বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গাদের ঘিরেই জমজমাট উখিয়া-টেকনাফের স্বর্ণবাজার

May 25, 2018 | 10:26 am

।। জান্নাতুল ফেরদৌসী ও জাকিয়া আহমেদ ।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার থেকে: পঞ্চাশোর্ধ রোহিঙ্গা শরণার্থী দিলারা বেগমের হাতে একজোড়া কানের দুল। এসেছেন কুতুপালাং বখতিয়ার মার্কেটের শাহজালাল স্বর্ণের দোকানে দুলজোড়া বিক্রি করতে। দোকানের কর্মচারী মোহাম্মদ আলমের সামনে রাখা দুই আনার কানের দুলের মানি রিসিটে দেখা যায়, দাম লেখা রয়েছে আট হাজার এক টাকা।

দিলারা বেগমের সঙ্গে কথা বলার সময়েই সেখানে উপস্থিত হন দোকান মালিক অজিত কুমার ধর।

অজিত কুমার জানালেন, গত একমাস আগে এই জুলেয়ারি দোকানটি দিয়েছেন তিনি। তার দোকানের কর্মচারী আলমও রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। আলম রোহিঙ্গা ক্রেতা–বিক্রেতাদের  সঙ্গে ভাষাসহ অন্যান্য যোগাযোগের কাজটি করে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

কেবল দিলারা বেগমই নন, এখানকার বাকি স্বর্ণের দোকানগুলোতে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের ভিড় চোখে পড়ে।

কুতুপালং এর এই বখতিয়ার মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, দোকানগুলোতে রোহিঙ্গা নারী পুরুষের ভিড়। এখানকার প্রায় প্রতিটি দোকানই নতুন। কোনটা  গড়ে উঠেছে একমাস আগে কোনটা আবার ছয় মাসে আগের।

বিজ্ঞাপন

এই বাজারের আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী অজিত ধর জানালেন, প্রতিদিন তার দোকানে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। ক্রেতাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা শিবিরের মানুষ বলেও জানান তিনি।

তবে শুধু উখিয়ার কুতুপালং না, স্বর্ণ ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে বালুখালি, থ্যাংখালি, পালংখালি, মধুরছড়া, লাম্বাশিয়া, জামতলী ও ময়নার ঘোণাসহ ক্যাম্পভিত্তিক অনেক বাজারে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের আনা স্বর্ণকে পুঁজি করেই কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকাতে ব্যবসায়ীরা রাতারাতি খুলে বসেছেন শতাধিক জুয়েলারি দোকান।

এ বিষয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, এক বছর আগেও এখানে স্বর্ণের দোকান ছিল তিন থেকে পাঁচটি। আর এসব দোকানে বেচাকেনাও  ছিল খুবই কম। কিন্তু গত আগস্টে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আসার পর হুট করেই অসংখ্য স্বর্ণের দোকান দেখে আমরা নিজেরাই রীতিমতো অবাক হয়েছি।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার শাখার বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির নিবন্ধন ছাড়াই গড়ে ওঠা এসব দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দফায় দফায় ডাকা বৈঠকও কোন সুরাহা হয়নি বলেও জানান বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি কক্সবাজার শাখার একাধিক ব্যবসায়ী নেতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, রোহিঙ্গারা আসার সময়ে সঙ্গে করে প্রচুর গয়না নিয়ে এসেছে। স্বর্ণের গয়নাই তাদের মূল পুঁজি। সেসময়েই তাদের কাছ থেকে গয়না কিনে নেয় আগে থেকে উখিয়াতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা এবং কিছু স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ী। এভাবেই পুরনো রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নতুন রোহিঙ্গাদের যোগসূত্র হলেও এখন নতুন আসা এই রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ এই মার্কেটে ব্যবসা করছে । এছাড়া  বিভিন্ন দোকানে কর্মচারী হিসেবেও নিয়োগ পেয়েছে তারা। রোহিঙ্গা কারিগরদের দিয়েই মিয়ানমারের ট্রাডিশনাল ডিজাইনে তৈরি করা হচ্ছে কানের দুল, আংটিসহ অন্যান্য গয়না।

তারা জানান, এখানকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের যোগাযোগ রয়েছে। তারা সেখান থেকে স্বর্ণ এনে হাতে হাতে বিক্রি করছে-তাতে করে দামটাও পাওয়া যাচ্ছে কম। তাই এখনই যদি স্থানীয় অসাধু এবং রোহিঙ্গাদের যোগসাজোসে গড়ে ওঠা এই স্বর্ণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে তা আরও নিয়ন্ত্রণহীন ও খারাপের দিকে যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বর্ণ ব্যবসায়ী কমল ধর জানান, তাদের ট্রেড লাইসেন্স আছে। তবে এখনও ট্যাক্স, ইউনিয়ন পরিষেদ বা পরিবেশের ছাড়পত্র পাননি-বিষয়গুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তাহলে কিভাবে ব্যবসা করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব শিগগিরই অনুমতি নেওয়া হবে।

উখিয়া উপজেলা জুলেয়ারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশীষ ধর সারাবাংলাকে জানান, গত ছয় মাসে তাদের নিবন্ধনের তালিকায় এসেছে ৭০ থেকে ৮০ টি। এছাড়া আরও কিছু ব্যবসায়ী এখনও নিবন্ধন তালিকায় যোগ হননি।

তিনি জানান, এসব দোকানের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ জন ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা। এমনকী, হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানের বেশিরভাগ কর্মচারী-কারিগর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মুসলিমরা। বহিরাগতদের চাকরি না দিতে  দোকানদারদের সতর্ক করলেও সেটি তারা মানছেন না বলেন আশীষ ধর। তবে ব্যবসায়ে শৃঙ্খলা আনতে ইতোমধ্যে কর বিভাগ থেকে শুরু করে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়াপত্র নিতে ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারি পরিচালক সাইফুল আশরাফ সারাবাংলাকে জানান, এখন পর্যন্ত স্বর্ণ ব্যবসায়ীও তাদের কাছ থেকে কোন ছাড়পত্র নেননি। দোকানগুলোতে ক্ষতিকর নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিডের ব্যবহারের বিষয়ে তাদের অনুমতি পায়নি কেউই। লোকবলের অভাবে এসব বিষয়ে নজরদারি করা সম্ভব হয়না জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করা উচিত।

কক্সবাজারের স্বর্ণ ব্যবসা এখনি নজরদারিতে না আনলে ভবিষ্যতে নানা ধরনের অপরাধ বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে জুয়েলারি সমিতির নেতারা  বলেন, বড় কোন অঘটনের দায় আমরা নেবো না। মিয়ানমার থেকে আসা এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশ আমাদের ব্যবসাতে ঢুকে পরেছে। এতে নানা ধরনের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ আশা করেন তারা।

তবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা সারাবাংলাকে বলেন, এসব বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। ক্যাম্প কিংবা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে যেন কোনও অরাজকতা তৈরি না হয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ না হয় সেজন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। কাজের প্রয়োজনে তারা ক্যাম্পের বাইরে এলেও ১১ টি চেকপোস্ট অতিক্রম করার সুযোগ তাদের নেই। স্বর্ণ ব্যবসা নিয়ে এখনও বড় কোনও অভিযোগ আমরা পাইনি।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন