বিজ্ঞাপন

৩ মার্চ, ১৯৭১: স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ

March 3, 2024 | 11:03 am

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। রাজধানীর পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ ঘোষণা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

বিজ্ঞাপন

সেদিনের সেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন।

ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন।

সেদিন স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ গ্রহণ করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার শীর্ষ নেতা। যারা পরবর্তী সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘চার খলিফা’ হিসেবে পরিচিতি পান।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার ইশতেহারে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এর তিনটি লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়। লক্ষ্য তিনটি হল— বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ, বৈষম্যের নিরসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’গানটি প্রস্তাব করা হয়।

এ সভা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আহ্বান জানান। অসহযোগের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু সেদিন নির্দেশ দেন, তিনি যদি নাও থাকেন, আন্দোলন যেন না থামে। সেদিন হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলি ও বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক মানুষের প্রাণ যায়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর এবং সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়। পরদিনের ইত্তেফাকের খবর অনুযায়ী, হরতালে চট্টগ্রামেই নিহত হন ৭৫ জন।

বিজ্ঞাপন

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ ঢাকায় নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়, এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন হবে।

বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই আমন্ত্রণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখান করেন। তবে জুলফিকার আলী ভুট্টো তা গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব।’

বঙ্গবন্ধু সেদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে যান। জীবন রক্ষার জন্য জনগণকে ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের আহ্বান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলার স্বাধিকারবিরোধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে।

বিজ্ঞাপন

সেদিনের নায়কেরা এখন কে কোথায়?

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই চার খলিফার তিনজন এরই মধ্যে পরলোকগত হয়েছেন। আরেকজন আওয়ামী লীগ তথা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটে সক্রিয় আছেন।

আবদুল কুদ্দুস মাখন

আবদুল কুদ্দুস মাখন (জুলাই ১, ১৯৪৭ – ফেব্রুয়ারি ১০, ১৯৯৪) ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য ছাত্রনেতা এবং রাজনীতিক। সত্তরের দশকের শুরুতে দেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের অধীনে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। আবদুল কুদ্দুস মাখন ১৯৭৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

শাহজাহান সিরাজ

শাহজাহান সিরাজ (১ মার্চ ১৯৪৩ – ১৪ জুলাই ২০২০) মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম ছাত্রনেতা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন, যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শাহজাহান সিরাজ। পরবর্তীতে জাসদে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

জাসদের মনোনয়নে টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শাহজাহান সিরাজ ১৯৯৫ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বিএনপির মনোনয়নেও একবার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শাহজাহান সিরাজ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের ১৪ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শাহজাহান সিরাজ আমৃত্যু বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

নূর এ আলম সিদ্দিকী

নূর এ আলম সিদ্দিকী ৬ দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল স্বাধীকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০-১৯৭২ মেয়াদে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন যশোর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১২ জুন, ১৯৯৬ সালের সপ্তম এবং ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি ঝিনাইদহ-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ওয়ান ইলেভেনের পর তিনি আর রাজনীতি সক্রিয় হননি। ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যান নূর এ আলম সিদ্দিকী।

আ.স.ম আব্দুর রব

বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার মধ্যে কেবল আ.স.ম আব্দুর রবই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও সক্রিয় আছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)-এর সভাপতি। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক। ডাকসুর ভিপি থাকা অবস্থায় আ স ম আবদুর রব ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত সেই পতাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। আ স ম আব্দুর রব ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তিনি পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির জনক’ উপাধি প্রদান করেন।

১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আ.স.ম. আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজের উদ্যোগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয়। ২৩ ডিসেম্বর দলের প্রথম জাতীয় সম্মেলনে মেজর জলিল সভাপতি, আ.স.ম. আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক, শাজাহান সিরাজ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, হাসানুল হক ইনু সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

আ স ম আব্দুর রব ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ নির্বাচনের পর জাসদ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে আ স ম আব্দুর রব মন্ত্রী হন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হলে সেখানে আ স ম আব্দুর রব অন্যতম নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী বিরোধী জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’-এর অন্যতম নেতা। এ জোটটি বিএনপির সঙ্গে সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে আছে।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও উন্মুক্ত বিশ্বকোষ 

সারাবাংলা/এজেড/ইআ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন