরা নির্বাচন সাব কমিটির প্রধানের ওপর আস্থা রাখতে চাই- এবার বারের নির্বাচন সুষ্ঠু ভোট হবে বলে প্রত্যাশা রাখছি। তিনি বলেন, সুষ্ঠ ভোট ও নিরপেক্ষ গণনা হলে আমাদের বিজয় নিশ্চিত।

নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন পরিচালনা সাব কমিটির সদস্য মো. আসাদুজ্জামান মনির সারাবাংলাকে বলেন, বার নির্বাচনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণের জন্য এবার আমরা যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করছি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন উপহার দিতে পারব।

নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আরেক সদস্য কামাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা গত দুটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। তবে আশা করছি এবার একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারব।

২০২৪-২৫ মেয়াদে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (বার) নির্বাচনের জন্য গত ১১ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (বার) নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা করেন সমিতির সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল। তপসিলে আগামী ৬ ও ৭ মার্চ ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।

২২ ফেব্রুয়ারি প্রার্থিতা বাছাই হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২০২৫ সেশনে বার নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের (সাদা প্যানেল) সবার প্রার্থিতা বৈধ হয়েছে। একইভাবে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল প্যানেল) থেকেও সবার প্রার্থিতা বৈধ হয়েছে। এই দুই প্যানেলের বাইরে সভাপতি পদে ইউনুছ আলী আকন্দ এবং এম কে রহমানের প্রার্থিতা বৈধ হয়েছে। সম্পাদক পদে সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে নাহিদ সুলতানা যুথি ও ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূইয়ার প্রার্থিতা বৈধ হয়েছে। কোষাধ্যক্ষ পদে সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে সাইফুল ইসলামের প্রার্থিতা বৈধ হয়েছে। এ ছাড়া সদস্য পদে সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে জামিউল হক ফয়সালের প্রার্থিতা বৈধ হয়। তবে জামিউল হক ফয়সাল সারাবাংলাকে বলেন, আমি দলের সিদ্ধান্তে প্রার্থী হয়েছিলাম। এখন দলের সিদ্ধান্তেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেব।

নির্বাচনে সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন, সভাপতি পদে আবু সাঈদ সাগর, সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক, দুজন সহ-সভাপতি পদে রমজান আলী শিকদার ও দেওয়ান মোহাম্মদ আবু ওবায়েদ হোসেন সেতু, কোষাধ্যক্ষ পদে মোহাম্মদ নুরুল হুদা আনসারী, দুটি সহ-সম্পাদক পদে হুমায়ুন কবির ও হুমায়ুন কবির পল্লব। সাতটি সদস্য পদে সৌমিত্র সরদার রনী, মো. খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, রাশেদুল হক খোকন, মাহমুদা আফরোজ, বেলাল হোসেন শাহীন, খালেদ মোশাররফ রিপন, রায়হান রনী।

আর জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল থেকে মনোনীত বিভিন্ন পদের প্রার্থীরা হলেন- সভাপতি পদে এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সম্পাদক পদে মো. রুহুল কুদ্দুস (কাজল), দুজন সহ-সভাপতি পদে মো. হুমায়ুন কবির মঞ্জু ও সরকার তাহমিনা বেগম সন্ধ্যা, কোষাধ্যক্ষ পদে মো. রেজাউল করিম, দুটি সহ-সম্পাদক পদে মাহফুজুর রহমান মিলন ও মো. আব্দুল করিম। সাতটি সদস্য পদে ফাতিমা আক্তার, সৈয়দ ফজলে এলাহি অভি, মো. শফিকুল ইসলাম শফিক, মো. রাসেল আহমেদ, মো. আশিকুজ্জামান নজরুল, মহিউদ্দিন হানিফ ও মো. ইব্রাহিম খলিল।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (বার) সভাপতি, সম্পাদকসহ মোট ১৪টি পদ রয়েছে। ২০২৪-২০২৫ সেশনের নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি। প্রার্থী পরিচিতি ৪ মার্চ। আর ৬ ও ৭ মার্চ ভোট অনুষ্ঠিত হবে।

সারাবাংলা/কেআইএফ/এনইউ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন