বিজ্ঞাপন

প্যাভিলিয়নে ভিড়, স্টল ফাঁকা

February 26, 2024 | 10:06 pm

আসাদ জামান

অমর একুশে বইমেলার ২৬তম দিন বিকেল সাড়ে ৩টা। রমনা কালী মন্দির গেট দিয়ে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রবেশের পর দারুণ এক ভালোলাগা কাজ করল। ধুলা-বালিমুক্ত, ভিড়ের আতিশয্যবর্জিত শোভন ও সুচারু পরিবেশ। ফাগুনের মিষ্টি দুপুরে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন নিয়ে বইমেলায় আসা পাঠক-দর্শনার্থীরা কাঙ্ক্ষিত স্টল-প্যাভিলিয়নের দিকে ছুটছেন। পরিপাটি পোশাক, হাতে প্রিয়জনের হাত, বেড়াল ছানার মতো নরম তুলতুলে পায়ে ছন্দময় গতিতে হেঁটে যাওয়া শিশুদের ঝাঁক— সবকিছু মিলে বইমেলাজুড়ে অপার্থিব সৌন্দর্যের সমাবেশ!

বিজ্ঞাপন

হাতের বামে মোড় নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ডিম্বাকৃতির হাঁটাপথ ধরে উত্তরের দিকে এগোতেই কিংবদন্তির স্টলে ছোট-খাটো জটলা চোখে পড়ল। জটলা পাকানো মানুষগুলোর অধিকাংশই ‘টিনএজার’, সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা। বুঝতে বাকি রইল না, কিংবদন্তির স্টলে হয়তো উপস্থিত কোনো এক ইনফ্লুয়েন্সার। ২০২২ সালে এই প্রকাশনী থেকে এক ইনফ্লুয়েন্সারের বই বেরিয়েছিল। সেবার ভিড় করে টিনএজাররা কিংবদন্তির স্টল থেকে বইটি কিনেছিলেন। বইটির নাম ছিল ‘বাইশের বন্যা’। লিখেছিলেন তরুণ কণ্ঠশিল্পী তাসরিফ খান। মনে হলো আজ তিনি মেলায় এসেছেন।

আরেকটু সামনে এগোতেই প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেল অন্যধারার স্টলে। এখানেও আধিক্য তরুণ-তরুণীদের। জানতে ইচ্ছে হলো, কী আছে অন্যধারায়। পরে জানা গেল, ‘গরিবের হুমায়ূন আহমেদ’খ্যাত তরুণ কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন স্টলে বসেছেন। তাকে ঘিরে তরুণ পাঠক, বিশেষ করে তরুণীদের ভিড়।

আরও পড়ুন- কবীর আলমগীরের বই ‘ফ্যাসিবাদ: সাম্প্রতিক বিবেচনা’

বিজ্ঞাপন

এ দুইটি ঘটনার উল্লেখ এই জন্যই যে সাধারণত স্টলগুলোতে এ রকম ভিড় চোখে পড়ে না। ৬৩৫টি স্টলের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো সবসময় ফাঁকাই থাকে। বইয়ের মান যাই হোক না কেন, পাঠক টানতে হলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে দৃষ্টিনন্দন প্যাভিলিয়ন দিতেই হবে। ‘ভেক না ধরলে ভিখ মেলে না’— এই প্রবাদ বইমেলার ক্ষেত্রে দারুণভাবে সত্য। বইমেলায় ‘প্যাভিলিয়ন সংস্কৃতি’ চালু হওয়ার পর গত একযুগ ধরেই অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দেশের প্রবাদপ্রতীম প্রকাশনা সংস্থাগুলো। প্যাভিলিয়নের চাপে মুক্তধারা, দিব্যপ্রকাশ, খান ব্রাদার্স, আহমেদ পাবিলিকেশন্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এক কোণে পড়ে থাকে।

আবার হঠাৎ প্রকাশনা জগতে এসে ‘ভিখ মাগার জন্য ভেক ধরে’ বসে গেছে ধনিক শ্রেণিরা। আমজনতাও উদভ্রান্তের মতো ছুটছে সে সব প্রকাশনা সংস্থার নান্দনিক প্যাভিলিয়নে। অবশ্য সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম কিছু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনী সংস্থাও বইমেলায় প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ নিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী সারিতে ইত্যাদি, অন্যপ্রকাশ, শব্দশৈলী, কাকলী প্রকাশনী, মিজান পাবলিশার্স, অনুপম, প্রথমা প্রকাশন, ইউপিএল ও জিনিয়াস পাবলিকেশনে বরাবরের মতোই উপচে পড়া ভিড় দেখা গেল। সব বয়সী নারী-পুরুষ বইমেলায় ঢুকেই এক সারিতে থাকা এসব প্যাভিলিয়নে গিয়ে ভিড় করছে। বই কিনুক বা না কিনুক, নেড়ে-চেড়ে বই দেখা, ছবি ও সেলফি তোলা অথবা লেখকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে তারা।

বিজ্ঞাপন

সোমবার বইমেলায় ভিড় ছিল তুলনামূলকভাবে কম। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে দেখা গেল প্রচণ্ড ভিড়। কথার যুবরাজ প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো এরাই প্রকাশ করে থাকে। মৃত্যুর একযুগ পেরিয়ে গেলেও বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদ এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তরুণ পাঠকদের বড় একটি অংশ বইমেলায় এসে হুমায়ূন আহমেদের বই খোঁজেন। আর অবধারিতভাবে এ বইয়ের বেশিরভাগ জোগান দিয়ে থাকে অন্যপ্রকাশ। এবারের বইমেলা তারা নান্দনিক প্যাভিলয়ন দিয়ে পাঠক-দর্শনার্থীর মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে কথা হয় স্মৃতিকণা পালের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন এখনো আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক প্রকাশনী হয়তো হুমায়ূনের বই বের করেছে। কিন্তু অন্যপ্রকাশ আর হুমায়ূন আহমেদ একে অন্যের পরিপূরক। সে কারণেই অন্যপ্রকাশেই আসি। প্যাভিলিয়নটাও সুন্দর করে সাজিয়েছে তারা।’

এই সারির সাত নম্বর প্যাভিলিয়ন প্রথমার। বরাবরের মতো আজও ছিল এ প্রকাশনীতে উপচে পড়া ভিড়। ৩০-৪০ জন বিক্রয়কর্মীসহ কর্মকর্তা ও লেখকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাঠকদের চাহিদা মাফিক বই সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

বইমেলায় জাঁকজমকপূর্ণ প্যাভিলিয়নগুলো ক্রেতা-পাঠকদের বেশি আকৃষ্ট করছে। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

প্যাভিলিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে এক পাঠক চিৎকার করে বলছিলেন, ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন বইয়ের তৃতীয় খণ্ড কি আসছে?’ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য খোদ প্রথমার ম্যানেজার জাকির হোসেন এগিয়ে এলেন। বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘এবারের বইমেলাতেও বইটি আমরা আনতে পারছি না। যে দুই খণ্ড বেরিয়েছে, সেই দুই খণ্ডের চেয়েও ভালো করার লক্ষ্যে তৃতীয় খণ্ড নিয়ে আমরা কাজ করছি। আপনাদের আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

পরে ওই পাঠকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নারায়ণগঞ্জ থেকে বইমেলায় আসা মো. তাহমীদ নামের ওই পাঠক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বইমেলায় সিয়ার-উল মুতাখখিরিন বইয়ের প্রথম দুই খণ্ড নিয়েছিলাম। উনারা বলেছিলেন বইমেলার পরে তৃতীয় খণ্ড আসবে। এলো না। মেলার শুরুতে বলেছিল, মেলার শেষে আসবে। এখন আবার বলছে আসবে না। ইতিহাসের একজন পাঠক হিসেবে হতাশা নিয়েই ফিরতে হচ্ছে।’

আরও পড়ুন- দেশ-বিদেশের খাবারের গল্প ‘আনাগোনা খানাপিনা’

এই বই কি অন্য কোথায়ও নেই?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গোলাম হোসেন তবাতবায়ী রচিত এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত এই বইগুলো আগে দিব্যপ্রকাশ বের করত। এখন এই বইয়ের স্বত্ব কিনে নিয়েছে প্রথমা। সে কারণে অন্য কেউ বের করতে পারে না। তাই বইগুলোর জন্য প্রথমাতেই আসতে হয়।’

প্যাভিলিয়নে যখন বই না পেয়ে হাহাকার নিয়ে ফিরে যাচ্ছে পাঠক, ঠিক তখন পাঠক ও দর্শনার্থীদের জন্য হাহাকার করছে স্টলগুলো। সেখানে পাঠক-দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। বইমেলার ৩৭টি প্যাভিলিয়নে যে পরিমাণ পাঠক-দর্শনার্থী, ৬৩৫টি স্টল মিলেও সে পরিমাণ পাঠক-দর্শনার্থীর দেখা মেলে না!

বিকেল পৌনে ৫ টায় খান ব্রাদার্সের স্টলে গিয়ে দেখা যায় তিন-চারজন কৌতূহলী পাঠক বই নেড়েচেড়ে দেখছেন। তিন ইউনিটের স্টলের ভেতরে প্রকাশক কে এম ফিরোজ খানসহ অন্তত পাঁচজন বিক্রয়কর্মী অলস সময় পার করছেন। অথচ সৃজনশীল ও মননশীল বইয়ের জন্য ঐতিহ্যবাহী এ প্রকাশনাটি বাংলাদেশের প্রকশানা শিল্পের অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান। এক সময় আহমদ ছফার সব বই এরাই প্রকাশ করত। তাছাড়া একাডেমিক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এদের ধারের কাছে কেউ ছিল না।

শেষ হয়ে আসছে বইমেলা, পাঠক-ক্রেতারা ছুটে আসছেন বই কিনতে। ছবি: হাবিবুর রহমান/ সারাবাংলা

খান ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী কে এম ফিরোজ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্যাভিলিয়ন সংস্কৃতি তুলে দিয়ে বইমেলায় সবার জন্য সমতা ফেরানোর প্রস্তাব অনেক আগেই দিয়েছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! প্যাভিলিয়ন নিলেই ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। ওই টাকাটা ভালো বই প্রকাশের জন্য বিনিয়োগ করলে পাঠক-লেখক উভয়ে-ই উপকৃত হতো।’

‘এটা তো আর বইমেলা না। এটা এখন বইয়ের বাজার। সারাবছর থাকি নীলক্ষেত। এক মাসের জন্য এখানে আসি। পাঠকদের মনোজগৎটাও ওভাবে তৈরি হচ্ছে। বই কেনার জন্য মান দেখছে না। প্যাভিলিয়নের চাকচিক্য দেখছে,’— বলেন ফিরোজ খান।

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন