বিজ্ঞাপন

জিম্মি জাহাজে ৫৫ হাজার টন কয়লায় ‘অগ্নিঝুঁকি’

March 13, 2024 | 3:08 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজটিতে প্রায় ৫৫ হাজার মেট্রিকটন কয়লা আছে। এ কারণে জাহাজটি অগ্নিঝুঁকির মধ্যে আছে বলে মালিকপক্ষের কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় জানিয়েছেন চীফ অফিসার আতকুল্লাহ খান। ওই বার্তায় তিনি আরও জানান, জাহাজে ২০ থেকে ২৫ দিনের খাবার মজুত আছে। বিশুদ্ধ পানি আছে ২০০ টন।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) রাতে জাহাজের মালিপক্ষ কবির স্টিল রি-রোলিং মিলসের (কেএসআরএম) কর্মকর্তাদের কাছে জিম্মি নাবিক আতিকুল্লাহ খান এ বার্তা পাঠিয়েছেন।

অডিও বার্তায় আতিকুল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের একটা প্রবলেম হচ্ছে আমাদের জাহাজে কোল কার্গো আছে অ্যাবাউট ৫৫ হাজার (টন), যা ডেঞ্জারাস কার্গো। ওটার ফায়ার হ্যাজার্ড (অগ্নিঝুঁকি) আছে। তারপরে মিথেন কনসেনট্রেনশনও বাড়ে। লাস্ট আমি দেখেছি, অক্সিজেন লেভেল ৯-১০ পারসেন্ট এরকম ছিল। এটা একটু রেগুলার মনিটর করতে হয়। আবার ইনক্রিস হলে বিভিন্ন এক্সপার্টের পরামর্শ নিতে হবে। এটার ব্যবস্থা করতে হবে কাইন্ডলি।’

জাহাজে মজুত রসদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের জাহাজে অ্যাপ্রক্সিমেটলি ২০-২৫ দিনের প্রভিশন আছে। ২০০ মেট্রিকটন ফ্রেশ ওয়াটার। আমরা সবাইকে বলেছি, ফ্রেশ ওয়াটার একটু সেফলি ইউজ করতে। প্রভিশনও আমরা ওভাবে হ্যান্ডল করবো আর কি।’

বিজ্ঞাপন

জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার বর্ণনা দিয়ে অডিবার্তায় আতিকুল্লাহ বলেন, ‘আমি চীফ অফিসার বলছি, আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে। আজকে (মঙ্গলবার) সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টা এবং জিএমটি (গ্রীনিচি মান সময়) সময় ৭টা ৩০ এর সময় একটা হাইস্পিড স্পিড বোট আমাদের দিকে আসতেছিল। সাথে সাথে অ্যালার্ম দিছিল। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ওখান থেকে পরে সিটি টেলে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ডার অফিসার ব্রিজে ছিল।’

‘তখন ওই জিগজ্যাগ করলাম। এসওএস (বিপদে পড়লে জীবন রক্ষায় জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকেএমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস) ট্রাই করছিলাম। বাট ইউকেএমটিও তখন ফোন রিসিভ করেনি। ওরা চলে আসল, পাইরেটসগুলা। চলে আসার পরে ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ড অফিসারকে ক্যাপচার করল। আমাদেরকে ডাকল। আমরা সবাই আসলাম। ওরা কিছু কিছু গোলাগুলি করল। আমরা সবাই ভয় পাইছিলাম। সবাই ব্রিজে বসেছিল। এমনি কারো গায়ে হাত তোলেনি। সেকেন্ড অফিসারকে হালকা একটু ইয়ে করছে।’

তিনি বলেন, ‘তারপরে ওরা আরেকটা স্পিডবোট করে আরো কয়েকজন লোক চলে আসল। এভাবে প্রায় ১৫-২০ জন চলে আসছে। কতক্ষণ পর একটা বড় ফিশিং ভেসেল (মাছ ধরার নৌযান) আসল। ওটা হচ্ছে একটা ইরানিয়ান ফিশিং বোট, যেটা নাকি ওরা এক মাস আগে ক্যাপচার করছিল এই সোমালি পাইরেটসগুলা। ওরা ওইটাতে ছিল। ওইটাতে ঘুরে ওরা এক মাস ধরে সার্চিং করতেছিল। কোনো জাহাজ খুঁজতেছিল। তো আনফরচুনেটলি আমাদের জাহাজে ওরা আসল।

বিজ্ঞাপন

‘এখন ওই ইরানিয়ান ফিশিং বোটকে ওরা রিলিজ করে দিবে। ওই ফিশিং বোটে ফুয়েল শেষ হয়ে গেছে। আমাদের থেকে ওরা ডিজেল নিচ্ছে। ওয়েলডেন পাম্প দিয়ে দিচ্ছি আরকি। কারণ ওদের কোনো সিস্টেম নেই নেওয়ার। তো তারপর ওরা জাহাজ স্টপ করাল। সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার আর থার্ড ইঞ্জিনিয়ার ইঞ্জিন রুমে গেল। গিয়ে সিস্টেমেটিক্যালি স্টপ করছে।’

তবে জাহাজ এবং নাবিকেরা অক্ষত আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি এখনো আল্লাহর রহমতে হয়নি। আমাদেরও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বাট ভয়ে আছে আর কি, সবাই একটু ভয় পাচ্ছে। ভয় দেখাচ্ছে।’

অডিবার্তার শেষপর্যায়ে আতিকুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন স্যার। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন স্যার। ওদেরকে একটু সান্ত্বনা জানাবেন স্যার।’

সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ায় তথ্য পায় মালিকপক্ষ। জাহাজসহ ২৩ নাবিক এখন জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে জিম্মি অবস্থায় আছে।

বিজ্ঞাপন

এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ মেহেরুল করিমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে জাহাজটি সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাইয়ে যাচ্ছিল। জাহাজে থাকা নাবিকরা হোয়াটস অ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে জলদস্যু আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানান।

যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকে এমটিও) তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে বাংলাদেশি জাহাজটি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। দুটি নৌযানে (একটি বড় এবং আরেকটি ছোট) চড়ে জাহাজটির কাছাকাছি এসে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চীফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চীফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্ম শ্মসুদ্দিন, মো . আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।

কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। তখন তারা সবাই সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছিলেন। এরপর জলদস্যুরা নাবিকদের মোবাইল কেড়ে নেয়ায় আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থান প্রসঙ্গে বুধবার (১৩ মার্চ) সকালে নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন জানান, জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা জাহাজটিকে সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেটি সকাল পর্যন্ত উপকূল থেকে ২৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। পৌঁছাতে আরও ৩৬ ঘন্টার মতো লাগতে পারে।

কেএসআরএম’র মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখন প্রধান কাজ হচ্ছে, জাহাজের সঙ্গে যে কোনোভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা। সেখানে থাকা আমাদের নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনা। এজন্য আমাদের যা যা করা দরকার, আমরা সেটাই করবো।’

এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরবসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

সারাবাংলা/আরডি/এনইউ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন