বিজ্ঞাপন

বন্ধ্যাত্বের দায় নারীর একার নয়

February 27, 2024 | 2:55 pm

ফিচার ডেস্ক

আজ সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্ধ্যাত্ব দিবস। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার হিসেবমতে পৃথিবীজুড়ে এই মূহুর্তে ৮ থেকে ১২ শতাংশ দম্পতি বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছেন। অনেকেই মনে করেন, বন্ধ্যাত্বের জন্য একমাত্র নারী সঙ্গীই দায়ী। বিশেষত বাংলাদেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা ধারণা, বাচ্চা না হওয়ার জন্য স্ত্রী-ই দায়ী। কিন্তু এ কথা কোনোভাবেই সত্য নয়। বন্ধ্যাত্বের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, বাচ্চা না হওয়ার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ই দায়ী হতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বন্ধ্যাত্বের এক-তৃতীয়াংশ ঘটনায় নারী দায়ী, এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে পুরুষ দায়ী এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশের জন্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের আলাদা করে সমস্যা থাকতে পারে, আবার দু’জনের একসঙ্গেও সমস্যা থাকতে পারে।
কখন বন্ধ্যাত্ব বলব?

স্বামী ও স্ত্রী কোনো ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ ছাড়াই একবছর শারীরিক সম্পর্কের পরও যদি গর্ভধারণ না করেন, তবে তাকে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। আবার গর্ভধারনের পর বারবার গর্ভপাত অথবা একের অধিক মৃত সন্তান প্রসব করলেও তাকে বন্ধ্যাত্ব হিসেবে ধরা হয়।

দীর্ঘদিন ধরে বাচ্চা হচ্ছে না— এমন অনেক রোগীই চিকিৎসকের কাছে যান। এদের মধ্যে অনেকেরই দেখা যায় স্বামী ও স্ত্রী আলাদা শহরে থাকেন। ফলে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন পর পর শারীরিক সম্পর্ক ঘটে। আবার অনেক নারীই আছেন, যারা কিছুদিন জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান, আবার ছেড়ে দিয়ে গর্ভধারণের চেষ্টা করেন। এই দুই ক্ষেত্রেই গর্ভধারণ না করতে পারলে তাকে বন্ধ্যাত্ব বলা যাবে না। কেবল টানা একবছর জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ ছাড়াই শারীরিক সম্পর্কের পরও বাচ্চা না হলে তাকে বন্ধ্যাত্ব হিসেবে ধরা হয়।

বিজ্ঞাপন

সাধারণত বন্ধ্যাত্ব দুই ধরনের— প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি। ওপরে যে ঘটনাগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো প্রাইমারি বন্ধ্যাত্বের মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে, সন্তান আছে— এমন দম্পতির পরে গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিলে সেটাকে সেকেন্ডারি বন্ধ্যাত্ব বলে।

বন্ধ্যাত্বের কারণ

পুরুষদের ক্ষেত্রে

বিজ্ঞাপন

১. বীর্য ও শুক্রাণু

২. Oligospermia বা শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া

৩. Asthenozoospermia বা শুক্রাণুর গতিশীলতা কমে যাওয়া

৪. Azoospermia বা শুক্রাণু না থাকা

বিজ্ঞাপন

৫. Abnormal morphology of sperm বা শুক্রাণুর অস্বাভাবিক আকার আকৃতি, যার ফলে এদের সহজে চলাচল বাঁধাপ্রাপ্ত হয় ও ডিম্বানুর সঙ্গে নিষেক ঘটে না।

৬. শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যাওয়ার ও শুক্রাণুর মোটিলিটি বা গতিশীলতা কমে যাওয়ার কারণ

৭. Ejaculation Disorder বা বীর্যপাতের সমস্যা। এক্ষেত্রে Retrograde ejeculation বা প্রতিবিম্বিত বীর্যপাতের সমস্যা ও Premature ejaculation বা অকাল বীর্যপাতের সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রতিবিম্বিত বীর্যপাতের ক্ষেত্রে urinary bladder neck অর্থাৎ মূত্রথলির সঙ্গে মূত্রনালীর সংযোগ পেশী ঢিলা হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বীর্য অনেকসময় মূত্রথলি দিয়ে বের হতে পারে।

৮. Hypospadias (হাইপোস্প্যাডিয়াস)-এর ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ দিয়ে বীর্য বের না হয়ে ভেতরেই থেকে যায়।

৯. Testicular infection অর্থাৎ টেস্টিকুলারের সংক্রমণ হলে শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যেতে পারে। বয়ঃসন্ধির পর মাম্পস সংক্রমণ হলে টেস্টিকিউলার প্রদাহের কারণে এমনটা হতে পারে।

৯. যেকোনো ধরনের ট্রমা, আঘাত বা সংক্রমণের কারণে Blockage of Vas deferens দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে এপিডিমিস নামক লম্বা পেঁচানো নালীতে সংক্রমণের কারণে শুক্রাণুকে ভাস ডিফারেন্স নামক নালীতে প্রবেশে বাধা তৈরি হয়। এই এপিডিমিসেই শুক্রাণু জমা হয়ে পরে টেস্টিসে পৌঁছে। আর ভাস ডিফারেন্স শুক্রাণুকে টেস্টিস থেকে পুরুষাঙ্গে পৌঁছে দেয়। তাই এই নালীতে কোনো ধরনের বাধা দেখা দিলেও পুরুষের বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।

১০. Undescended testis বা অনার্বিভূত অণ্ডকোষের সমস্যায় পুরুষাঙ্গের নিচের থলিতে অণ্ডকোষ এসে পৌঁছায় না। অণ্ডকোষ হচ্ছে পুরুষ প্রজনন অঙ্গ যেখানে স্পার্ম বা শুক্রাণু তৈরি হয়। এই শুক্রাণুর সঙ্গে মেয়েদের ডিম্বাণুর মিলনের ফলে সন্তানের জন্ম হয়। এর সংখ্যা দু’টি, যা পেটের ভেতর তৈরি হয়। অণ্ডকোষ দুইটি ছেলে শিশুর মায়ের পেটে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নিচের দিকে নামতে থাকে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই অণ্ডকোষ (স্ক্রোটাম) থলিতে অবস্থান নেয়। কোনো কারণে এই থলিতে এসে অণ্ডকোষ না পৌঁছালে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।

১১. Varicocele বা শুক্রনালীর শিরায় টিউমার, অণ্ডকোষ ফুলে গেলে বা শুক্রাশয়ের আকার ছোট হলে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এ তো গেল পুরুষের বন্ধ্যাত্বের কিছু কারণ। চলুন দেখে নেওয়া যাক এছাড়াও আরও যেসব কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।

১. বংশানুক্রমে: যেমন Klinefelter’s syndrome-এ আক্রান্ত ব্যক্তির কোষে একটি অতিরিক্ত X ক্রোমোসোমের জন্য এর উৎপত্তি ঘটে। ক্লাইনফেল্টার’স সিনড্রোমের আক্রান্ত ভুক্তভোগীর জেনোটাইপ XY-এর পরিবর্তে XXY হয় এবং ক্রোমোসোম সংখ্যা ৪৪+XY= ৪৬-এর পরিবর্তে হয় ৪৪+XXY= ৪৭ হয়। এদের লিঙ্গোত্থান ও বীর্যপাত ঘটলেও এদের শুক্রানু উৎপন্ন হয় না। ফলে বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়।
আবার ক্লাইনফেল্টার’স সিনড্রোমের কারণে এদের অণ্ডকোষ অস্বাভাবিকভাবে ছোট হয় ও টেস্টস্টেরন নামক পুরুষ হরমোন কম থাকে। কাজেই শুক্রাণুর পরিমাণ কম বা একেবারে নাও থাকতে পারে।

২. ধূমপান: ধূমপায়ীদের বন্ধ্যাত্বের সমস্যা অধূমপায়ীদের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি।

৩. অতিরিক্ত মদ্যপান

৪. অ্যানাবোলিক স্টেরয়েড ও কেমোথেরাপির কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে

৫. রেডিওথেরাপি

৬. হাইপ্রেশার, ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা, যৌন বাহিত রোগের জন্য বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে

৭. মাদক যেমন হেরোইন গ্রহণের অভ্যাস থাকলেও বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে

৮. মানসিক চাপ বা অবসাদে ভুগলেও যৌন কার্যক্রম কমে যায়। এমনকি শুক্রাণুর উৎপাদনও কমে যায়

৯. ৪০ বছর বয়সের পর পুরুষের ফার্টিলিটি বা প্রজননক্ষমতা কমে যায়

১০. হরমোনঘটিত সমস্যা যেমন— Hypogonadism-এ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ টেস্টস্টেরন হরমোন বা বীর্য উৎপন্ন হয় না। অনেকের জন্মের থেকেই এই সমস্যা থাকে আবার পরেও কোনো আঘাত বা সংক্রমণ থেকে এমনটা ঘটতে পারে।

মেয়েদের বন্ধ্যাত্বের নানা কারণ-

১. অনিয়মিত পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব অথবা একদম পিরিয়ড না হওয়া।

২. PCOS (পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম) থাকলে সন্তান ধারণে সমস্যা দেখে দেয়। বন্ধ্যাত্বের সমস্যা নিয়ে যত নারী রোগী চিকিৎসকের কাছে আসেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী যে সমস্যা নিয়ে আসেন, সেটা হল PCOS। এটি নারীর শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা জনিত রোগ।

৩. জরায়ুর টিউমার (endometrial & sub mucosal fibroid) দেখা দিলে নারীর গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৪. জরায়ু এবং জরায়ুমুখে পলিপ (Polyp) বা মাংস পিন্ড বেড়ে গেলে (endometrial or cervical polyp)।

৫. ডিম্বনালী বা Fallopian Tube যদি কোন কারণে block হয়ে যায়।

৬. Endometriosis, adenomyosis নামের জরায়ুর রোগ হলে। এছাড়া, ডিম্বাশয়ে Chocolate Cyst হলে।

৭. Premature Ovarian Insufficiency/Early Menopause. বয়স ৪০ হবার আগেই যদি মাসিক বন্ধ হয়ে যায়।

৮. থাইরয়েডের সমস্যাতেও বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। অনিয়মিত মাসিক এবং ইনফার্টিলিটির প্রধান দুই কারণের মধ্যে একটি পিসিওএস এবং অন্যটি Hypothyroidism. বন্ধ্যাত্বের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের অনেকেরই হাইপোথাইরয়েডিজম (Hyperthyroidism) থাকে।

৯. আরও কিছু হরমোনজনিত কারণের মধ্যে রয়েছে, Prolactin এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া।

১০. অন্যান্য: মেয়েদের আরও কিছু ফ্যাক্টর আছে যার কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন